মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। এই ক্ষুদ্র জীবনে মানুষের জন্যে প্রকৃতির জন্যে বসুন্ধরার জন্যে কিছু করতে না পারলে জন্মটাই বৃথা। তাই নতুন কিছু সৃষ্টি করতে না পারলেও অন্তত যে সম্পদ পৃথিবীতে আছে, তা ধ্বংস না করে আমরা সংরক্ষণ তো করতে পারি। এজন্যে আমি সবসময় বলি, প্রত্যেক জন্মদিনে অন্তত ১০টি না হোক ৫টি হোক, তা-ও না পারলে ন্যূনতম একটি হলেও গাছ লাগান। তাহলে আপনি হয়তো একসময় থাকবেন না, কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভোগ করতে থাকবে এই ভালো কাজের ফল।
১৯ নভেম্বর ২০২২ মুক্ত আলোচনার ১১১ তম পর্বে এ কথাগুলো বলেন স্বনামধন্য ভারতীয় জীববৈচিত্র্য গবেষক, বাঁশ ও অর্কিড বিশেষজ্ঞ এবং ভারতের আসামে অবস্থিত নর্থ ইস্ট বায়োডাইভারসিটি কনজার্ভেশন এন্ড রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা ড. রহমত আলী লস্কর। এতে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট লেখক, নিসর্গবিদ, বাংলাদেশে বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষ পরিচর্যায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা উল্লেখযোগ্য সংগঠন তরুপল্লবের সাধারণ সম্পাদক জনাব মোকারম হোসেন। মুক্ত আলোচনার এ পর্বটি সঞ্চালনা করেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক ও ব্রিটেনের রয়্যাল হিস্টোরিক্যাল সোসাইটির এসোসিয়েট ফেলো জনাব মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান।
নিজের কাজ, গবেষণা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের গুরুত্ব নিয়ে মূল আলোচনায় প্রধান অতিথি ড. রহমত আলী লস্কর বলেন, আমি উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা শুরু করি ১৯৯৪ সালে। তখন আমার বয়স মাত্র ১৩ বছর। যদিও আমার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা মাত্র সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত, কিন্তু গাছের প্রতি ভালবাসা থেকেই আমি কাজ করে গেছি এবং ১২ হাজার প্রজাতির গাছের বৈজ্ঞানিক নাম, বৈশিষ্ট্য ও প্রজাতি শনাক্ত করতে পারি। তাই আমি বলব, কাজ করার জন্যে সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হয় যতটা, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন একাগ্রতা, সততা এবং কঠোর পরিশ্রম। এই তিনটি থাকলে মানুষের পক্ষে যে-কোনো অর্জনই সম্ভব।
ড. লস্কর আরো বলেন, মানুষের কর্মজীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। গড়পড়তা ৬০ বছরের জীবনে একজন মানুষ শৈশব, বার্ধক্য, ঘুম, খাওয়া ও আনুষঙ্গিক নানা কিছু বাদ দিয়ে মাত্র সাত বছর কাজ করতে পারে। তাই আমাদের কোনো সময় যেন অপচয় হয়ে না যায়। সময়কে মূল্য দিয়ে গঠনমূলক কিছু করায় রত থাকলে মানবজীবন সার্থক হবে।
সভাপতির বক্তব্যে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের শুভানুধ্যায়ী মোকারম হোসেন বলেন, আমাদের দেশে সাড়ে পাঁচ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। তার মধ্যে তিন হাজার প্রজাতিই বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তুলতে হবে। বিজ্ঞানকে কাঠখোট্টা না করে উপাদেয় করে তুলে ধরতে হবে তাদের কাছে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনকে আজকের এ আয়োজনের জন্যে ধন্যবাদ জানাই। তাদেরকে বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাই, কারণ তারা একইসাথে জীববৈচিত্র্য রক্ষার কাজ এবং মানুষকে বিকশিত করার কাজ করে যাচ্ছে।
রহমত আলী লস্কর। ১৯৮১ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভারতের আসাম রাজ্যের হোজাই জেলার বরদোলই পাথার গ্রামে তার জন্ম।
২০০২ সালে কর্মসূত্রে কাশ্মীরে থাকাকালে প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন তিনি। প্রকৃতির প্রতি তার অসামান্য ভালোলাগা ও ভালবাসা থেকে শুরু করেন বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদ সংগ্রহের কাজ। পরবর্তী ২০ বছরে সমগ্র ভারত ও অন্যান্য দেশ থেকে বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ প্রজাতি সংগ্রহ ও গবেষণাকাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন জনাব রহমত আলী লস্কর।
প্রায় চার হাজার প্রজাতির উদ্ভিদের সংগ্রহশালা নিয়ে ভারতের আসামে তিনি গড়ে তুলেন ‘নর্থ ইস্ট বায়োডাইভারসিটি কনজার্ভেশন এন্ড রিসার্চ সেন্টার’। সমগ্র ভারতে এ প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ৬৬টি শাখা। বাঁশ ও অর্কিড নিয়ে গবেষণায় তিনি অসামান্য কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে চলেছেন। এককভাবে ২৭৬ প্রজাতির বাঁশ ও ১২০০ প্রজাতির অর্কিড সংগ্রহকারী হিসেবে ২০১৭-১৮ সালে ড. রহমত আলী লস্করের নাম স্থান পায় গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও গবেষণায় স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সম্মাননায় ভূষিত হন। বাঁশ ও অর্কিড সংগ্রহ ও গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্যে ফ্রান্সের ইকোল সিপোরিয়া রবার্ত দে সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ২০১৬ সালে সম্মাননাসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। প্রায় ১২ হাজার উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য ও গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত নিয়ে তার একটি বই প্রকাশের অপেক্ষায়। উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণ ও গবেষণা ছাড়াও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কিশোর-তরুণদের নিয়মিত উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন তিনি।