নিজেকে নিয়ে আমরা প্রায়ই নানা নেতিবাচক কথা বলি বা ভাবি-আমি ‘ভালো ছাত্র’ না, পড়া মুখস্থ রাখতে পারি না, আমি অংকে কাঁচা বা আমার স্মরণশক্তি ভালো না।
আর ক্রমাগত শুনতে শুনতে আপনার ব্রেন এই কথাগুলোতেই প্রোগ্রামড হয়ে যায় এবং সত্যি না হওয়া সত্ত্বেও এই বাস্তবতাই সৃষ্টি করে।
এর খুব সহজ একটা উদাহরণ হলো, বৃষ্টিতে ভেজা! বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হবে, ঠান্ডা লাগবে- এ ধারণাটা অনেকেরই আছে। দেখা যায়, এক দু’ফোটা বৃষ্টির পানি গায়ে পড়লেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
অথচ ঝুম বৃষ্টিতে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী দিনের পর দিন কাজ করছেন। বৃষ্টির সাথে যদি জ্বরের সম্পর্ক থাকত, তাহলে তারা কি সেটা পারতেন? পারতেন না।
আমাদের নার্ভাস সিস্টেম কখনো ভালো-মন্দ বিচার করে না। মনের নির্দেশ বা ইচ্ছা অনুসারে সে শুধু দেহকে কাজ করার নির্দেশ দেয়। আপনি যা ভাবছেন ব্রেন মনে করছে আপনি তা চাচ্ছেন। ফলে দৈহিক অবস্থা বা পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা সেভাবেই সৃষ্টি করছে। আসলে আপনি যদি মনে করেন- ক্লাসে প্রথম হওয়ার মতো মেধাবী আপনি নন, তাহলে আপনি মস্ত এক ভ্রান্তির মধ্যে আছেন।
ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ের শিক্ষাবিষয়ক প্রফেসর হার্বার্ট ওয়ালবার্গ তার এক গবেষণায় দেখেন, সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা সবসময় টপ রেজাল্ট করতে পারে না। বরং বেশি মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরাই ভালো রেজাল্ট করে।
কারণ অতিরিক্ত মেধাবীদের মধ্যে ‘অল্প পড়ালেখা করলেই ভালো রেজাল্ট করতে পারি’ এমন মনোভাব কাজ করে। ফলে তাদের মধ্যে লেগে থাকার গুণটি সাধারণভাবে থাকে না। কখনো সখনো এক আধটু ভালো করলেও সাফল্যের ধারাবাহিকতা তাদের জীবনে দেখা যায় না।
তাই নিজেকে নিয়ে সব ধরনের হীনম্মন্যতাবোধ ঝেড়ে ফেলুন। অন্যরা বললে, তা থেকে প্রভাবিত হওয়া থেকে মুক্ত থাকুন। সবসময় নিজেকে বলুন-আমি বিশ্বাসী, আমি সাহসী। আমি পারি, আমি করব। আমার জীবন আমি গড়ব।
শেখ সাদীর একটি উক্তি আছে- ‘কবুতর কবুতরের সাথেই মেশে আর ঈগল মেশে ঈগলের সাথে।’ একটা বাঘ যদি মেষের পালের সাথে বিচরণ করে তাহলে কিছুদিন পর সে-ও নিজেকে মেষ ভাবতে শুরু করে।
আপনার বন্ধুরা যদি দুর্বলচিত্ত হয় বা রূঢ় আচরণে অভ্যস্ত হয়, লক্ষ্যহীন জীবনে ভেসে বেড়াতে থাকে, ড্রাগ, ধূমপান ও অন্যান্য বদভ্যাস বা অনাচার-অত্যাচারে লিপ্ত থাকে বা মাস্তান ও সন্ত্রাসীদের সাথে জড়িত থাকে, তাহলে এ ধরনের বন্ধুরা আপনাকে আপনার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে! তাদের সাথে থেকে আপনিও বদভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারেন।
আর আজকাল বন্ধুত্ব বা প্রেমের নামে অনলাইনে হেনস্থা বা প্রতারণা তো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার!
মনে রাখবেন- সহপাঠী মানেই ‘বন্ধু’ নয়। সুসম্পর্ক থাকবে সবার সাথে, কিন্তু বন্ধুত্ব হবে তাদের সাথেই যাদের জীবনচেতনা ও লক্ষ্যের সাথে আপনার মিল রয়েছে। মেধাবী, সহানুভূতিশীল, সুস্বাস্থ্য ও সুন্দর ব্যক্তিত্বের অধিকারীদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলুন। জ্ঞান, উদ্যম ও আনন্দ থাকবে আপনার জীবনে।
আর খেয়াল রাখুন- গ্রুপ স্টাডির নামে অহেতুক আড্ডা বা সময় নষ্টের চক্রে আপনি জড়িয়ে যাচ্ছেন কিনা।
পরীক্ষা নিয়ে, পড়ালেখা নিয়ে এমনকি জীবন নিয়েও অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই কোনো লক্ষ্য থাকে না। ফলে পরীক্ষা থেকে, পড়ালেখা থেকে এবং জীবন থেকেও তারা কিছু পায় না। সফলতার জন্যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে এ নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। ষাট বছর আগের হলেও গোল সেটিংয়ের ক্ষেত্রে এখনো এটা গণ্য হয় ক্লাসিক এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে!
গ্রাজুয়েশন ক্লাসের একদল ছাত্রছাত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়-জীবনে তোমরা যা হতে চাও বা করতে চাও তা কি কাগজে-কলমে কখনো লিখেছ তোমরা? সে লক্ষ্য কীভাবে অর্জন করতে চাও তার পরিকল্পনাও কি লিখেছ?
দেখা গেল-৮৪ ভাগ শিক্ষার্থীরই এরকম কিছু নেই। ১৩% শিক্ষার্থী লক্ষ্য লিখেছে বটে, কিন্তু সেটা অর্জনের পরিকল্পনাকে সুনির্দিষ্ট করে নি। আর ৩ ভাগ শিক্ষার্থী তাদের লক্ষ্যকে যেমন লিখেছে, তেমনি লিখেছে কীভাবে তা অর্জন করবে তার বিস্তারিত পরিকল্পনাও।
১০ বছর পর তাদের সবার অবস্থার খোঁজ নেয়া হলো। দেখা গেল- যে ১৩ ভাগ শিক্ষার্থীর লিখিত লক্ষ্য ছিল, কিন্তু বিস্তারিত পরিকল্পনা ছিল না, তারা ৮৭ ভাগের তুলনায় দুই গুণ উপার্জন করছে! তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল সেই ৩ ভাগ শিক্ষার্থী যাদের লিখিত লক্ষ্য এবং পরিকল্পনা দুটোই ছিল। তারা বাকি সবার, মানে ৯৭ ভাগের তুলনায় ১০ গুণ উপার্জন করছে।
তাই দূরপ্রসারি এবং আশু- দুয়ের জন্যেই সুস্পষ্টভাবে আপনার লক্ষ্য নির্ধারণ করুন। দূরপ্রসারি লক্ষ্য হতে পারে অনার্সে ফার্স্টক্লাস পাওয়া, বৃত্তি পাওয়া, বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া। আশু লক্ষ্য ২/৩ মাস মেয়াদী হতে পারে। এবং তা হতে হবে একেবারেই সুনির্দিষ্ট। যেমন আগামী পরীক্ষায় আমি শতকরা…. % নম্বর পাব। বা —- গ্রেড পাব।
লিখে ফেলুন। প্রতিদিন মেডিটেশনে বসার আগে একবার চোখ বুলিয়ে নিন। তারপর ধ্যানের স্তরে এ মনছবিকে দেখুন। পরিকল্পনা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আপনার কাছে আসতে থাকবে। আপনি যত একাগ্রচিত্তে মেডিটেশন করবেন মনছবির শক্তি এবং পরিকল্পনা তত শাণিত হবে, সমৃদ্ধ হবে।
অনেক শিক্ষার্থীই সারাবছর না পড়ে শুধু পরীক্ষা এলে পড়বে বলে রেখে দেয়। ফলে পরীক্ষার আগে অল্প সময়ে অনেক পড়া করতে গিয়ে না হয় ভালোভাবে পড়া, না হয় ভালো রেজাল্ট। উল্টো টেনশনে দেহ-মনের বারোটা।
মনে রাখবেন, কচ্ছপ ধীরে গেলেও তার সাফল্য নিশ্চিত। কারণ সে নিয়মিত। আর খরগোশ দু’লাফে যেতে পারলেও তার সাফল্য অনিশ্চিত। যে-কোনো অনিশ্চয়তা এসে তার পরিকল্পনাকে ভন্ডুল করে দিতে পারে! এজন্যে পড়াশোনাসহ সব কাজের একটা রুটিন করে নিন।
আর পড়ায় মনোযোগ বাড়াবার জন্যে আপনি করতে পারেন একটি বিশেষ অনুশীলন ‘মনোযোগ শূন্যায়ন’-
• একটি কাগজ ও কলম নিন। এমনভাবে বসুন বা দাঁড়ান যাতে কিছু সময় শরীর কোনোরকম নাড়াচাড়া না করে আপনি থাকতে পারেন।
• এবার লম্বা দম নিয়ে মনে মনে বলুন, আমি এখন এক বিশেষ ধরনের বৃত্ত আঁকতে যাচ্ছি। বৃত্তের কেন্দ্রে আমার কলম যাওয়ার সাথে সাথে আমার মন বাইরের সকল চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।
আমি এখন এটি পড়তে যাচ্ছি (এখানে আপনি যা পড়তে যাচ্ছেন তার উল্লেখ করবেন)। যা পড়ব তা আমার মনে পুরোপুরি গেঁথে যাবে এবং যখনই স্মরণ করতে চাইব তা মনে পড়বে এবং আমি তা বলতে ও লিখতে পারব।
এরপর এরকম একটি বৃত্ত আঁকা শুরু করুন। এমনভাবে রেখা আঁকবেন যাতে তা আগের রেখাকে স্পর্শ না করে।
এভাবে যখনই আপনার কলম কেন্দ্রে পৌঁছে যাবে, তখনই আপনি অনুভব করবেন বাইরের সকল চিন্তা থেকে সরে এসে আপনার মনোযোগ নির্দিষ্ট পাঠ্য বিষয়ে চলে আসছে।
ক্রমাগত অনুশীলন করলে এ প্রক্রিয়ায় মুহূর্তে আপনি পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পারবেন। আর আপনি মনোযোগ দিয়ে যা পড়বেন তা আপনার মনেও থাকবে খুব চমৎকার!
তবে মনোযোগ বাড়াবার সবচেয়ে কার্যকর উপায় মেডিটেশন। জার্নাল অফ সাইকোলজিতে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়- এটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডারে ভুগছে, মাধ্যমিক স্কুলের এমন কিছু ছাত্রছাত্রীকে মেডিটেশন করানো হয়। এই সমস্যাটি যাদের আছে, তারা খুব অস্থিরতায় ভোগে, কোনো একটা বিশেষ কাজে তারা মন দিতে পারে না।
কিন্তু তিনমাস প্রতিদিন দুবেলা মেডিটেশন করার পর দেখা গেল- ছাত্রছাত্রীদের এই ডিসঅর্ডার ৫০ ভাগ কমে গেছে! কমেছে মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তাও।
মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা- অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীরই বড় সমস্যা। পরীক্ষার সময় তা বেড়ে যায় কয়েক গুণ! কিন্তু পরীক্ষা নিয়ে আপনি যত টেনশন করবেন, আপনার পরীক্ষা তত খারাপ হবে। নার্ভাসনেসসহ নানা উপসর্গ দেখা দেবে। পরীক্ষার হলে গিয়ে জানা বিষয়ও ভুলে যাবেন। ভাইভা বোর্ডের সামনে উত্তর মনে আসবে না ইত্যাদি।
২০১৭ সালে ইউনিভার্সিটি অফ রোড আইল্যান্ডে ১৮-২৩ বছর বয়সী একদল শিক্ষার্থীকে তাদের ফাইনাল পরীক্ষার আগে অর্থাৎ যেসময়টা ছাত্রছাত্রীরা সবচেয়ে মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকে, সেসময় টানা ছয় সপ্তাহ ধরে দুবেলা মেডিটেশন করানো হয়।
দেখা গেল, এবারের পরীক্ষার সময় বেশ আত্মবিশ্বাসী এবং রিল্যাক্সড এবং অন্যান্যবার যে-সব শারীরিক সমস্যা হতো, তাও এবার হয় নি। আসলে নিয়মিত মেডিটেশনের প্রাথমিক লাভই হচ্ছে ব্যক্তিত্বের উন্নয়ন। মেডিটেশন চর্চা করলে নার্ভাসনেস ও যে-কোনো অহেতুক ভয়ভীতি থেকে আপনি হবেন সম্পূর্ণ মুক্ত।
তারপরও পরীক্ষার ব্যাপারে আপনি আগের রাতে পড়া শেষ করে শোয়ার আগে নিয়মমাফিক মনের বাড়িতে গিয়ে প্রত্যয়ন করতে পারেন, ‘আগামীকাল পরীক্ষা চলাকালে আমি অত্যন্ত প্রশান্ত ও সজাগ থাকব। প্রশান্ত মনে আত্মপ্রত্যয়ের সাথে প্রতিটি প্রশ্নের দ্রুত সঠিক জবাব লিখব বা বলব। আমি যা যা পড়েছি, তা হলে বসে অনায়াসে মনে করব। আমি যা পড়েছি তার প্রতিটি অক্ষর প্রয়োজনে অনায়াসে আপনাআপনিই মনে চলে আসবে এবং আমি তা সঠিকভাবে লিখব বা বলব।’
আর মনছবি দেখে কোয়ান্টাম নিয়মে পড়াশোনা করলে পরীক্ষার প্রতিটি প্রশ্নের জবাব সাথে সাথে মনে চলে আসবে। তাছাড়া পরীক্ষার আগে নিজেই বুঝতে পারবেন, পরীক্ষায় কী কী আসতে পারে, কোন কোন বিষয়ে বেশি পড়তে হবে। অবচেতন মনই আপনাকে আপনার লক্ষ্য বা মনছবির পথে পরিচালিত করবে।
জীবন থেকে এই ভুলগুলোকে সফলভাবে শুধরে নিতে আপনার প্রয়োজন সৎসঙ্ঘ। যেখানে সৎচেতনায় সঙ্ঘবদ্ধ মানুষ।
আর কোয়ান্টাম তা-ই।তিন দশক ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষকে কোয়ান্টাম দিয়েছে ইতিবাচক জীবনের দিশা। হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে ঘুরে দাঁড়ানোর বিশ্বাস! নেশামুক্তির আনন্দ, চাপমুক্তির নিঃশ্বাস, বিষণ্নতা জয়ের সুখ আর অসুস্থতা থেকে সুস্থতা!