বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান এর জন্মদিন
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে আজ বছরের ২২২তম (অধিবর্ষে ২২৩তম) দিন। এক নজরে দেখে নিই ইতিহাসের এই দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা, বিশিষ্টজনের জন্ম ও মৃত্যুদিনসহ আরও কিছু তথ্যাবলি।
১৬৭৫ : রয়্যাল গ্রিনউইচ মানমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।
১৮৬০ : বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখন্ডে, ভারতের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ।
১৮৭৪ : হার্বার্ট হুভার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩১তম রাষ্ট্রপতি।
১৯০২ : আর্নে তিসেলিউস, নোবেল জয়ী (১৯৪৮) সুইডিশ রসায়নবিদ।
১৯২৩ : এস এম সুলতান, বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী।
১৯১৫ : আণবিক সংখ্যার তত্ত্ব, এক্সরে বর্ণালীতে মোসলে সূত্রের প্রবক্তা, ইংরেজ পদার্থবিদ হেনরি মোসলে।
এস এম সুলতান ছিলেন একজন বাংলাদেশি প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী। পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান হলেও এস এম সুলতান নামেই তিনি অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সুরসাধক এবং বাঁশিও বাজাতেন।
১৯৮২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কার লাভ করেন। একই বছর তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন।
জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের মাছিমদিয়ার এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। তার পারিবারিক ডাক নাম ‘লাল মিয়া’। শৈশবে সবাই তাকে ‘লাল মিয়া’ বলেই ডাকত।
সুলতানকে তার বাবা ১৯২৮ সালে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করে দেন। বছর পাঁচেক পর বাবার সাথে রাজমিস্ত্রীর কাজ শুরু করেন, কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলে সেসব দালানের ছবি আঁকা। এর আগে দশ বছর বয়সে স্কুল পরিদর্শনে আসা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর ছবি এঁকে তার চোখে পড়েছিলেন।
সুলতানের ইচ্ছা ছিল সম্ভব হলে কলকাতায় গিয়ে ছবি আঁকা শিখবেন। কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতি সে ইচ্ছার পথে ছিল বড় বাধা। এসময় এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। এস এম সুলতান ১৯৩৮ সালে কলকাতা যান।
কলকাতায় তিনি ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়িতেই ওঠেন। ইচ্ছা ছিল কোনো কাজ জোগাড় করে অর্থ উপার্জন এবং একই সাথে শিল্প শিক্ষা। এ সময়ই তিনি প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক এবং কলকাতা আর্ট স্কুলের গভর্নিং বডির সদস্য শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। সুলতানের জন্যে সোহরাওয়ার্দী তার গ্রন্থাগারের দরজা উন্মুক্ত করে দেন এবং তাকে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকেন।
১৯৪১ সালে সুলতান কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন, যদিও ভর্তির জন্যে প্রয়োজনীয় সকল যোগ্যতা তার ছিল না। এ ব্যাপারে শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর অবদান ছিল মুখ্য। তিন বছর আর্ট স্কুলে পড়াশোনার পর তিনি বেছে নেন একজন ফ্রি-ল্যান্স শিল্পীর জীবন।
আর্ট স্কুলের বাঁধাধরা জীবন এবং প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার রীতিনীতি তার সহজাত বোহেমিয়ান জীবনযাত্রার সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছিল। সুলতান ছিলেন স্বাধীনচেতা মানুষ কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে তিনি ছিলেন ভবঘুরে বা ছন্নছাড়া।
তিনি প্রকৃতিকে ভালবাসতেন একজন রোমান্টিক কবির আবেগ দিয়ে এবং সেরকম তীব্রতা নিয়েই তিনি অস্বীকার করেছেন যান্ত্রিকতা-পিষ্ট নগর ও নাগরিক জীবনকে। ১৯৪৩ সালে তিনি খাকসার আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন।
এরপর তিনি বেরিয়ে পড়েন উপমহাদেশের পথে পথে। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। ছোট বড় শহরগুলোতে ইংরেজ ও আমেরিকান সৈন্যদের ছবি এঁকে ও তাদের কাছে ছবি বিক্রি করে জীবন ধারণ করেছেন এবং প্রদর্শনীও করেছেন।
শিল্পী হিসেবেও তিনি তখন কিছুটা পরিচিতি লাভ করেছিলেন। কিন্তু সুলতানের চরিত্রে ছিল পার্থিব বিষয়ের প্রতি অনীহা এবং কোনো এক স্থানে শিকড় ছড়িয়ে বসার প্রতি তীব্র অনাগ্রহ।
এ কারণে তখনকার আঁকা ছবির নমুনা, এমনকি ফটোগ্রাফও এখন আর নেই। তবে সে সময় প্রধানত তিনি নিসর্গ দৃশ্য এবং প্রতিকৃতি আঁকতেন। কাশ্মীরে কিছুদিন থেকে তিনি অনেক ছবি এঁকেছিলেন। ১৯৪৬ সালে সিমলায় তার আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয়।
দেশ বিভাগের পর সুলতান কিছুদিনের জন্যে দেশে ফেরেন। কিন্তু তারপরই ১৯৫১ সালে করাচি চলে যান। সেখানে পারসি স্কুলে শিল্প শিক্ষক হিসেবে দুবছর কাজ করেন। এ সময়ে চুঘতাই ও শাকের আলীর মতো শিল্পীদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। ইতঃপূর্বে ১৯৫০ সালে চিত্রশিল্পীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্যে তিনি আমেরিকা যান এবং নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো, বোস্টন এবং এরপর লন্ডনে তার ছবির প্রদর্শনী করেন।
১৯৫৩ সালে আবার নড়াইল ফিরে তিনি শিশু শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। শিশুদের নিয়ে সুলতানের অনেক স্বপ্ন ছিল। শেষ বয়সে নড়াইলে ‘শিশুস্বর্গ’ ও ‘চারুপীঠ’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এর কিছু বাস্তবে রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
নড়াইলে তিনি নন্দন কানন নামের একটি প্রাইমারি ও একটি হাইস্কুল এবং একটি আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
মধ্য পঞ্চাশে ঢাকায় যখন আধুনিক চিত্রকলার ক্ষেত্রে অনেক কাজ হচ্ছে এবং প্রচুর উৎসাহ এবং আগ্রহ নিয়ে শিল্পীরা শৈলী নিয়ে, ফর্ম নিয়ে, মিডিয়া নিয়ে নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন তখন সকলের দৃষ্টির আড়ালে তিনি নড়াইলেই রয়ে গেলেন। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন, কিন্তু তার জীবনের মূল সুরটি বাঁধা ছিল গ্রামীণ জীবন, কৃষক ও কৃষিকাজের ছন্দের সঙ্গে।
সেখানেই তিনি আবিষ্কার করেছেন বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং বাঙালি জীবনের প্রধান উৎসকেন্দ্রটি, বাঙালির দ্রোহ ও প্রতিবাদ, বিপ্লব ও সংগ্রাম এবং নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার ইতিহাস এবং অনুপ্রেরণা।
তিনি কৃষক পুরুষের শরীরকে করেছেন পেশীবহুল এবং বলশালী, কৃষক রমণীর শরীরকে এঁকেছেন সুডৌল ও সুঠাম গড়নে, তাকে দিয়েছেন যুগপত লাবণ্য এবং শক্তি। হয়তো জীবনে কৃষকায়, ম্রিয়মাণ কৃষকদের দেখে দেখে কল্পনার নির্মাণে তাদের তিনি দিয়েছেন শক্তি ও স্বাস্থ্য।
১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সুলতান শিল্পরসিকদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যান। মধ্য সত্তরে তার কিছু শুভানুধ্যায়ী তাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ঢাকায় থেকে তিনি কিছু ছবি আঁকেন এবং ১৯৭৬ সালে সেসব ছবি দিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। বস্তুত, এ প্রদর্শনীটিই তাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়।
এ ছবিগুলোই সুলতানকে নিম্নবর্গীয় মানুষের প্রতিনিধি এবং তাদের নন্দনচিন্তার একজন রূপকার হিসেবে উপস্থাপিত করে। তার ছবিতে গ্রাম হচ্ছে বিশ্বের কেন্দ্র এবং কৃষকই হচ্ছে প্রকৃত জীবন শিল্পী। গ্রাম ও গ্রামের মানুষের মধ্যেই তিনি খুঁজেছেন তার সৃষ্টির অনুপ্রেরণা।
তার কাজে অবয়বধর্মিতাই প্রধান। তিনি আধুনিক, বিমূর্ত শিল্পের চর্চা করেননি; তাঁর আধুনিকতা ছিল জীবনের শাশ্বত বোধ ও শিকড়ের শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করা। তিনি ফর্মের নিরীক্ষাকে গুরুত্ব দেননি, দিয়েছেন মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে, উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই এবং উপনিবেশিকোত্তর সংগ্রামের নানা প্রকাশকে তিনি সময়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপনা করেছেন।
এটাই তার কাছে ছিল ‘আধুনিকতা’, অর্থাৎ তিনি ইউরো-কেন্দ্রিক, নগর নির্ভর, যান্ত্রিকতা-আবদ্ধ আধুনিকতার পরিবর্তে অন্বেষণ করেছেন অনেকটা ইউরোপের রেনেসাঁর শিল্পীদের মতো মানবের কর্মবিশ্বকে।
সুলতানের মতো কেউ আধুনিকতার এরকম ব্যাখ্যা দেননি। তার স্টাইলের ক্ষেত্রে তিনি অননুকরণীয়। তার কোনো অনুসারী বা স্কুল নেই, কারণ তার মতো মৃত্তিকা সমর্পিত জীবন তার সময় আর কোনো শিল্পী যাপন করেননি।
সুলতান তেলরঙ ও জলরঙের ছবি এঁকেছেন, ব্যবহার করেছেন সাধারণ কাগজ, সাধারণ রং ও চটের ক্যানভাস। এজন্যে তার অনেক ছবির রং নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেদিকেও তার কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না।
আশির দশক থেকে তিনি নড়াইলে থেকে যেতে অনেকটা বাধ্য হয়েছিলেন। তার কাছে আশ্রয় নেওয়া মানুষ, শিশু এবং জীবজন্তুর প্রতি তার ভালবাসার জন্যে তার বাড়িটিকে এদের জন্যে ছেড়ে দিয়েছিলেন। একটি চিড়িয়াখানা ছিল তার। শিশুদের জন্যে একটি বিরাট নৌকাও বানিয়েছিলেন।
১৯৮৭ সালে ঢাকার গ্যেটে ইনস্টিটিউটে সুলতানের আরেকটি প্রদর্শনী হয়। আশির শেষ দিকে তার স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে, ১৯৯৪ সালে ঢাকার গ্যালারি টোন-এ তার শেষ প্রদর্শনীটি হয়।
তিনি ১৯৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের কাছ থেকে শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার গ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে নিউ ইয়র্কে, ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন৷ এছাড়াও ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে আন্তর্জাতিক জুরি কমিটির অন্যতম সদস্য মনোনীত হন৷
১৯৮২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কার লাভ করেন। একই বছর একুশে পদক এবং ১৯৯৩ সালে তিনি স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার লাভ করেন।
এছাড়াও ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সাত বছর ধরে সুলতানের উপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হয় ‘আদম সুরত’। তারেক মাসুদের প্রযোজনা এবং পরিচালনায় এই প্রামাণ্যচিত্রে সুলতানের দৈনন্দিন কর্মজীবন তুলে ধরার পাশাপাশি বাংলার সংস্কৃতি এবং কৃষিচিত্র উপস্থাপন করা হয়।
এস এম সুলতানের জীবন এবং কর্মের ওপর ২০১০ সালে ফাহিম মিউজিকের ব্যানারে ‘লাল মিয়া’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন আমিরুল ইসলাম। এতে সুলতানের স্মৃতিবিজড়িত নড়াইলের বিভিন্ন স্থান, চিত্রা নদী, শিশুস্বর্গ, বিভিন্ন সময়ে তার আঁকা চিত্র ও দুর্লভ আলোকচিত্র রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে সুলতানের পাঁচ মিনিটের একটি সাক্ষাৎকার।
শিল্পী এস এম সুলতান শেষ জীবনে বলে গিয়েছেন, ‘আমি সুখী। আমার কোনো অভাব নেই। সকল দিক দিয়েই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে।’ ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র: সংগৃহীত