মা আমাদের ভাইবোনদের অনেক কষ্ট করে বড় করেছেন কখনো অন্যের বাড়িতে কাজ করে, মাটি কাটার কাজ করে, আবার কখনো কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করে। তিনি যেভাবে পারেন আমার জন্যে টাকা জোগাড় করে দিতেন। তিনি না থাকলে হয়তো আজ আমি এত দূর আসতে পারতাম না। হয়তো কোনো ফ্যাক্টরিতে বা গার্মেন্টসে কিংবা অন্যের জমিতে কাজ করে জীবনযাপন করতে হতো।
আমিও পরিশ্রম করতে ভয় করি না। যখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়তাম, তখন থেকেই নিজে উপার্জন করতে শিখেছি। ছোটবেলা থেকে আমি পড়ালেখার প্রতি খুবই আগ্রহী ছিলাম। অনেকে বিভিন্ন মন্তব্য করলেও একমাত্র আমার মা আজ পর্যন্ত বলে নি যে, বাবা তুই পড়াশোনা বাদ দে। তিনি হাসিমুখে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে আমাকে সাহায্য করেছেন। সুযোগ পেলে এখনো করেন।
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। বাবা চলে গেলেন পরপারে। কিন্তু তখন আমার এসএসসি পরীক্ষা। বাবার মরদেহ বাড়ির আঙিনায় রেখে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। পৃথিবীতে নিজেকে তখন এক অসহায় মানুষ বলে মনে হয়েছিল। ধরে নিয়েছিলাম কপালে হয়তো এটাই লেখা ছিল।
তারপর যখন ভাগ্যান্বেষণের জন্যে জীবনে প্রথম পরিবারের বাইরে চলে গেলাম ঢাকায়, সেখানে গিয়ে মাটি কাটার কাজ করলাম। দিন শেষে মজুরি হিসেবে যা পেতাম তা জমাতে শুরু করলাম। কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে থাকতে হতো।
সেখানে কাজ করা অবস্থায় আমার এক বন্ধু আমাকে ফোন করে জানায়, বান্দরবানে একটা স্কুল আছে, যেখানে দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পড়াশোনা করে। উত্তরে আমি বললাম, আমি সেখানে ভর্তি হতে চাই। একটা ফরম সংগ্রহ করে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম।
রংপুরের চানকঠি গ্রামে আমার বাড়ি। বাড়িতে বললাম, আমি বান্দরবান লামায় গিয়ে পড়াশোনা করতে চাই। কিন্তু আমার পরিবার কোনো অবস্থাতেই রাজি নয়। তবুও পরিবারকে বুঝিয়ে, ভাইকে সাথে নিয়ে রওনা দিলাম সুদূর বান্দরবানে, কোয়ান্টামের উদ্দেশ্যে। সেখানে ভর্তি হলাম।
তারপর সাত দিন ওরিয়েন্টেশন ক্লাস করলাম। সেখানে শিক্ষক মহোদয় আমাদেরকে অনেক কিছু শেখালেন। তাদের আলোচনা আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্ন দেখাতে সহযোগিতা করল। মাঝে মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বড় ভাইয়েরা আসতেন। তাদের সংগ্রাম ও সফলতার কথা তুলে ধরতেন। সেখান থেকে আমি অনুপ্রাণিত হলাম যে, আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে।
তারপর পড়াশোনায় মনোযোগ দিলাম। ধীরে ধীরে সবকিছুই কেমন যেন আপন হতে শুরু করল। শিক্ষকদের সান্নিধ্যে আসা, বড় ভাইদের আদেশ উপদেশ এবং আদর-যত্ন যেন আমাকে ভাবিয়ে তুলল। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহটাও বেড়ে গেল। আমি পড়াশোনায় ভালো ফলাফল করতে শুরু করলাম। ২০২১ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলাম। চট্টগ্রাম বোর্ড থেকে সাধারণ বৃত্তিও পেলাম। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিয়ে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম।
আজ দূরে এসেও সেই কোয়ান্টামমের স্মৃতিগুলো এখনো আমাকে নাড়া দেয়। যখন ক্যাম্পাসে ছিলাম তখন এই মায়ার মর্মটা বুঝতে পারি নি। আর গুরুজী দাদুর একটি বাণী আজও আমার মনে আছে। তিনি বলতেন—বেশিরভাগ সফল ব্যক্তিই শুরু করেছিল একদম শূন্য থেকে এবং তারা অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের।
আমিও সংকল্পবদ্ধ যে, একদিন সফল হবো। আমার এই সাফল্যের রোল মডেল হলেন আমার মা। আমার মনছবি একদিন পূরণ হবে ইনশাআল্লাহ। আমি পৃথিবীর বুকে চিহ্ন রেখে যেতে চাই।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]