যুগ যুগ ধরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত একটি ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে নারীকে হতে হবে নিখুঁত ও আবেদনময়ী। তা যতই অসামঞ্জস্যপূর্ণ হোক না কেন!
সৌন্দর্যের মানদণ্ড হিসেবে আমাদের সামনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে ফর্সা ত্বক, ঝকঝকে দাঁত, স্লিম ফিগার, ঢেউ খেলানো লম্বা কেশরাজি। আর হাসলে যদি গালে টোল পড়ে তাহলে তো কথাই নেই! যিনি সৌন্দর্যের এই প্রচলিত গ্রামারের মধ্যে পড়েন না, তাদের অধিকাংশই নিজেকে সুন্দরী মনে করেন না, এমনকি হীনম্মন্যতায় ভুগেন। অথচ এই হীনম্মন্যতা সুকৌশলে আমাদের সমাজে ঢুকিয়ে দেয়ার পেছনে রয়েছে একদল স্বার্থপর কুচক্রী ব্যবসায়ী দল।
বর্তমানে বাজার সয়লাব হয়ে আছে ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম, হেয়ার রিমুভাল ক্রিম, রাজ্যের মেকআপ আইটেম এবং আকর্ষণীয় মোড়কে মোড়ানো বিভিন্ন বিউটি প্রোডাক্টে যার রয়েছে নানা ক্ষতিকর প্রভাব।
অনেক কসমেটিক্সে সীসা, ক্যাডমিয়াম, জিঙ্কের মতো ভারি ধাতুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। দীর্ঘমেয়াদে এসব পণ্য ব্যবহারের ফলে ত্বক রুক্ষ হয়ে ওঠে, হারিয়ে ফেলে স্বাভাবিক কমনীয়তা এমনকি হতে পারে স্কিন ক্যান্সার!
এমনকি সমাজের প্রতিষ্ঠিত অনেক নারীও হয়েছেন হীনম্মন্যতার করাল গ্রাসের শিকার। তাদেরই একজন বলিউডের প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী সোনম কাপুর।
২০১৮ সালে তিনি তার ব্লগে লিখেছিলেন আর দশটা কিশোরীর মতো আমিও কত রাত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে থেকেছি! ১৫ বছর বয়সেও আমি জানতাম আমি কোনোদিন নায়িকাদের মতো নিখুঁত হতে পারব না। তাই যখন আমাকে একটি ছবির নায়িকা হিসেবে চূড়ান্ত করা হলো নিজেকে তারকা জগতের যোগ্য করে তুলতে কিছু অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের অনুশীলন শুরু করলাম। একের পর এক নানান ধরনের ডায়েট মেনে চলতে থাকলাম। এমনও ডায়েট করেছি যেখানে দিনভর আমাকে শুধুই আনারস খেতে হয়েছে।
টিনএইজ বয়সের সেই মানসিক ভুলগুলোর কারণে আমাকে এখন এসিডিটির মতো অসুখে ভুগতে হচ্ছে আর জীবনভর হবে।
৩১ বছর বয়সে এসে আমি আমার শরীর ও গড়নকে ভালবাসতে শুরু করি। এখন আমি স্বাভাবিক সুস্থ জীবনযাপন করছি, স্বাস্থ্যকর খাবার খাই, ঠিক মতো ঘুমাই, ভোরবেলা উঠে নিজেকে প্রাণবন্তভাবে আবিষ্কার করি। সুস্বাস্থ্যই সৌন্দর্য এটাই এখন আমার উপলব্ধি।
অর্থাৎ, সৌন্দর্য কি সুস্বাস্থ্যে নাকি রোগা শরীরে- এ দুটোর তফাৎ বুঝতে হবে নিজেকেই।
আবার, দৈহিক ক্রুটি যে কোনোভাবেই একজন মানুষের আত্মবিকাশের পথে বাধা নয় তা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন কোটি মানুষের প্রেরণা হেলেন কেলার। তার দৃষ্টি, শ্রবণ ও বাকশক্তি বিনষ্ট হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস ও প্রচেষ্টা দিয়ে তিনি বাকশক্তি পুনরুদ্ধার করে, কথা বলতে শেখেন। কলেজ থেকে ডিগ্রি লাভ করেন। লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সফল বক্তা হিসেবে সারা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ান।
দৈহিক ত্রুটির কারণে যারা হতাশ হয়ে পড়েন, তাদের সামনে হেলেন কেলার আজও প্রেরণার আলোকবর্তিকা। (কোয়ান্টাম মেথড বই)
অনেক নারী আবার আকর্ষণীয় ফিগারের জন্যে বেছে নেন জিম ও ডায়েটিং যার রয়েছে ক্ষতিকর প্রভাব।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে আপনি কতটা খাচ্ছেন তার চেয়েও কী খাচ্ছেন তা অনেক বেশি। ফ্রেঞ্চফ্রাই, চিপ্স, বিভিন্ন রকম পানীয়, মিষ্টি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার ওজন বাড়ায়। অন্যদিকে বাদাম, টক দই, তাজা ফলমূল, আঁশ-জাতীয় শাক-সব্জি এবং পূর্ণ শস্যদানা জাতীয় খাবার ওজন কমায়। মূল খাবারের কিছুটা আগে কোনো একটি ফল ও মুঠোভর্তি বাদাম খেয়ে নিলে ক্যালরি নিয়ন্ত্রণ করা যায় খুব সহজেই।
ওজন নিয়ন্ত্রণ ও সর্বোপরি সুস্থতার জন্যে ব্যায়ামের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন’-এর মতে, সপ্তাহে ১৫০ মিনিট ব্যায়াম সুস্থতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। যেমন, প্রতিদিন অন্তত ২০ মিনিট করে হাঁটা কিংবা জগিংও। আর ব্যায়ামের মধ্যে সেরা ব্যায়াম হচ্ছে কোয়ান্টাম ব্যায়াম।
এছাড়াও নিয়মিত বঙ্গাসন চর্চা শরীরের বাড়তি ওজন দূর করে, পায়ের পেশি মজবুত করে মহিলাদের জরায়ু নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুসমূহের ক্ষয় রোধ করে এবং স্বাভাবিক প্রসবের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
তাই স্রষ্টা প্রদত্ত স্বাভাবিক সুস্থ শরীরকে ভালবাসুন। নিজের চেহারা বা ফিগার নিয়ে অহেতুক হীনম্মন্যতায় না ভুগে নিজের বিশেষ দিকগুলো খুঁজে বেড়ান। স্রষ্টার অনন্য সৃষ্টি হিসেবে ভালবাসুন নিজেকে।