মনে মনে ভাবলাম এটা আবার কী? যা-হোক ধরলাম। এরপর আবার আমাকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে ফিতা দিয়ে মাপ নেয়া হচ্ছে। তখন উচ্চতা কত ছিল ঠিক জানি না। হঠাৎ বাবার কাছে একজন মহিলা এলেন। সিস্টার বলে ডাকে তাদের। বাবা ঐ সিস্টারের কাছে দিলেন আমাকে। বাংলা তখন একটু পারি। আমার নাম জিজ্ঞেস করা হলো। এরপর বাবা বললেন, আমি একটু টয়লেটে যাচ্ছি। এই বলে কোথায় যেন গেলেন। অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি, বাবা আসছেন না। হঠাৎ মনে হলো বাবা আমাকে রেখে কোথাও চলে যাচ্ছেন। আমি যখনই একটু নাড়া দিয়ে উঠলাম ঐ সিস্টার বুঝে ফেললেন যে এবার আমি দৌড় দিব।
কিন্তু সিস্টার আমাকে ছাড়ছেন না। এমনভাবে চেপে ধরেছেন আমিও ছাড়াতে পারছি না। শেষে বাধ্য হলাম বাম হাতে কামড় দিতে। তিনি একটু হাত উঠাতেই আমি দৌড় দিলাম। সিস্টার আর আমাকে ধরতে পারলেন না। বেশ জোরেই কামড় দিয়েছিলাম তাকে!
আমাকে আশপাশ থেকে অনেকে ধরতে এল। কিন্তু ধরতে পারল না। জোরে দৌড় দিয়ে যেই গেট পার হবো এমন সময় একজন এসে সামনে থেকে আমাকে ধরে নিল। আর এমনভাবে ধরেছে যে ছাড়ার কোনো উপায় নেই। এরপর এক ভাই এল, সে আমাকে বলল, চলো। তার সাথে গেলাম। আমাকে নিয়ে সে ঘুরল কিছুক্ষণ। বলল, আবার তোমার বাবা আসবে, আশ্বাস দিল। এই ছিল কোয়ান্টামে ভর্তির সময়কার একটা অনুভূতি, যা কোনোদিন ভুলতে পারব না। ঘটনাটা ২০০৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তখন আমাদের মতো নতুন ভর্তি হওয়া শিশুদের আলাদা করে বড় ভাইদের সাথে থাকতে দিত। বড় ভাইয়েরা সবকিছুই আমাদের শিখিয়ে দিত। কোথায় কখন কী করতে হবে। ধীরে ধীরে সব নিয়মকানুন শিখে ফেলি।
খেলাধুলার নেশা ছিল ছোট থেকেই। যে-কোনো খেলাধুলার মধ্যে ঢুকে যেতাম। যখন যেখানে যে খেলা চলত তা-ই খেলতাম। খেলাধুলাও যে একটা আলাদা জগৎ সেটা যদি এখানে না আসতাম কোনোদিন বুঝতাম না। এটার মর্যাদা কী বা এটা কীভাবে জীবনের লক্ষ্য হতে পারে সেটা বুঝতাম না। ছোটকালে স্কুলে কুংফু শেখার সুযোগ হয়েছিল। এরপর কারাতে শিখি উক্যহ্লা স্যারের কাছ থেকে। সেটাও সম্ভবত তৃতীয় শ্রেণি থেকে শুরু করি। এরপর থেকে চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত চলে এই খেলা। স্যারের খুব পছন্দের ছাত্র ছিলাম আমি। এমনকি কোনো সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম হলে সেখানে আমি কারাতের কাতা প্রদর্শন করতাম।
যখন খেলাধুলার দিকে মন দিয়েছি তখন লেখাপড়ায় একটু পিছিয়ে গিয়েছি। কারণ স্পোর্টস টাইমে স্পোর্টস আর স্টাডির সময় ঘুম যেন রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ক্লাসে ঘুম আর মাঠে স্পোর্টস। এর জন্যে অবশ্য অনেক অসুবিধা পোহাতে হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির মাঝের দিকে কারাতে শেখা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর জিমন্যাস্টিক্স শুরু হয়। আমাকে সেখানে দেয়া হলো। এটার প্রতি প্রথমে আমার আগ্রহ ছিল না। তবে পরবর্তীকালে একটা ছোট্ট সাফল্য পেলে উৎসাহ বেড়ে যায়। এরপর এটা নিয়েই স্বপ্ন দেখা শুরু করি, কিছু একটা করব। লেখাপড়া দিয়ে আর কতদূর, যা শক্তি সামর্থ্য সবকিছু দিয়েছি স্পোর্টসের দিকে।
জিমন্যাস্টিক্সে এসে ইকবাল স্যারের সাথে পরিচয় হয়। তিনি প্রথম আসেন আমাদের শেখানোর জন্যে। প্রথমদিকে ভাবতাম এটা তো মেয়েদের খেলা কীভাবে ছেলেরা খেলবে! এ নিয়ে তেমন ধারণা ছিল না। স্যার এসে আমরা জুনিয়র যারা আছি তাদের বাছাই করছেন আর আমি দাঁড়িয়ে দেখছি। আমরা যারা এসেছি তারা কারাতে থেকে বের হয়েছি সবাই। স্যার বললেন যে, ছোট থেকে এই খেলা শুরু করতে হয়। আমি ভাবলাম বেশি বড় হয়ে গেছি নাকি! মাত্র তো সিক্সে পড়ি। সাইজে ছোট ছিলাম, কিন্তু বয়সে অন্যদের তুলনায় একটু বড় ছিলাম। তখন থেকে স্ট্রেচিং করানো আর সবকিছুতে নেতৃত্ব দিয়ে গেছি। এইভাবে আমাকেই সিনিয়র হিসেবে রাখে দলের মধ্যে। নিজে করার সাথে অন্যদের করানোকেও একই সাথে গুরুত্ব দিয়েছি। অর্থাৎ নেতৃত্বের গুণাবলী গড়ে উঠে আমার মাঝে।
২০১২ সালে কোরবানি ঈদের পর শুরু হয় আমাদের এই জিমন্যাস্টিক্স ইভেন্ট। ২০১৪-তে জাতীয় জিমন্যাস্টিক্স প্রতিযোগিতায় ফ্লোর এক্সারসাইজ ও প্যারালাল বার দুইটা ইভেন্টে গোল্ড মেডেল পাই। জীবনে প্রথম ন্যাশনাল পর্যায়ে অর্জন! এরপর অনেক বড় ভাই, স্যার আসেন শেখানোর জন্যে। অনেক কিছু শিখি তাদের কাছ থেকে।
প্রথমদিকে কোচ সর্বোচ্চ ১৫ দিনের বেশি থাকতেন না। তাই দায়িত্ব সব নিজে থেকে গুছিয়ে নিতে হয়েছে আমাদের। এভাবে নিয়মিত ট্রেনিং চালিয়ে যাচ্ছি। একবছর ব্যবধানে শরীরের গঠন একটু পরিবর্তন হতে শুরু করে। এটা দেখে অন্যান্য স্পোর্টস থেকে নিজেদের আলাদা করে ফেলি। তখন আমাদের পর্যাপ্ত উপকরণ ছিল না। ছোট জায়গায় প্যারালাল বার হ্যান্ডস্ট্যান্ড করতে গেলে ছাদে পা লেগে যেত। সাইজে এমনিতে ছোট আবার ছাদে পা লেগে যায়। তবুও যতটুকু সম্ভব ছিল চর্চা করে গেছি।
এর মধ্যে গুরুজী দাদু বলেন, অলিম্পিকে সোনা আমরা জিতবই। এটা তখন আরো বেশি মনে লালন করতে থাকি। ট্রেইনার ছাড়াই ট্রেনিং চালিয়ে গেছি। ট্রেনিংয়ের মাঝে কখনো ছাড় দিতাম না। যেমন নিজে করতাম, ছোট যারা ছিল তাদেরকে করাতাম। আর এখন কত বড় জিমনেসিয়াম হয়েছে কোয়ান্টামমে ভাবতেই অবাক লাগে!
মালেক স্যার নামে একজন গণিত শিক্ষক ছিলেন। তাকে আমি খুব পছন্দ করতাম। তার সাথে আমি বেশি মিশতাম। আমার পিইসি পরীক্ষায় অল্পের জন্যে এ প্লাস মিস হয়ে গিয়েছিল। তখন মালেক স্যার আমাকে বললেন, কিতং অল্পের জন্যে তুমি এ প্লাস মিস করেছ। কিন্তু তুমি পারবে।
এরপর অষ্টম শ্রেণিতে আমি প্রথম কোনো ন্যাশনাল ক্যাম্পে ডাক পাই বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিক্স ফেডারেশন থেকে। আমি সেখানে চার থেকে পাঁচ মাস ক্যাম্পিং করেছিলাম। তখন থেকে নিজেকে একজন জাতীয় পর্যায়ের প্লেয়ার মনে করতে শুরু করি।
একসময় মনে হলো, লেখাপড়া করা দরকার জীবনের জন্যে। এরপর থেকে লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগ দিলাম। ধীরে ধীরে লেখাপড়ায় এগিয়ে গেলাম। সমান তালে খেলাধুলাও চলল। এসএসসি এবং এইচএসসি শেষ করলাম। তারপর চান্স পেলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেহেতু ছবি আঁকতে পারতাম এবং ভালবাসতাম, তাই বেছে নিলাম চারুকলা বিভাগ।
এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে ভালো কিছু একটা করতে চাই যাতে মানুষের কল্যাণ হবে। এই কল্যাণ করার শিক্ষাটা আমি পেয়েছিলাম কিন্তু ঐ ছোট বয়সেই। আর জিমন্যাস্টিক্স নিয়ে স্বপ্ন তো আছেই। কারণ এটা আমার জীবনের অংশ।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]