রাজধানীর শ্যামলী এলাকার বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম কয়েকদিন ধরে জ্বরে ভুগছেন। জ্বরের সঙ্গে সর্দি-কাশিও আছে। দু’দিনের মাথায় তার স্ত্রীও জ্বরে আক্রান্ত হন। একে একে শহিদুল ইসলামের পরিবারের আরও তিন সদস্য জ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বর-সর্দি ও কাশির সঙ্গে শরীর ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয় তাদের। একপর্যায়ে করোনা পরীক্ষার করলে সবার পজিটিভ আসে।
শহিদুল ইসলাম জানান, জ্বর আসার পর তারা তেমন কোনো ওষুধ সেবন করেননি। গরম পানি দিয়ে কুলকুচি করছেন, ভিটামিন সি জাতীয় ফল খাচ্ছেন। এ ছাড়া স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ করে যাচ্ছেন। কারও শারীরিক অবস্থার কোনো অবনতি হয়নি কিংবা হাসপাতালে ভর্তিরও প্রয়োজন পড়েনি।
একইভাবে সাত দিন আগে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার একটি মেসে বসবাসকারী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ূয়া শিক্ষার্থী সাবিলা কাওসার জ্বরে আক্রান্ত হন। এর আগে তার রুমমেটের জ্বর এসেছিল। এই দুই শিক্ষার্থীর পর একে একে মেসে বসবাসকারী আরও আট শিক্ষার্থী জ্বরে আক্রান্ত হন।
সাবিলা বলেন, তাদের মেসে বসবাসকারী ১০ জনই জ্বরে আক্রান্ত হন। তিনি ও তার রুমমেট বর্তমানে সুস্থ হলেও অন্যরা সুস্থ হয়ে ওঠেননি। তারা সবাই করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছেন। এখনও রেজাল্ট হাতে পাননি। জ্বর আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে তারা সবাই বাসার বাইরে কিংবা অন্য কারও সংস্পর্শেও যাননি।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এভাবে জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। চলতি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে এটি শুরু হয়েছে। তবে গত এক সপ্তাহে তা কয়েক গুণ বেড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী অন্তত ২০টি পরিবারের এ ধরনের তথ্য রয়েছে। তাদের একজন রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকার বাসিন্দা ডা. মিজানুর রহমান। কয়েক দিন ধরে তিনি জ্বরে ভুগছেন। করোনার প্রতিষেধক টিকার বুস্টার ডোজ গ্রহণের পরদিন তিনি জ্বর আক্রান্ত হন। জ্বর আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাটি প্রথমে তিনি টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ধারণা করেছিলেন। কিন্তু তিন দিন পরও জ্বর নিয়ন্ত্রণে না আসায় করোনার নমুনা পরীক্ষা করান। এতে তার পজিটিভ আসে। বর্তমানে তিনি বাসায় আইসোলেশনে আছেন।
ঘরে ঘরে জ্বরের মধ্যেই ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত রোগী আগের দিনের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার নতুন ধরনের দাপটে সংক্রমণ বাড়ছে। এ কারণে হঠাৎ করে জ্বর, সর্দি ও কাশিতে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। তবে সংক্রমণ অনেকটাই মৃদু। তাই অধিকাংশ মানুষের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়ছে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, এক সপ্তাহ ধরে সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার খবর বেশি আসছে। সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে সর্দি-জ্বর আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। অধিকাংশ রোগী তিন থেকে চার দিন ধরে জ্বর আক্রান্ত। সঙ্গে সর্দি, কাশি, গলাব্যথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা রয়েছে। অনেকের নমুনা পরীক্ষার পর করোনার পজিটিভ আসছে। সুতরাং জ্বর হলেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্যের থেকে বাসায় পৃথক কক্ষে অবস্থান করতে হবে। একই সঙ্গে দ্রুততার সঙ্গে নমুনা পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। অন্যথায় পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মধ্যেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে।
ওমিক্রনের দাপটেই বাড়ছে সংক্রমণ: দেশে বর্তমানে সংক্রমিত রোগীর ৮০ শতাংশই রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা। গত বছরের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে রোগী বৃদ্ধির পর এ চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত চব্বিশ ঘণ্টায়ও একই চিত্র পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দেশে বর্তমানে ডেলটা ও ওমিক্রন- দুই ধরনেই সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। কোনটি সংক্রমণ বেশি ছড়াচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, সর্বশেষ গত মাসে জিনোম সিকোয়েন্স করে দেখা যায়, ডেলটা সংক্রমণ বেশি ছড়াচ্ছে। চলতি মাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে শেষ হবে। এরপর বলা যাবে, কোন ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ বেশি ছড়াচ্ছে। তবে ধারণা করা যায়, এটি ওমিক্রন। কারণ জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় ওমিক্রনের ক্লাস্টার সংক্রমণ শুরু হয়। দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সামাজিক সংক্রমণ শুরু হয়েছে। ঘরে ঘরে মানুষ জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। নমুনা পরীক্ষা করালে তারা পজিটিভ হচ্ছেন।
তিনি বলেন, ওমিক্রন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। কয়েক দিনের মধ্যে সংক্রমণ হয়তো আরও অনেক বেড়ে যাবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ওমিক্রন সংক্রমণের চিত্র দেখলে বলা যায়, এটি অধিক সংক্রমণপ্রবণ। সুতরাং সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
দেশে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর জিম্বাবুয়েফেরত নারী ক্রিকেট দলের দুই সদস্যের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হয়। এরপর ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে রোগী বাড়তে শুরু করে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ জ্যামিতিক হারে বেড়ে যায়। ৩ জানুয়ারি প্রকাশিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগের সপ্তাহের তুলনায় রোগী বেড়েছে ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ। একই সঙ্গে মৃত্যুও বৃদ্ধি পায় ৪১ দশমিক ৭ শতাংশ। ১০ জানুয়ারির রোগতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগের সপ্তাহের তুলনায় শনাক্তের হার বেড়েছে ১২৫ দশমিক ১ শতাংশ। মৃত্যু বেড়েছে ৪৭ দশমিক ১ শতাংশ।
বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভার্চুয়াল বুলেটিনে দেশে গত এক সপ্তাহে ১৬৯ শতাংশ রোগী বৃদ্ধির তথ্য জানান প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। গত বছরের ডিসেম্বরে শনাক্ত হয়েছিল চার হাজার ৫৮৮ জন রোগী। আর চলতি জানুয়ারির ১৩ দিনে ২০ হাজার ৫৮৭ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। গত ৯ দিনে প্রায় ১৪ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, সারাদেশে হাসপাতালের সাধারণ শয্যায় এক হাজারের কিছু বেশি এবং আইসিইউ শয্যায় দুইশর কাছাকাছি রোগী ভর্তি আছেন। ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ বেশি ছড়ালে আরও বেশিসংখ্যক রোগীর হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হতো। মৃত্যুও বেড়ে যেত। ওমিক্রন সংক্রমণপ্রবণ হলেও সংক্রমিতদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন খুব কম হয়। মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ রোগীর হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। সুতরাং বলা যায়, দেশে বর্তমানে সংক্রমিতদের একটি বড় অংশ ওমিক্রন সংক্রমিত। জিনোম সিকোয়েন্স করলে এটি আরও স্পষ্ট হবে।
ওমিক্রনের লক্ষণ-উপসর্গ: যুক্তরাজ্যে জো কভিড স্টাডি অ্যাপ হাজার হাজার ওমিক্রন আক্রান্তকে তাদের লক্ষণ-উপসর্গ জানাতে বলেছিল। গত ৩ থেকে ১০ ডিসেম্বর ওমিক্রন সংক্রমিত ব্যক্তিরা ওই অ্যাপে যে তথ্য দিয়েছেন তাতে দেখা যায়, ওমিক্রন আক্রান্ত হলে জ্বরের পাশাপাশি হাঁচি, কাশি, মাথাব্যথা ও ক্লান্তির মতো উপসর্গ থাকতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ওমিক্রন নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন ধরনের গবেষণা ও সংক্রমিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলো ঘেঁটে জানা যায়, ওমিক্রনের উপসর্গগুলো প্রধানত জ্বরের পাশাপাশি ঠান্ডা লাগা, সর্দি, মাথাব্যথা, গলাব্যথা, হাঁচি। এ ছাড়া ত্বকে দাগ, ঠোঁট নীল ও শরীরে চুলকানি, হঠাৎ শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা, বুকে ব্যথা অনুভব করা, শরীর ক্লান্ত লাগা, শয্যা থেকে উঠতে সমস্যা, কোমরের নিচের অংশে যন্ত্রণা, রাতে ঘুমানোর সময় ঘামতে থাকা- এসব লক্ষণ-উপসর্গ থাকলে ওমিক্রন হতে পারে। কারও শরীরে এসব লক্ষণ-উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত নমুনা পরীক্ষা করান। পজিটিভ হলে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিন।