নিজাম শেখ প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলছিলেন, ‘আমার একটা ট্রলারও পাঠাই নাই। যারা গ্যাছে, তারাও খুব বেশি ইলিশ পায় নাই। আবহাওয়া খারাপ, তাই এই অবস্থা। কিন্তু এইবার ইলিশ ভালো হইবে, আশা করতেছি।’
এমন আশা জেলেদের যেমন, তেমনি ইলিশ গবেষক ও মৎস্যসম্পদ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। তারা বলছেন, এবার নিষেধাজ্ঞা খুব ভালোমতো পালন করা হয়েছে। গবেষকেরা দেখেছেন, নদীর যেসব স্থানে ইলিশের বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র, সেখানে পানির গুণগত মান আগের চেয়ে ভালো। এসব স্থানে এসে ইলিশ স্বস্তি পাবে। পানির মান ভালো হওয়ার জন্যে এখানে মিলবে ইলিশের জন্যে পর্যাপ্ত খাবার। তাতে ইলিশের স্বাদ বাড়বে, বাড়তে পারে সংখ্যাও। ১ আগস্ট ২০২১ প্রথম আলোতে লিখেছেন পার্থ শঙ্কর সাহা।
পানিতে ইলিশের জন্যে এ সুখবর পাওয়া গেছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের পানির মান পরীক্ষায়। এ প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা গত জুন মাসেই পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও-ডিসলভ অক্সিজেন), পিএইচ, হার্ডনেস (ক্ষারত্ব), অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ইত্যাদি দেখেছেন।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘নিয়মিত পানির মান পর্যবেক্ষণের অংশ হিসেবে গত জুনে এ পরিমাপ করা হয়। ইলিশ বা অন্য মাছের প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্রে যে চারটি বিষয়কে পরিমাপ করা হয়েছে, এর সব কটিতেই গত বছরের চেয়ে মান ভালো পাওয়া গেছে।’
চাঁদপুর লঞ্চঘাট, মুন্সিগঞ্জের যেখানে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার মিলনস্থল যেখানে মেঘনায় মিলিত হয়েছে, সেই গজারিয়ার শাটনল ও চাঁদপুরের হরিণাঘাটের কাঁটাখালী—এ তিন এলাকা থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এসব এলাকা ইলিশ এবং অন্য মাছের বিচরণক্ষেত্র এলাকার আওতাভুক্ত।
পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ যদি লিটারপ্রতি পাঁচ মিলিগ্রামের কম হয়, তবে তা জলজ পরিবেশের জন্যে উপযোগী নয় বলে বিবেচিত। পানির মান পরীক্ষায় দেখা গেছে, এ বছর দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ সাড়ে পাঁচ মিলিগ্রামের বেশি। গত বছর এ সময়ে পাঁচ মিলিগ্রামের ওপরে ছিল। তবে এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ সাড়ে চার থেকে পাঁচ মিলিগ্রামের মধ্যে ছিল।
অ্যামোনিয়া হলো নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেনের সমন্বয়ে গঠিত একটি রাসায়নিক যৌগ। যে পানির মান ভালো, সেখানে এর শূন্য উপস্থিতি থাকতে হবে। তবে ২০১৯ সালে মাছের এসব বিচরণক্ষেত্র গড়ে দশমিক শূন্য ২ বা ৩ মিলিগ্রাম হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবার তা শূন্য দেখা গেছে।
অ্যাসিড ও ক্ষারের পরিমাপকে পিএইচ বলা হয়। জলজ প্রাণীর সহনীয় পরিবেশের ক্ষেত্রে পিএইচ থাকতে হবে সাত থেকে আটের মধ্যে। অন্তত সাতের নিচে নয়। কিন্তু দুবছর আগে এ সময় পিএইচ সাড়ে ছয় থেকে সাতের মধ্যে ছিল। এখন সেখানে আট থেকে সাড়ে আট হয়ে গেছে।
পানিতে হার্ডনেসের সহনীয় মাত্রা প্রতি লিটারে ৪০ থেকে ৬০ মিলিগ্রাম থাকলে ভালো। এবার ৬০ থেকে ৭০–এর মধ্যে থেকেছে। গত বছরও এমনটা ছিল।
আনিছুর রহমান বলেন, দেখা যাচ্ছে করোনাকালের পর থেকে ইলিশের এসব বিচরণক্ষেত্রে পানির গুণগত মান বেড়েছে। গত বছর থেকেই উন্নতি দেখা গিয়েছিল। এবার তা আরও বেড়েছে। এ বছর এবং আগের বছর করোনার কারণে বিভিন্ন সময় নৌযান চলাচলের নিষেধাজ্ঞা নদীর পানির মান বাড়াতে সহায়তা করেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ২০ মে থেকে বরাবরের মতো এবারও সমুদ্রে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এটি চলে ২৩ জুলাই পর্যন্ত। ইলিশের বংশবৃদ্ধির জন্যেই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখন ২৩ জুলাইয়ের পর সমুদ্রের ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্যে ছুটবে নদীর দিকে। ইলিশের এক অনন্য জীবনচক্র রয়েছে। সে তার মাতৃনিবাসে, অর্থাৎ নদীর দিকে এসে ডিম ছাড়বে। এখন ইলিশের মূল মৌসুম; ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আসবে।
মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ শাখার উপপ্রধান মাসুদা আরা মমি বলেন, ‘এ সময় যদি পানির মান ভালো হয়, তাহলে বেশি ইলিশ আসবে। ভালো পানি মানে এখানে মাছের জন্যে ভালো খাবার তৈরি হয়েছে। তাই শুধু সংখ্যায় নয়, আকারেও পুষ্ট হবে ইলিশ।’
বাংলাদেশে বিগত বছরগুলোয় ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদিত ইলিশ ছিল ৫ দশমিক ১৭ লাখ মেট্রিক টন। পরের বছর হয় ৫ দশমিক ৩৩ লাখ মেট্রিক টন। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল সাড়ে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন।
পানির মান ভালো হলে শুধু যে উৎপাদন বাড়ে, তা–ই না, বাড়ে এর প্রজনন–সফলতা। ইলিশের ডিম ছাড়ার হারকে বলে প্রজনন–সফলতা। গত বছর প্রজনন–সফলতা ৫১ শতাংশ ছিল। আগের বছর এটি ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। এবার এ হার আরও বাড়বে বলেই ধারণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। অক্টোবর মাসে প্রজনন মৌসুমে এ সফলতার হার দেখা হয়।
তবে পানির মানের সঙ্গে মাছের খাবার বৃদ্ধি পেয়েছে কি না, তা একটি বড় বিচার্য বিষয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নিয়ামুল নাসের। নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের পানির মান দেখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, পানির মানের পাশাপাশি ইলিশের বিচরণক্ষেত্রগুলোয় খাবারও বেড়েছে।
সূত্র: প্রথম আলো (১ আগস্ট ২০২১)