ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স : কাজের মধ্যেও বজায় রাখুন জীবনছন্দ

কখনো কি মনে হয় কাজের চাপে ডুবে যাচ্ছেন, দম নেওয়ারও সময় নেই?

আপনি একা নন! আজকের ব্যস্ত জীবনে কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের সীমারেখা অনেকের কাছেই অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। অফিসের ই-মেইল কিংবা জরুরী অনলাইন মিটিংএর লিংক রাতেও আসে, ডেডলাইনের চাপ শেষ হয় না কখনো। “এই একটা কাজ শেষ করলেই হলো” ভাবতে ভাবতে রাতই শেষ হয়ে যায়। ফলাফল? যান্ত্রিকতা, মানসিক চাপ, আর এমন একটা জীবন যেখানে কাজই সবকিছু গ্রাস করে ফেলে।

কর্মক্ষমতা ও মানসিক শান্তির জন্যে পেশাগত ও ব্যক্তিজীবন উভয় ক্ষেত্রেই একটি স্বাস্থ্যকর ভারসাম্য বজায় রাখা অপরিহার্য।

ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স কী?

ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স হলো পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পরিবার, অবসর, শখ এবং ব্যক্তিগত যত্নের জন্যে পর্যাপ্ত সময় বের করার দক্ষতা। এটি জীবনের প্রতিটি দিক বিবেচনা করে কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণে সাহায্য করে এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে যেন কাজ বা ব্যক্তিগত জীবন কোনোটাই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করে।

কেন প্রয়োজন?

শুধু ব্যক্তিগত সুখের জন্যেই নয়, শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক এবং পেশাগত সাফল্যের জন্যেও ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি কর্মজীবন এবং ব্যক্তিজীবনের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য বজায় না থাকে তাহলে ধীরে ধীরে স্ট্রেস বাড়ে, কর্মক্ষমতা ও সৃজনশীলতা কমে এবং সম্পর্কের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়। ব্যক্তিগত সময়ের অভাব পারিবারিক সম্পর্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা একাকীত্ব ও হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জীবন হয়ে ওঠে ক্লান্তিকর ও হতাশাময় এক জার্নি।

অন্যদিকে, সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখলে কাজে মনোযোগ ও উদ্যম বাড়ে, নতুন আইডিয়া আসে এবং জীবনের প্রকৃত আনন্দ উপভোগ করা সম্ভব হয়।

Randstad নামক নেদারল্যান্ডভিত্তিক একটি HR Consulting & Staffing Agency ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী একটি জরিপ পরিচালনা করে। এতে দেখা যায় ৯৪ চাকুরিজীবী বিশ্বাস করেন যে ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স গুরুত্বপূর্ণ, যার মধ্যে ৬১ ভাগই এমন কোনো চাকরি গ্রহণ করতে চান না যা তাদের ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্সে ব্যাঘাত ঘটায়।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জার্নাল Frontiers in Psychology-তে ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার ফলে কর্মদক্ষতা ও জব স্যাটিসফেকশন দুই-ই বেড়ে যায়। আর ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স না থাকলে কমে যায় কর্মীদের উৎপাদনশীলতা ও কর্মদক্ষতা।

ওয়ার্ক-লাইফ কীভাবে ব্যালেন্স করবেন?

১. সীমারেখা টানুন এবং সেটি মেনে চলুন

  • অফিসকে অফিসের জায়গায় রেখে বাসায় আসুন; অফিসের কাজ বাসায় এনে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সময়কে কমাবেন না।
  • ব্যক্তিগত সময়ে কাজের বাড়তি চাপ নিতে ‘না’ বলতে শিখুন।

২. সময় ব্যবস্থাপনাকে শক্তি বানান

  • প্রতিদিনের টু-ডু লিস্ট তৈরি করুন এবং অগ্রাধিকার ঠিক করে কাজ করুন।
  • ‘সব কাজের কাজী’ হতে যাবেন না। যতটুকু চাপ যৌক্তিকভাবে নিতে পারবেন তার চেয়ে বেশি নেবেন না।
  • মাঝে মাঝে ছোট বিরতি নিন। এতে বাড়বে মনোযোগ।

৩. বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করুন

  • কোনো কাজ আপনার একার পক্ষে কঠিন ও সময়সাপেক্ষ হলে বা ডেডলাইন অতিক্রম করতে পারে বলে মনে করলে কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে টিমওয়ার্কের সুযোগ নিন।
  • পারফেকশনিস্ট হবেন না; কাজ কতটা নিখুঁতভাবে করতে পারলেন না ভেবে, কতটা করতে পারলেন তা নিয়ে ভাবুন। কারণ কাজ সম্পন্ন হওয়া নিখুঁত হওয়ার থেকে জরুরী।

৪. ব্যক্তিগত সময়কে গুরুত্ব দিন

  • পরিবার, শখ ও বিশ্রামের জন্যে সময় বরাদ্দ রাখুন। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সময়টুকু ডিভাইস কিংবা ক্ষতিকর বিনোদনে ডুবে নষ্ট করবেন না।
  • মাঝে মাঝে পরিবার নিয়ে বেড়িয়ে আসুন। ব্যস্ততার কারণে আত্মীয়স্বজনদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ কমে গেছে আমাদের। ছুটিছাটায় এই দেখাসাক্ষাতের সুযোগ নিন।

৫. শরীর ও মনের যত্ন নিন

  • দেহমন সুস্থ না থাকলে পেশাজীবন, ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন কোনোটাই ছন্দে থাকে না। তাই দেহমন সুস্থ রাখতে করণীয়-বর্জনীয় মেনে চলুন। নিয়মিত মেডিটেশন ও ইয়োগা করুন। মেডিটেশন ও ইয়োগা শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখার পাশাপাশি স্ট্রেস ও দুশ্চিন্তা কমাবে এবং কাজের প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি করবে। আর মনোযোগ বাড়লে বাঁচবে সময়।

ড. জন কাবাত-জিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস মেডিকেল স্কুলে ১৯৭৯ সালে চালু করেন মাইন্ডফুলনেস-বেইজড স্ট্রেস রিডাকশন (MBSR) প্রোগ্রাম। তাঁর গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, মেডিটেশন চর্চাকে দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করলে তা স্ট্রেস কমাতে এবং কর্ম-জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখতে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

  • ঘুমের অভাব কর্মক্ষমতা, মনোযোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা কমিয়ে দেয়। তাই রাতে পর্যাপ্ত ঘুমান।

শেষ কথা

ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স কোনো বিলাসিতা নয়; এটি একটি সুস্থ, সুখী এবং পূর্ণাঙ্গ জীবনের জন্য অপরিহার্য বিষয়।

আসলে শুধুমাত্র ক্যারিয়ারের তুঙ্গে পৌঁছানোই সফলতা নয়। বরং কাজ এবং জীবনের মধ্যে ভারসাম্য রেখে প্রকৃত আনন্দ এবং সন্তুষ্টি অর্জনেই সার্থকতা নিহিত। যদি আপনি কাজের চাপে জীবনের মূল্যবান মুহূর্তগুলো হারিয়ে ফেলেন তাহলে সেই কাজ কতটা অর্থবহ হবে?

তাই কাজ ও জীবনের মধ্যে ছন্দ নিয়ে আসুন, আপনি হবেন সুস্থ সফল সুখী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *