1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
  2. [email protected] : adminbackup :
রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ০৩:৫৪ অপরাহ্ন

পশ্চিমা ইতিহাসে বাংলা প্রবেশ করেছে বিজয়ীর বেশে

  • সময় রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
  • ১০৭ বার দেখা হয়েছে

‘পশ্চিমা ইতিহাসে বাংলা প্রবেশ করেছে বিজয়ীর বেশে’— আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান

ইতিহাস মানে শুধু রাজা-বাদশাহর বিবরণ নয়। ইতিহাসে থাকে একটি জনপদের প্রযুক্তির ইতিহাস, বাণিজ্যের ইতিহাস, যোগাযোগের ইতিহাস এবং সেখানকার পরিবেশের ইতিহাস। আড়াই হাজার বছরের পুরনো নগরী উয়ারী-বটেশ্বরে দীর্ঘ প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা করে আমরা জানতে পেরেছি, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মুদ্রানির্ভর অর্থনীতি চালু ছিল এই বাংলায়।

শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এসব নিদর্শন বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন, প্রথম শতাব্দীতে বিশ্ব জিডিপি-র নিরিখে আমাদের দেশ ছিল এক নম্বর। তবে বাঙালির ইতিহাস আজও বৈজ্ঞানিকভাবে পুরোপুরি পুননির্মাণ হয়ে ওঠে নি।

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ শনিবার কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আয়োজিত মুক্ত আলোচনার ১২৮ তম পর্বে এ কথাগুলো বলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিষদ (আইকম)-এর বাংলাদেশ জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ‘আমরা এক মহান জাতি’ বিষয়ে আলোচনার পর তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রশ্নের জবাব দেন।

উল্লেখ্য, মুক্তচিন্তার প্রসার ও শত ভাবনার বিকাশে নানা বিষয়ে ২০০৩ সাল থেকে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আয়োজন করছে মুক্ত আলোচনা কার্যক্রম।

অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান আরো বলেন, সিল্করুট এবং রোমান সাম্রাজ্যের সাথে বাংলার বাণিজ্যিক লেনদেনের প্রমাণ রয়েছে উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাপ্ত নিদর্শনে। এই দুর্গ-নগরী ছিল বাংলার প্রাচীনতম মহা জনপদের রাজধানী। পুরো ভারতবর্ষেই এমন সুপরিকল্পিত নগরীর উদাহরণ ছিল বিরল।

আমরা ছিলাম জাতিগতভাবে দক্ষ, বুদ্ধিদীপ্ত, শৈল্পিক ও পরিশ্রমী। দুর্গ-নগরী উয়ারী-বটেশ্বরে আমরা পুঁতি নির্মাণের কারখানা পেয়েছি। পাথর কেটে তৈরি এসব পুঁতি এবং তাতে আঁকা নকশাগুলোই বলে দেয় উচ্চমানের প্রযুক্তির অস্তিত্ব সম্পর্কে। কারণ পাথর কেটে পলিশ করা এবং বিভিন্ন আকৃতির পুঁতি তৈরি করা সহজ বিষয় নয়। পৃথিবীর অল্প কিছু জায়গায় এগুলোর সন্ধান মিলেছে। তার মধ্যে উয়ারী-বটেশ্বর একটি।

বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে রঙের ইতিহাস পাল যুগ থেকে অর্থাৎ ৭ম শতাব্দীতে। কিন্তু উয়ারী-বটেশ্বরে আড়াই হাজার বছর আগে পেইন্টিংয়ের চিহ্ন আমরা খুঁজে পেয়েছি এসব পুঁতির মধ্যে। সেখানে পাওয়া এমুলেট বা বাজুবন্ধ গুলো চন্দ্রাকৃতির বা মুন শেপড—কোনোটি ক্রিসেন্ট মুন, কোনোটি ফুল মুন। তার মানে চাঁদ সম্পর্কেও তাদের জ্ঞান ছিল। অর্থাৎ তখনকার সময় মানুষেরা দর্শনচর্চাও করতেন।

প্রাক-মৌর্য যুগে অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ সালে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণেরও অন্তত তিনশ বছর আগে এখানে সমৃদ্ধ জনবসতি ছিল। রোমান ইতিহাসবিদ টলেমির বর্ণিত গঙ্গারিডাই জাতি বর্তমান বাংলাদেশেই বসবাস করত। সামরিকভাবে তারা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারও গঙ্গারিডাইদের সাথে যুদ্ধ করার সাহস করেন নি। মার্কিন ইতিহাসবিদ জেমস জে. নোভাক তার বইতে (১৯৯৩) এই ঘটনার উল্লেখ করে লিখেছেন, পশ্চিমা ইতিহাসে বাংলা প্রবেশ করেছে বিজয়ীর বেশে।

প্রশ্নোত্তর পর্বে ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করার জন্যে এসব প্রত্নসম্পদের ওপর আরো গবেষণার প্রয়োজন। মুন্সীগঞ্জ জেলার নাটেশ্বরে খননকাজ চলছে। হাজার বছর আগে এখানে একটি উন্নত নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ স্থাপনা ছিল এটি। নাটেশ্বরে আর্কিওলজিক্যাল পার্ক নির্মাণের কাজ শেষ হলে এটি হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্থান। এই গবেষণার কাজে বাংলাদেশি গবেষকরাই কাজ করছেন।

অনেকে প্রশ্ন করেন, খনন কাজ কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। বিদেশি সাহায্য ছাড়া এ কাজগুলো কীভাবে করেন? আমি মনে করি—বিদেশি যন্ত্রপাতি ভালো। কিন্তু বিদেশি ছাড়া যে আমরা কিছু করত পারব না, এ ধারণা ঠিক নয়। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন যে সমাজের জন্যে এত রকম কাজ করছে, এই প্রতিষ্ঠান কি বিদেশিরা তৈরি করেছে? আর ‘আমরা এক মহান জাতি’ এই কথাটি যদি আমরা নিজেরা বিশ্বাস করি এবং তুলে ধরতে পারি, তাহলেই বাংলার ইতিহাস গবেষণা ও প্রচারের কাজ অনেকখানি এগিয়ে যাবে।

প্রতিকূলতা কাটিয়ে অক্লান্ত কাজ করে যাওয়ার ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা কী?—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার কাজে নানারকম পরিস্থিতির সম্মুখীন আমাদের হতে হয়। একসময় আমি হয়তো থাকব না, কিন্তু পৃথিবীর বুকে কাজটা থেকে যাবে–এজন্যে আমার কাজ আমি করে যাই–আর সত্য হলো, কাজের আনন্দ অন্যরকম। একবার এ আনন্দটা মানুষ পেয়ে গেলে অন্য কিছুই তাকে আর দমাতে পারে না।

অতিথির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :

অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান

সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের জন্ম ১৯৬৪ সালের ২২ এপ্রিল, কুড়িগ্রামে। ১৯৮৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক ও ১৯৮৭ সালে প্রত্নতত্ত্বে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। পরবর্তীতে ভারতের পুনে-তে অবস্থিত ডেকান কলেজ পোস্ট গ্রাজুয়েট এন্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট থেকে ১৯৯৯ সালে তিনি পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তার পিএইচডি-থিসিসের বিষয় ছিল তৎকালীন পুণ্ড্রনগর-এর কেন্দ্রভূমি ‘বগুড়া জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান’। এরপর ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব আর্কিওলজি থেকে ২০০১ সালে চার্লস ওয়েলস ভিজিটিং ফেলো হিসেবে তিনি পোস্ট ডক্টরেট সম্পন্ন করেন।

১৯৯২ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৪ সাল থেকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপক পদে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯৬ সাল থেকে বর্তমান নরসিংদী জেলাধীন উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান এবং ২০০০ সাল থেকে এর খনন কাজ পরিচালনা করেন তিনি।

সুফি মোস্তাফিজুর রহমান আত্মপরিচয়ের ঐতিহ্য অনুসন্ধানে উদ্যমী ও পরিশ্রমী একজন গবেষক। দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও দেশবাসীর মননে ঐতিহ্য-সচেতনতা সৃষ্টিতে বরাবরই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছেন তিনি। দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাকেন্দ্র ‘ঐতিহ্য অন্বেষণ’-এর প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।

প্রাচীন দুর্গ-নগরী ‘উয়ারী-বটেশ্বর’-এর প্রধান গবেষক হওয়ার পাশাপাশি ২০১৭ সালে তিনি ঢাকা পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালনা করেন। তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিক্রমপুরের রঘুরামপুর ও নাটেশ্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালনা। এ-ছাড়াও নরসিংদীতে গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘর, বৌদ্ধ মন্দির প্রত্নস্থান জাদুঘর, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন জাদুঘর, দেশের প্রথম প্রত্নস্থান জাদুঘর বৌদ্ধ পদ্ম-মন্দির এবং বিক্রমপুরী প্রত্নস্থান জাদুঘর ও বিক্রমপুর জাদুঘরের প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান।

খ্যাতনামা প্রত্নতাত্ত্বিক পরিচয়ের পাশাপাশি তিনি প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখছেন। দেশ-বিদেশে তার গবেষণাপত্রের সংখ্যা ৫০টিরও বেশি। তার প্রথম গ্রন্থ ‘আর্কিওলজিক্যাল ইনভেস্টিগেশন ইন বগুড়া ডিস্ট্রিক্ট’ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে।

২০০৭ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘আর্কিওলজিক্যাল হেরিটেজ’ ও ‘প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য’ বই দুটির সম্পাদক তিনি। দেশের আরেকজন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ পাঠানের সাথে যৌথ উদ্যোগে ২০১২ সালে তিনি রচনা করেন ‘উয়ারী-বটেশ্বর শেকড়ের সন্ধানে’, যা পাঠক মহলে বিশেষভাবে সমাদৃত হয় এবং আইএফআইসি প্রথম আলো বর্ষসেরা বই-এর সম্মান অর্জন করে।

এ বইটির জন্যে তিনি বাংলা একাডেমি কর্তৃক চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত হন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে প্রকাশ পায় বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক গবেষণা, প্রবন্ধ ও পরিসংখ্যান বিষয়ক বই ‘বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার। এ বইয়ের জন্যে শহীদ মুনীর চৌধুরী পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। ২০১৯ সালে চায়নাতে প্রকাশিত ‘নাটেশ্বর : এন ইনটেরিম এক্সকেভ্যাশেন রিপোর্ট অব দ্য বিক্রমপুর এনসিয়েন্ট সিটি ইন পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’-এর সহ-লেখক তিনি।

দেশজুড়ে প্রত্নতত্ত্বে গবেষণার ফলে তিনি নানাবিধ সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে মিলেছে বিশেষ নিদর্শন ও প্রাচীন দুর্গের অস্তিত্ব, যার প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে পাওয়া গেছে চমকে যাওয়ার মতো তথ্য আর তা হলো—ঢাকা নগরের বয়স আড়াই হাজার বছরের বেশি! এ খনন কাজ ও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় সার্বিক তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান।

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All Rights Reserved © rmgbdnews24.com