তিনি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আধ্যাধিক জগতের রাহবার । যে মানুষটির হাত ধরে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান জিকিরের পথ জেনে সর্বদা জিকিরে কল্ব কে জিন্দা রেখেছেন । যে মানুষটি পাকি হায়েনার থাবা থেকে এদেশের মাটি ও মানুষকে মুক্ত করতে নিজের বুদ্ধি খরচ করছেন, শ্রম দিয়েছেন এবং ঘাম ঝরিয়েছেন।
পাকি হায়েনার দোসর এদেশের সবচেয়ে ঘৃণিত জীব- আলবদর, আলশামস ও রাজাকারের হাজারো ত্রাসী মিশন ব্যর্থ করে এদেশের মা-বোনদের ইজ্জত বাঁচিয়েছেন।
এজন্য বড় কোন খেতাব তিনি পাননি। পাননি রাজনীতির কৌটায় বদ্ধ স্বাধীনতা কিংবা একুশে পদক। আলোকিত মানুষদের পদক লাগে না। তাঁরা বরং নিজেদের আলোতে উদ্ভাসিত করেন দশদিক।
সে আলো পৌঁছে যায় মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়। যেখানে আলোকিত মানুষ বিনাখরচে একটি অতুল বাসা বাঁধেন। সে বাসা আলোর বাসা। সে ঘর প্রেমের ঘর। আর সে ঘর বা বাসাটাতে তাঁরা যুগ যুগ ধরে বসবাস করতে থাকেন। হযরত পীর মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহিও সে রকম একজন ‘আলোকিত পীর’।
তিনি চেকনায় চেহারার গরু-মোষলোভী অন্ধকার ও নিশাচর পীরদের মতো আলখেল্লাধারী কোন পীর ছিলেন না। তিনি ছিলেন সাধাসিধে মুসলমানের ‘সাধাসিধে পীর’। তাঁর নামের আগে-পিছে সাড়ে তিন মাইল লম্বা লকবের তকমা ছিলনা। তাঁর দরবারে ছিলনা কোন বাহারি আয়োজন। ঢাক-ঢোল বাজিয়ে, নর্তন-কুর্দন করে মানুষ ভেড়ানোর কদাকার বিশ্রি ব্যবস্থাপনাও ছিলো না। তিনি ছিলেন ‘আলোর ফেরিওয়ালা’।
আজীবন তিনি মানুষের কলবে আলোর ফেরি করে বেড়িয়েছেন।
আর মানুষের হৃদয়ের অন্ধকার দূর করেছেন। মানুষকে দেখিয়েছেন সরল সোজা পথ- ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’। তাঁর সেই পথের বাহন ছিল- জ্ঞানের সাধনা। সেই বাহনের জ্বালানী ছিল তাঁর সাহিত্যকর্ম।
এদেশে সুন্নীদের প্রকাশনা জগতে যখন খরা চলছিল, তখন তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন- সেরহিন্দ প্রকাশন। নাহ্, এজন্য তিনি দেশে-বিদেশে চাঁদাবাজি করেন নি। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দাতাদের দুয়ারে দুয়ারে যাননি। এবং প্রকাশনী, প্রেস, কমপ্লেক্স করার কথা বলে ভিক্ষা আর চাঁদাবাজির সব টাকাগুলো নিজের একাউন্টে জমা করেন নি।
তিনি নিজের হালাল রুজির টাকা দিয়ে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান করেছেন। আর এই প্রতিষ্ঠানটি অতি অল্পদিনেই দেশের লীডিং প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। তাঁর বইগুলো সুখপাঠ্য এবং বেস্ট সেলার। অনলাইনে বলুন বা অফলাইনে বলুন- সুন্নী অঙ্গনে মানসম্মত বই লেখা ও প্রকাশনায় এখন পর্যন্ত তিনিই রাজা।
তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেও তাঁর সাহিত্য-কর্মগুলো আমাদের মাঝে রেখে গেছেন। মানুষ গোগ্রাসে সেই সাহিত্য কর্ম গিলছে। পরিশুদ্ধ আকীদায়, পরিশুদ্ধ চিন্তনে এবং পরিশুদ্ধ কর্মে উজ্জীবিত হচ্ছে। এ এক অমোঘ শক্তি। সে শক্তির মোকাবেলা করা যায় না। বাতিলরা শত চেষ্টা করেও তা পারেনি।
আল্লাহ তাঁর নূরকে বাতিল শক্তির উপর বিজয়ী করেছেন। তিনি চিরঞ্জীব, চির অক্ষয়। তিনি তাঁর প্রিয় হাবীবের (দরুদ) মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা সেই সেফাতের ফয়ূজাত দান করেন। এই ‘অতুল ফয়ুজাত’ লাভকারী বান্দারাও শত্রু-মিত্র সবার মাঝেই সেই ফয়ূজাতের অালো ছড়ান।
এ যুগে সেই আলোর ফেরিওয়ালাদের মধ্যে হযরত পীর মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ অন্যতম। তিনি আর নেই। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রবাহ পূরুষ, বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বিখ্যাত তাফসীরে মাযহারী ও ও অনবদ্য মাদারেজুন নবুওয়তের অনুবাদক, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ গত ২৩ মে ২০১৬ইং তারিখ সোমবার সন্ধ্যা ৭.২০ ঘটিকায় ভারতের কোলকাতায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর।
হযরত পীর মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ (রহ.) এর কৃতিত্বটা কোথায়? এক সময় তাঁর সাথে সেনানীদের বেশ সখ্যতাও ছিল। তিনি তাঁর প্রেস থেকে পোস্টার ছাপিয়ে দিতেন। এখনকার সুস্থ মস্তিষ্কের (?) নেতারা সে সম্পর্কে জানে না। তারা ব্যাপক চাঁদাবাজি করে বড় হল ভাড়া করে বিভিন্ন লোকদের ক্রেস্ট দেয়!
কিন্তু সেই লোকদের তালিকায় পীর মামুনুর রশীদের মতো গুণীজনরা থাকেন না। তাঁর কৃতিত্ব ও অবদান সম্পর্কে জানতে হলে তাঁর লিখিত বইগুলো পড়তে হবে। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি লিখেছেন ৬০ টিরও বেশি বই। প্রাঞ্জল বাংলায়, ঝরঝরে শব্দে এবং অসম্ভব সুন্দর ছোট ছোট বাক্যে রচিত তাঁর বইগুলো
আপনার মনের খোরাক যোগাবে। তাঁর ব্যবহৃরিত একেকটি শব্দ যেন একেকটি ফুল। যার সৌরভে আপনি আল্লাহ-রাসূল (দরদ) এবং আওলিয়া প্রেমে বুঁদ হয়ে যাবেন। তাঁর একেকটি বাক্য একেকটি ‘হাওয়াই মিঠাই’। যা খেয়ে আপনার দেহ-মন আন্দোলিত হবে, অালোড়িত হবে এবং অালোকিত হবে।
কী- বিশ্বাস হয় না? আরে ভাই বিশ্বাস করার দরকারটা কি? আপনি নিজেই তাঁর কোন একটা বই পড়ে দেখুন। যদি ভালো না লাগে তো বইটির দামটা আমার থেকে নিয়ে বইটি ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলুন। বাংলা ভাষায় আর কোন লেখকের বইয়ের জন্য আমি এমনটি কখনো বলিনি। আজ কেন বলছি- বুঝতে পারছেন তো?
এই অনিন্দ্য সুন্দর মনের মানুষটির সাথে আমার পরিচয় হয় তাঁর লিখিত ‘ফোরাতের তীর’র মাধ্যমে। একটিও বাহুল্য শব্দের ব্যবহার ছাড়া কীভাবে তিনি কারবালার চিত্রপট আপনার মনের ক্যানভাসে ঢুকিয়ে দেন- পরীক্ষা করুন। তিনি আকায়েদ বিষয়ে লিখেছেন- ইসলামী বিশ্বাস। আদি পিতা-মাতাকে নিয়ে লিখেছেন- ‘প্রথম পরিবার’। হযরত মূসা (আ.) কে নিয়ে লিখেছেন- মহাপ্রেমিক মুসা।
গাউছুল আলামীন সায়্যিদুনা আবদুল কাদের জীলানী (রহ.) কে নিয়ে- জীলান সূর্যের হাতছানি। সুলতানুল হিন্দ (রহ.) সম্পর্কে লিখেছেন- চেরাগে চিশত। হযরত কালিয়ারী (রহ.) সম্পর্কে লিখেছেন- কালিয়ারের কুতুব। হযরত বাহাউদ্দীন নকশেবন্দী (রহ.) সম্পর্কে লিখেছেন ‘নকশায়ে নকশেবন্দ’। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) সম্পর্কে লিখেছেন- নূরে সেরহিন্দ ইত্যাদি। ইসলামী বিষয় ও তাসাউফ সম্পর্কে পড়ুন- নামাযের নিয়ম, রমজান মাস, বায়ানুল বাকি, মুকাশিফাতে আয়নিয়া, তুমি তো মুর্শেদ মহান সহ অমূল্য সব গ্রন্থ।
আরো পড়ুন- তাঁর অনিন্দ্য সুন্দর কবিতার বই- ভেঙে পড়ে বাতাসের সিঁড়ি, বিশ্বাসের বৃষ্টি চিহ্ন, সীমান্ত প্রহরী সব সরে যাও, তৃষিত তিথির অতিথি, নীড়ে তার নীল ঢেউ, সোনার শিকল। পড়ে আপনি আশ্চর্য হবেন। বইয়ের নামগুলো কতো অাধুনিক ও সুন্দর খেয়াল করেছন তো?
হযরত পীর মোহাম্মদ মামুনুর রশীদের (রহ.) সবচেয়ে বড় কীর্তি- বিশ্ব বরেণ্য ও আদৃত তাফসীরগ্রন্থ ‘তাফসীরে মাযহারী’র অনুবাদকর্ম। আপনি যদি বাংলা ভাষায় সঠিক তাফসীরগ্রন্থ পড়তে চান- তো এই তাফসীরটি পড়ুন।
ভারত উপমহাদেশে ইলমে হাদীসের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) রচিত নির্ভরযোগ্য নবী জীবনী ‘মাদারেজুন নবুওয়ত’র দিলকশ অনুবাদকর্ম এই অালোকিত পীর সাহেবের এক অতুল খিদমাত। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা!
আপনাদেরকে মরহুম পীর সাহেবের অনুদিত একসেট ‘মাদারেজুন নবুওয়ত’ সংগ্রহ করার জন্য আমি বিশেষভাবে অনুরোধ করবো। আমাদের ধর্মীয় লেখকদের ভারি ভারি ভুল শব্দ, অবিন্যস্ত বাক্য এবং বিষয়বস্তুর সাথে সর্ম্পকহীন লেখাগুলো পড়ে আপনার মন বিষিয়ে ওঠেছে? কুচ পয়োয়া নেহি। আপনি পীর মোহাম্মদ মামুনুর রশীদকে পড়ুন।
আপনার বিষিয়ে ওঠা মন, আপনার তাঁতিয়ে ওঠা অন্তর এবং বাতিল গ্রীস্মের রোদ্দুরে আপনার ফাঁটা হৃদ-জমিন ঈমান ও আকিদার নূরী বৃষ্টিতে সবুজাভ হয়ে ওঠবে। তিনি পীর হয়ে বই লিখেছেন। দীনের আলো এবং সুন্নীয়তের আলো ছড়িয়েছেন।
আমাদের গরু-মোষ ও হাদিয়া লোভী পীরেরা না বই লিখেন, না বই ছাপাতে সাহায্য করেন। বড়জোর তারা নিজেরা নিজেদের আজগুবি কেচ্ছাগুলো ‘কারামাত’ হিসেবে চালিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। যা দেখে সুধীজনেরা ব্যাপক হাসাহাসি করে।
হযরত পীর মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ (রহ.) ‘৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হন। কর্মজীবনে বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ক্ষেত্রেও তিনি আমাদের কর্মবিমূখ ‘গরুবাবা’ বা ‘মোষবাবা’দের জন্য আদর্শও বটে!
আধ্যাত্মিক জগতে তিনি ছিলেন বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সূফীসাধক। দীনের ‘দাঈ’ হিসেবে তিনি ধর্ম প্রচারের মহান ব্রত নিয়ে ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে কম্বোডিয়া হিজরত করেন এবং সেখানে ইসলাম র্ধমের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বলতে গেলে হযরত পীর মোহাম্মদ মামুনুর রশীদের (রহ.) কম্বোডিয়া হিজরতের পরই সেখানে ইসলামের অগ্রযাত্রা শুরু হয় যা এখনও অব্যহত রয়েছে। হযরত পীর মামুনুর রশীদ (রহ.)’র জন্ম ১৯৫০ সালের ৭ মার্চ দিনাজপুর জেলার বিরামপুরে। মৃত্যুকালে তিনি এক কন্যা ও লাখো অনুসারী রেখে গেছেন।
আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছে জাতির শ্রেষ্ঠ কৃতি সন্তানটিকে মরণোত্তর ‘স্বাধীনতা পদক’ বা ‘একুশে পদক’ দিয়ে সম্মান জানাতে আহবান জানাই। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসে অা’লা মাকাম দান করুন। তাঁর তিরোধানের পর দয়ালু প্রভু আমাদের মাঝে আরেকজন মামুনুর রশীদ সৃষ্টি করে দিন। আমাদেরকে তাঁর ফয়ুজাত দিয়ে মালামাল করুন। আমীন! বিহুরমাতি রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাহবিহী ওয়া সাল্লাম।
আবছার তৈয়বী
আবুধাবি, ইউ.এ.ই।