গীবত : নবীজী (স) তুলনা করেছিলেন মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সাথে

গীবত : যে কাজটিকে নবীজী (স) তুলনা করেছিলেন মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সাথে

বন্ধুর ছলে কেউ যদি আপনার পিঠে ছুরি বসায়, কেমন লোক মনে করবেন তাকে? নিষ্ঠুর, ধূর্ত, দূরভিসন্ধিপূর্ণ- এমনই তো! বাস্তবতা হলো, অনেকটা এই কাজ হরহামেশাই করছি ভালো মানুষ এই আমরাও! শুনতে অদ্ভুত লাগলেও গীবতের মাধ্যমে আসলে আমরা অন্যের পিঠে ছোরা-ই বসাই!

গীবত বা পরনিন্দা এমন একটি সামাজিক ব্যাধি, যা ব্যক্তিগত পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ইসলামে তাই গীবতকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে; পবিত্র কোরআনে একে তুলনা করা হয়েছে মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণের সাথে।

গীবত কী?

গীবত আরবি শব্দ, যার অর্থ কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি আলোচনা করা। তা হতে পারে শারীরিক, বাহ্যিক বেশ ভূষায়, আচরণগত, পেশাগত বা যে-কোনো কিছুই। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, “গীবত হলো তোমার ভাইয়ের এমন দোষ আলোচনা করা, যা সে অপছন্দ করে”।

অনেকেই বলবেন, আমি আরেকজনের ব্যাপারে যা বলছি তা তো মিথ্যা না! আসলে আরেকজনের দোষত্রুটির কথা যদি সত্যি হয়ও, কথাটা তার অসাক্ষাতে বললে সেটা গীবত হবে। আর যদি কথাটি মিথ্যা হয় তাহলে সেটা হবে অপবাদ।

একদিন নবীজীর (স) সাথে আলাপচারিতার সময় হযরত আয়েশা (রা) একজন মহিলার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছিলেন, “… বেটে মহিলাটি”; নবীজী (স) তাকে সাবধান করে বললেন, “হে আয়েশা! তুমি কি জানো, যে কথাটি তুমি বললে সেটা কতটা খারাপ? এই কথাটিকে যদি সমুদ্রে ফেলা হয় তাহলে সমুদ্রের পুরো পানি কলুষিত/অপবিত্র হয়ে যাবে”।

অতএব, বুঝতেই পারছেন কত অনায়াসেই আমরা গীবত করে ফেলি!

গীবত কতটা ক্ষতিকর?

১. ধর্মীয় ও আত্মিক ক্ষতি

ধর্মে গীবতকে একটি গুরুতর পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) বলেছেন, গীবত (পরনিন্দা) ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্য। ব্যভিচারী তওবা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন। কিন্তু গীবতকারী তওবা করলেও আল্লাহ (সরাসরি) ক্ষমা করেন না। যার গীবত করা হয়েছে, সে ক্ষমা করলেই আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন।(—আবু সাঈদ খুদরী (রা), জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা); বায়হাকি, মেশকাত)।

গীবত এতটাই গর্হিত যে গীবত করলে পুনরায় নামাজ আদায় ও পরে কাজা রোজা রাখার কথা বলা হয়েছে হাদীসে।

খ্রিস্টধর্মও গসিপ ও নিন্দাকে নিরুৎসাহিত করে, এবং বিশ্বাসীদের সদয় ও সততার সাথে কথা বলার পরামর্শ দেয় (ইফিসীয় ৪:২৯)।

২. মানসিক ও আবেগিক ক্ষতি

গীবত গীবতকারীরও ক্ষতি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত গসিপিং ও নেতিবাচক কথা বলার অভ্যাস স্ট্রেস, উদ্বেগ এবং নেতিবাচক চিন্তার প্রবণতা বাড়ায়।

অন্যদিকে, গীবতের শিকার হওয়া মানুষদের এটি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রে নেতিবাচক গসিপ কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। যখন কেউ জানতে পারে যে তাকে নিয়ে কুৎসা রটানো হয়েছে, তখন তার আত্মবিশ্বাস কমে যায়, হতাশার সৃষ্টি হয়।

৩. শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি

অতিরিক্ত গীবত করার ফলে কর্টিসল নামে স্ট্রেস হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যায়। উচ্চ কর্টিসল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে, রক্তচাপ বাড়ায়, হৃদরোগের ঝুঁকি সৃষ্টি করে এবং হজমের সমস্যার কারণ হতে পারে।

খাবারের টেবিলে গীবত যেন একটু বেশিই হয়। অনেকেই যে হজমের সমস্যায় ভোগেন তার একটি কারণ খেতে খেতে গীবত করা বা শোনা।

৪. ব্যক্তিত্ব ও আত্মোন্নয়নের ক্ষতি

যিনি অন্যের গীবত করে বেড়ায় তার সামাজিক বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়। কারণ আজ যে আপনার কাছে গীবত করে, কাল হয়ত আপনার গীবত সে করবে আরেকজনের কাছে- এই বোধটুকুই যথেষ্ট মানুষের কাছে গীবতকারীর আস্থা কমাতে।

৫. সম্পর্ক ও সামাজিক জীবনের ক্ষতি

সামাজিক সম্প্রীতি নাশের জন্যে যতগুলো কারণ দায়ী তার মধ্যে তালিকার শীর্ষে থাকবে গীবত। সামাজিক অশান্তি, অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতার জন্ম দেয় এটি। আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক করে বিনষ্ট। কারণ গীবতকারী বুঝে করুক বা না বুঝে, সবসময় অন্যের সেই খারাপ দিকটির কথাই গীবতের মাধ্যমে বলা যায়, যা গীবতের শিকার ব্যক্তির জন্যে অস্বস্তিকর।

Frontiers in Psychology জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে গসিপ ও সমালোচনা টিমের মনোবল ও সহযোগিতা কমিয়ে দেয়, যাতে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়।

গীবত থেকে বাঁচার উপায়

  • কথা বলার নিজেকে প্রশ্ন করুন—”আমি কি এই কথাটি তার সামনে বলতে পারতাম? এই সমালোচনা সম্পর্কে জানতে পারলে তার কি ভালো লাগবে?” যদি উভয়ক্ষেত্রেই উত্তর আসে “না”, তবে সেটি বলা থেকে বিরত থাকুন।
  • গীবত শুনবেন না; কারণ শ্রোতা ছাড়া গীবত হয় না। কেউ গীবত শুরু করলে প্রসঙ্গ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিন। সম্ভব না হলে দ্রুত উক্ত স্থান ত্যাগ করুন।
  • প্রত্যেক মানুষের প্রতি অন্তর থেকে মমতা অনূভব করুন। ভাবুন, কেউ যদি আপনার সম্পর্কে একইভাবে কথা বলে, আপনি কেমন অনুভব করবেন।
  • ইতিবাচক সঙ্ঘে একাত্ম হোন: ইতিবাচক পরিবেশে থাকলে গীবতের প্রতি আকর্ষণ কমবে। সৎ কাজের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। ধীরে ধীরে এই ক্ষতিকর অভ্যাসের চক্র ভাঙতে শুরু করবে।
  • এই অটোসাজেশনটি চর্চা করতে পারেন: “আমি বিতর্ক এড়িয়ে চলবো। গীবত ও পরচর্চা থেকে বিরত থাকবো”, কিছুদিন পর দেখবেন গীবত শুরুর আগেই আপনার মন আপনাকে থামিয়ে দিচ্ছে।
  • নিয়মিত মেডিটেশন চর্চা করুন: ধৈর্য, মননশীলতা ও অভ্যন্তরীন নিয়ন্ত্রন বৃদ্ধির এক অব্যর্থ হাতিয়ার মেডিটেশন। নিয়মিত এর চর্চার মাধ্যমে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ বাড়বে, গীবত নামক ঘাতকের বিরুদ্ধে বর্ম গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন আপনি।

ভুলক্রমে গীবত হয়ে গেলে কী করবেন?

আগেই বলা হয়েছে, গীবতের গুনাহ আল্লাহ সরাসরি ক্ষমা করেন না। তবে ভুলক্রমে গীবত হয়ে গেলে প্রতিকার আছে-

১. যার গীবত করেছেন তার কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চেয়ে নিন ও ভবিষ্যতে পুনরায় গীবত করা থেকে বিরত থাকুন।

২. সরাসরি ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ না থাকলে কাফফারা আদায় করুন। পাপ কাজের পর তওবা কবুলের উদ্দেশ্যে আর্থিক বা শারীরিক ক্ষতিপূরণ আদায়ের নামই কাফফারা।

নবীজী (স) বলেছেন, গীবতের কাফফারা হচ্ছে যার গীবত করা হয়েছে তার মাগফেরাত কামনা—‘হে আল্লাহ! আমাকে ও তাকে ক্ষমা করো’ বলে তার জন্যে দোয়া করা।—(আনাস ইবনে মালেক (রা); বায়হাকি, মেশকাত)।

রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:  “দুনিয়ার উদাহরণ হলো এমন—যেন কোনো ব্যক্তি সমুদ্রে জাহাজে চড়ে বসে আছে। হঠাৎ জাহাজটি ডুবে গেলে সে একটি কাঠের তক্তা ধরে ফেলে। তখন সে আল্লাহর কাছে দু’আ করে: ‘হে আল্লাহ! এই তক্তাটিকে আমার জন্য পরিত্রাণের মাধ্যম বানিয়ে দাও!'(সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৬৪১২; তিরমিজি, হাদিস নং ২৩৭০)
এই হাদিসের পরেই ইমাম গাজ্জালি (রহ.) তাঁর “কিমিয়ায়ে সা’আদাত” গ্রন্থে একটি রূপক ব্যাখ্যা যোগ করেন:
“জীবন হলো সেই ‘কাঠের তক্তা’—একটি ক্ষণস্থায়ী ভেলার মতো, যা শুধু মুহূর্তের ভরসা। আর মৃত্যু হলো সমুদ্রের গভীরে তলিয়ে যাওয়া… কিন্তু সেই তক্তা (জীবন) ধরে থাকার সময় যদি তুমি নবীজি (ﷺ)-কে সালাম না দাও (অর্থাৎ তাঁর সুন্নত অনুসরণ না করো), তবে তা এমন যেন তুমি তোমার মৃত ভাইয়ের গোশত খাচ্ছ!”
১. জীবন = ক্ষণস্থায়ী ভেলা (কাঠের তক্তা)  জীবন অস্থায়ী, ভঙ্গুর ও অনিশ্চিত—যেমন সমুদ্রে ভাসা এক টুকরো কাঠ। এটি শুধু আখিরাতের প্রস্তুতির মাধ্যম মাত্র।
২. নবীজিকে সালাম = সুন্নতের অনুসরণ ,এই সংক্ষিপ্ত জীবনে রাসুল (ﷺ)-এর শিক্ষা মেনে চলা, তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানানোই প্রকৃত মুক্তির পথ।   “সালাম” এখানে আধ্যাত্মিক আনুগত্য ও আদর্শের অনুসরণের প্রতীক।
৩. মৃত্যু = সমুদ্রে ডুবে যাওয়া  মৃত্যু অবধারিত; এর পরে কোনো ফিরে আসা নেই।
৪. ভাইয়ের গোশত খাওয়া = আত্মিক মৃত্যু যদি কেউ এই জীবনে নবীজির পথ ছেড়ে দেয়, তবে তা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অধঃপতনের চরম রূপ। যেমন ভাইয়ের মাংস খাওয়া ঘনিষ্ঠতম সম্পর্কের বিশ্বাসঘাতকতা, তেমনি সুন্নত ত্যাগ করা আল্লাহ ও রাসুলের সাথে আত্মিক সম্পর্কের বিশ্বাসঘাতকতা।
শিক্ষা:জীবনকে আখিরাতের বিনিময়ের পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করুন।  নবীজি (ﷺ)-এর সুন্নতকে আঁকড়ে ধরে আধ্যাত্মিক ভেলাকে দিশা দিন। মৃত্যুকে ভয় নয়; অনুসৃত সুন্নতই পরকালে প্রক্ঠ নাজাতের মাধ্যম।
ইমাম গাজ্জালির সতর্কবার্তা:  “যে ব্যক্তি রাসুলের পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে নিজের আত্মাকে ‘আধ্যাত্মিক মৃত্যু’-র দিকে ঠেলে দেয়—যেমন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া আত্মার জন্য বিষসম!”এই রূপক আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে মহানবী (ﷺ)-এর আদর্শে রাঙানোর তাগিদ দেয় ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *