1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
  2. [email protected] : adminbackup :
বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৮:০৭ পূর্বাহ্ন

ইতিহাসে জুন ১১ – বাঙালি বাউল সাধক উকিল মুন্সী এর জন্মদিন

  • সময় শুক্রবার, ১১ জুন, ২০২১
  • ১২২৩ বার দেখা হয়েছে

ইতিহাসে জুন ১১

বাঙালি বাউল সাধক উকিল মুন্সী এর জন্মদিন

গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে আজ বছরের ১৬২তম (অধিবর্ষে ১৬৩তম) দিন। এক নজরে দেখে নিই ইতিহাসের এই দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা, বিশিষ্টজনের জন্ম ও মৃত্যুদিনসহ আরও কিছু তথ্যাবলি।

ঘটনাবলি

১৮৫৫ : বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সূর্যরশ্মির বিভাজন আবিষ্কার করা হয়।

জন্ম

১৫৭২ : বেন জনসন, ইংরেজ নাট্যকার, কবি এবং সাহিত্য সমালোচক
১৮৮৫ : উকিল মুন্সী, বাংলাদেশি বাউল সাধক, গীতিকবি
১৮৯৭ : রামপ্রসাদ বিসমিল, মণিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় যুক্ত বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবী
১৮৯৯ : ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা, নোবেলজয়ী জাপানি সাহিত্যিক।

মৃত্যু

১৯২৮ : বাঙালি, ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী শৈলেশ্বর বসু
১৯৩৬ : আমেরিকার লেখক রবার্ট ই. হাওয়ার্ড
১৯৬২ : ভারতীয় বাঙালি অভিনেতা ছবি বিশ্বাস
১৯৭০ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগ
১৯৯৭ : বাঙালি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দূরগামী সাঁতারু মিহির সেন

উকিল মুন্সী

উকিল মুন্সী একজন বাঙালি বাউল সাধক। তিনি ছিলেন বাউল গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। তার গুরু ছিলেন আরেক বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন। উকিল মুন্সীর অসংখ্য গানের মধ্যে আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে, আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, পূবালি বাতাসে ইত্যাদি গান বাংলাদেশের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। ঘরে কিংবা মোড়ের টং দোকানে বসে চা খেতে খেতে এই গানগুলো গ্রামীণ জনপদে বহুদিন যাবত মানুষের অন্তরের খোরাক যোগায়।

জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৫ সালে ১১ জুন নেত্রকোনার জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার বেতাই নদীর তীরে জৈনপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। বাবা গোলাম রসুল আকন্দ ছিলেন একজন ধনাঢ্য তালুকদার। উকিল মুন্সীর নাম রাখা হয় আব্দুল হক আকন্দ। শৈশবকাল থেকেই আব্দুল হক আকন্দ বাংলা পড়ালেখার পাশাপাশি ফারসি ও আরবি শিক্ষায় শিক্ষিত হন। বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলে বড় হয়ে একজন উকিল হবে। তাই তারা ছোটবেলা থেকেই আদর করে তাকে ‘উকিল’ নামে ডাকতেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় উকিল নামের মানুষটি মসজিদে ইমামতি করলে তার নামের শেষে ‘মুন্সী’ শব্দটি যোগ হয়। আর এভাবেই সবাই আব্দুল হক আকন্দ নাম ভুলে যায়, তার নাম হয়ে যায় ‘উকিল মুন্সী’।

উকিল মুন্সীর বয়স যখন ১০ বছর, তখন তার বাবা মারা যান এবং তিনি এতিম হয়ে পড়েন। মা পাশের গ্রামে পুনরায় বিয়ে করে চলে গেলে উকিল মুন্সী বাধ্য হয়েই মায়ের কাছে যান। ওখানেই থাকতেন। পরে তার এক সৎভাই জন্মগ্রহণ করেন, যার ফলশ্রুতিতে তার আদর যত্নের অভাব আরও বেড়ে যায়। অবহেলার শিকার হন তিনি। অভিমানে চলে আসেন নিজ বাড়ি বোয়ালীতে। এরপর ফুফুর বাড়িতে কিছুদিন। আবার নিজ গ্রামে ফেরা। এরপর পড়াশোনাও আর বেশি দিন করা হয়নি। অভাব-অনটন, অবহেলা-অনাদরে কাটতে থাকে তার দিন। জমি-জমা ধীরে ধীরে বিক্রি করে সাময়িক ও বৈষয়িক অভাব দূর হয়। কিন্তু অন্তরে তার তৈরি হয় ভালোবাসাহীনতার এক প্রবল তৃষ্ণা। এই অতৃপ্তি, না পাওয়ার শূন্যতা তাকে ঘরছাড়া করে। বাবা-মা কেউ না থাকায় তিনি অবাধ স্বাধীন থাকলেও মনের মধ্যে শুরু হয় গভীর শূন্যতা।

তৎকালীন সময়ে ওই অঞ্চলে ঘাটু গানের খুব প্রচলন ছিল। উকিল মুন্সী নিয়মিত বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে সারারাত ঘাটু গান শুনতেন। গান তার অন্তরকে নাড়া দেয়। ঠিক করলেন, নিজেই ঘাটু গান রচনা করবেন এবং গাইবেন। কিশোর উকিল মুন্সীর কণ্ঠ ছিল খুবই মধুর ও দরাজ। তার গানে দর্শক-শ্রোতা মুগ্ধ হতো নিমিষেই। দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহসহ মূলত ভাটি অঞ্চলে বর্ষাকালে ঘাটু গান পরিবেশন করতে থাকেন। অল্প সময়েই দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন চারিদিকে। তিনি নিজের মধ্যে সূর বাঁধেন, সূর লালন করতে থাকেন।

জীবন থেকে শিখতে থাকেন উকিল মুন্সী। প্রকৃতি থেকে শেখেন, ভাবনার মাঝে হারিয়ে যেতে থাকেন প্রায়ই। দুর্দিনে কারো সহায়তা না পেয়ে বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ তিনি পানির দরে বিক্রি করতে থাকেন। দরছে গিয়ে তিনি ইমামতি করেন ও ছেলেমেয়েদের আরবি পড়া শেখাতে থাকেন। নির্জনে একা থাকা উকিল মুন্সী নিজেই গজল রচনা করতেন এবং উচ্চস্বরে সুমধুর কণ্ঠে গাইতেন। গভীর রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ শেষে তিনি সুমধুর কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত করতেন ও গজল গাইতেন। এভাবেই রাত পার করে দিতেন। অন্তরে অনেক দুঃখ নিয়ে তিনি দিন কাটাতে লাগলেন।

হামিদা আক্তার নামের এক মেয়ের প্রেমে পড়লে তার বিয়েতে কেউ সহায়তা করতে রাজি হননি। বিষয়টি নিয়ে বেশ কষ্ট পেতে হয়েছে তাকে। অবশেষে ৩১ বছর বয়সে উকিল মুন্সী হামিদা আক্তারকে বিয়ে করেন এবং শ্বশুরের দেয়া একটি বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন। শ্বশুর বাড়িতে থাকা অবস্থায় তার প্রথম পুত্রসন্তান জন্ম নেয়; নাম রাখেন তার আব্দুস সাত্তার। এই সেই বিখ্যাত বাউল আব্দুস সাত্তার যিনি দেশে-বিদেশে বাউল গান গেয়ে অনেক বিখ্যাত হয়েছিলেন। তারপর উকিল মুন্সীর ঘরে আরও এক ছেলে ও দুই মেয়ে জন্ম নেয়।

সন্তানদের জন্মের পর উকিল মুন্সী দরছ হিসেবে মদন থানার কুলিয়াটি গ্রামে চলে যান। সেখানে তিনি গান ও গজল রচনা করতেন, গাইতেন। লোকজনের মুখে মুখে তার নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। এক পর্যায়ে তার মধ্যে আধ্যাত্মিক চিন্তা ধারার ভাব প্রকাশ পেতে থাকে, চলে যান তিনি হবিগঞ্জের রিচি গ্রামে এবং সেখানে বিখ্যাত পীর মোজাফফর আহমেদের (রহ:) কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। কুলিয়াটি গ্রামে উকিল মুন্সীকে কেন্দ্র করে ভাটি বাংলার বিভিন্ন এলাকার বাউল শিল্পীরা একটি আশ্রয় বা আখড়া গড়ে তোলেন। এটা হয়ে যায় তৎকালীন সময়ে বাউলদের ঠিকানা। এই কুলিয়াটি গ্রাম আসলে অনেক বাউলের আঁতুড়ঘর।

গানের জগতে উকিল মুন্সী ছিলেন এক বিরহী ডাহুক। তিনি নারী-পুরুষের অন্তরের আকুতি, প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ, বিরহ গাঁথা নিয়ে গান রচনা করতেন এবং সৃষ্টিকর্তাকে উদ্দেশ্য করে বিরহের অনুভূতি প্রকাশ করতেন। যদিও তিনি ছিলেন একজন বাউল কিন্তু তিনি বহু প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি মসজিদে ইমামতি করতেন, কোরআন তেলাওয়াত করে তার ব্যাখ্যা দিতে পারতেন, হাদিসের ব্যাখ্যা দিতে পারতেন, দোয়া পরিচালনা করতে পারতেন। ধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও জ্ঞান তার বাউল গান ও জীবনে কোনোরূপ বিচ্যুতির সৃষ্টি করেনি। যাদের উকিল মুন্সী নামাজ পড়াতেন, তারাই আবার উকিল মুন্সীর গানের শ্রোতা হতেন।

গ্রামের মুরুব্বিরা, মুসুল্লিরা উকিল মুন্সীকে জানাজায় ইমাম হিসেবে পাওয়ার জন্যে আকুতিও করতেন। এমনকি, এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিরা তাদের পরিবার পরিজনকে আগে থেকেই বলে রাখতেন যে তার মৃত্যুর পর উকিল মুন্সী যেন জানাজায় ইমামতি করেন। এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যে, তিনি গানের আসর করছেন কিন্তু হঠাৎ খবর এসেছে যে জানাজায় যেতে হবে। তিনি গানের আসর ছেড়ে চলে গেছেন জানাজা পড়াতে।

উকিল মুন্সীর অনেক বিরহ গাঁথার মধ্যে একটি বিখ্যাত গান হলো- “আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে.. পুবালি বাতাসে..”। এই গানে একজন অসহায় নারীর নাইওর যাওয়ার আকুতি প্রকাশ পেয়েছে। গানের শেষ দিকে কার্তিক মাসের শেষের দিকে উকিল মুন্সি নিজেই নাইওর যাওয়ার বাসনা ব্যক্ত করেছেন। ধারণা করা হয়, তার পীরের মৃত্যু হয়েছিল কার্তিক মাসের শেষের দিকে। তাই তিনি তার পীরের শেষ যাত্রাকেই গভীর বেদনায় ইঙ্গিতপূর্ণভাবে প্রকাশ করেছেন। তার নিজের সঙ্গে তার পীরের আধ্যাত্মিক যোগাযোগের যে টান ছিল তা থেকে জানা যায় যে, তার পীর যখন শেষবারের মতো অসুস্থ হন, তখন উকিল মুন্সীকে জরুরি খবর পাঠানো হয়। উকিল মুন্সী তার কোলের মধ্যে তার স্বীয় পীরের মাথা রেখে গজল ধরেন এবং সেই গজল শুনতে শুনতে তার পীর শেষবারের মতো চোখ বোঝেন।

উকিল মুন্সীর সমসাময়িক বাউল ছিলেন চান মিয়া ফকির, বাউল রশিদ উদ্দিন, বাউল জালাল উদ্দিন খাঁ, বাউল উপেন্দ্র সরকার, বাউল চান খাঁ পাঠান প্রমুখ। উকিল মুন্সী ও তৎকালীন সমসাময়িক বাউলরা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মানুষে মানুষে বন্ধন ভ্রাতৃত্ব ও কল্যাণের কথা গানের সুরে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। উকিল মুন্সীর লেখা অসংখ্য গানের মধ্যে প্রায় দুই শত গান খুঁজে পাওয়া যায়। কিছু গান মানুষের মুখে মুখে রয়েছে কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে সংগৃহীত নয়।

উকিল মুন্সী গানের দলে নেতৃত্ব দিতেন। মরমী এই শিল্পী সৃষ্টিতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, লোকতত্ত্ব প্রভৃতি গানের মাঝে প্রশ্ন, উত্তর ও পাল্টা প্রশ্নের মাধ্যমে ওই সময়ের মালজুড়া গানে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেন। উকিল মুন্সী নিজের লেখা গানই বিভিন্ন পালাগানে গাইতেন এবং অন্যান্য সাধকদের গান গাইতেন মালজুড়া গানে। মুর্শিদ মোজাফফর আহমেদের সঙ্গে ছিল তার গভীর যোগাযোগ। ভরা বর্ষায় ব্যাকুল হয়ে উঠতো উকিল মুন্সীর প্রাণ। তিনি তখন বিরহের গান লিখতেন, দরদ ভরা কণ্ঠে বিভিন্ন আসরে গাইতেন, কাঁদতেন, মানুষকে কাঁদাতেন।

অত্যন্ত মেধাবী, সুন্দর অবয়ব, সঙ্গীত ও ধার্মিক প্রতিভা ও সর্বগুণে কীর্তিমান, বিনয়ী এই মানুষটি ১৯৭৮ সালের ১২ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। পূর্ব ইচ্ছা ও নির্দেশনা অনুযায়ী তাকে জৈনপুর গ্রামে বেতাই নদীর কোলঘেঁষা বাড়ির উঠানে পুত্রের পাশে দাফন করা হয়। উকিল মুন্সীর জীবদ্দশায় তার কোনো গানের বই প্রকাশিত হয়নি। এখন প্রতিবছর জৈনপুরে উকিল মুন্সির মাজার প্রান্তরে বাউল গানের আয়োজন করা হয়, যেখানে বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলসহ অন্যান্য প্রখ্যাত সব বাউলরা উপস্থিত হন এবং গান পরিবেশন করেন।

 

সূত্র: সংগৃহীত

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All Rights Reserved © rmgbdnews24.com