ফাস্টফুড বলতেই সবার আগে যে খাবারটি মনের চোখে ভেসে ওঠে, সেটি বার্গার।
প্রতিদিন বেশ মজা করে বার্গার কিংবা মাংসের কিমা দিয়ে তৈরি মজাদার ফাস্টফুড খাচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু বার্গারের মাঝখানে থাকা ‘নির্দোষ’ মাংসের চপটিতে যদি গবাদি পশুর কিছু কাঁচা বিষ্ঠাও থাকে, তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শুনুন তাহলে-
আমেরিকার সবচেয়ে নামী ব্র্যান্ডের ফাস্টফুডের কথাই ধরা যাক। সেখানে একটি বিফ বার্গারে যে মাংসের কিমা থাকে, তা কমপক্ষে এক ডজন গরু এবং কখনো কখনো শ-খানেক গরুর মেশানো মাংস থেকে বানানো। এসব গরু আবার একাধিক দেশ থেকে সংগৃহীত। এই কিমার সামান্য কণামাত্রও যদি ‘ই কলাই’ জীবাণু দ্বারা দূষিত হয় তাহলে আপনি অসুস্থ তো হবেনই, তা আপনার মৃত্যুরও কারণ হতে পারে।
‘ই কলাই’ হলো রোগ-সৃষ্টিকারী মারাত্মক একটি জীবাণু। যুক্তরাষ্ট্রে এটি ছড়ানোর প্রধান উৎস তাদের বড় বড় কসাইখানাগুলো, যেখানে শ্রমিকেরা যান্ত্রিক ছুরি ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতির মাধ্যমে পশু জবাই থেকে শুরু করে মাংস প্যাকেট করার কাজগুলো করে থাকে। আর মাংস প্রক্রিয়াজাত করার সময় এর সাথে মিশে যায় গবাদি পশুর বর্জ্যে বা গোবরে থাকা জীবাণুও।
যে গবাদি পশুর মাংস থেকে কিমা বানানো হচ্ছে, তারা কী খায় জানেন? ইউরোপ-আমেরিকাতে গবাদি পশু মাত্রই অন্য মৃত পশুর (শূকর কুকুর বেড়াল ইত্যাদি) প্রক্রিয়াজাত বর্জ্য ও অন্যান্য পশুভিত্তিক উপদ্রব্য (বাই প্রোডাক্ট) খেয়ে বাঁচে। এ-ছাড়া করাতগুঁড়ো ও পুরনো কাগজের মণ্ডও এদের খেতে দেয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, ১৯৯৭ সালের আগপর্যন্ত সে দেশে সরাসরি মৃত গবাদি পশুই খেতে দেয়া হতো নিয়মিতভাবে।
বৃটেনে এ কারণেই ‘ম্যাড কাউ ডিজিজ’ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে পশুখাদ্য হিসেবে মৃত গবাদি খাওয়ানো নিষিদ্ধ হয়। তারপরও ওখানকার বড় বড় কসাইখানাগুলোতে যত গবাদি পশু দৈনিক জবাই করা হচ্ছে, তার অনেকগুলোই হাম ও ফিতাকৃমি রোগে আক্রান্ত।
আর যে বিশাল মিশ্রণযন্ত্রে এসব মাংস পেষণ করা হয়, তাতে হরহামেশাই মাংসের সঙ্গে পোকামাকড়, আবর্জনা, মানুষের ঘাম এমনকি কখনো কখনো বমি পর্যন্ত গুলে একসঙ্গে বেরিয়ে আসে!
কোনো হরর সিনেমার চিত্রনাট্য নয় কিন্তু এগুলো। রীতিমতো ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত সত্য। মার্কিন সাংবাদিক এরিক শ্লোজার টানা তিন বছর গবেষণা ও অনুসন্ধান চালিয়ে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ লিখেছেন-‘ফাস্টফুড নেশন’। ২০০২ সালে প্রকাশিত এ বইটিতে তিনি এসব তথ্য তাবৎ সূত্রসহ সবিস্তারে তুলে ধরেছেন, যা সবার সামনে উন্মোচন করে দিয়েছে আমেরিকার খাদ্যব্যবসার এক আশ্চর্য অন্ধকার দিক।
যুক্তরাষ্ট্রের ডজনখানেক কসাইখানা ঘুরে শ্লোজারের অভিমত হলো, গবাদি পশু জবাইয়ের পর তার চামড়া ছাড়ানো হয় যন্ত্র দিয়ে, কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই সে চামড়া নিখুঁতভাবে ছাড়ানো হয় না বলে কিমার জন্যে প্রস্তুতকৃত মাংসের ভেতর চামড়া, কাদামাটি ও কাঁচা বিষ্ঠা (!) নিয়মিতভাবেই ঢুকে পড়ে। আর পশুর পেট ও নাড়িভুঁড়ি পরিষ্কার করা হয় হাত দিয়ে।
মজার ব্যাপার হলো, যেসব শ্রমিক এসব কসাইখানায় কাজ করে তাদের অধিকাংশই অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত অতি নিম্ন বেতনভোগী ইমিগ্র্যান্ট। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বালাই তাদের অধিকাংশেরই নেই। হাত দিয়ে ছাড়াতে গিয়ে তারা অনেক সময়ই পশুর নাড়িভুঁড়ি এবং বিষ্ঠা মাংসের সঙ্গে গ্রাইন্ডারে ছুঁড়ে দেয়। কারণ, প্রত্যেক শ্রমিককেই অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ঘণ্টায় গড়ে ৬০টি পশুর মাংস কেটেছেঁটে গ্রাইন্ডারে ফেলতে হয়। এসময় মাংসের সঙ্গে আর কী কী ঢুকে পড়ছে, তার হিসাব রাখছে কে?
শ্লোজারের হিসাবে, যদি শুধু একটি মাত্র পশু থেকে দূষিত পদার্থ গ্রাইন্ডারে ঢুকে পড়ে, তাতেও বিপুল পরিমাণ কিমা দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দলাইমলাই হয়ে সেই মাংস যখন বার্গারের কিমা হয়ে দোকানে হাজির হয়, তখন এর কোনটা দূষিত আর কোনটা স্বাভাবিক, সেটি বোঝার ক্ষমতা ওই শ্রমিকেরও নেই। কারণ, ততক্ষণে ওই বস্তুটি উচ্চ তাপে ভাজা (ডিপ ফ্রাই) ও সুগন্ধি ফ্লেভার দ্বারা ‘ধন্য’ হওয়ার মতো বেশ কয়েকটি পর্ব পেরিয়ে এসেছে। তখন এর ভেতরে ‘অন্যরকম কিছু’-র অস্তিত্ব টের পাওয়ার সাধ্য আছে কার?
আমেরিকাতে বড় আকারের একেকটি মিট প্রসেসিং প্ল্যান্টে দৈনিক কমপক্ষে আট লাখ পাউন্ড কিমা তৈরি হয়। যদি একটি ‘ই কলাই’ জীবাণু আক্রান্ত পশুর মাংসও সেই কিমায় থাকে, তাহলে এর দ্বারা অন্ততপক্ষে ৩২ হাজার পাউন্ড কিমা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, হ্যামবার্গার কিংবা মাংস দিয়ে তৈরি ফাস্টফুড খেয়ে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার প্রধানতম কারণ হলো মাংসে লেগে থাকা জীবাণুবাহী গোবর বা বর্জ্য, যাতে থাকে এই ‘ই কলাই’ নামক জীবাণুটি। এটি ছাড়াও গত দুই দশকে চিকিৎসকরা আরো প্রায় ডজনখানেক খাদ্যবাহিত জীবাণুর সন্ধান পেয়েছেন। সিডিসি অনুমান করছে, তিন-চতুর্থাংশ খাদ্যবাহিত বা খাদ্য-সংশ্লিষ্ট অসুস্থতা ও মৃত্যুর কারণই হচ্ছে এসব সংক্রামক জীবাণু, যেগুলোকে এখনো পুরোপুরি চিহ্নিত করা যায় নি।
বিপদটা যে শুধু ফাস্টফুড-শপে বার্গার খেতে গিয়েই ঘটতে পারে, তা নয়। কেতাদুরস্ত সুপার মার্কেট থেকে সুদৃশ্য প্যাকেটে মোড়া গরু বা মুরগির কিমা ঘরে আনলেও ঘটতে পারে একই বিপদ। দুটোই দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা সমান। আর এসব দূষিত খাবার খেয়ে আমেরিকায় প্রতিদিন দুই লাখেরও বেশি মানুষ রোগগ্রস্ত হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে নয় হাজার রোগী। এদের মধ্যে দৈনিক মারা যাচ্ছে ১৪ জন। যারা অসুস্থ হচ্ছে বা মারা যাচ্ছে তাদের একটা বড় অংশ হচ্ছে স্কুলের ছাত্রছাত্রী অর্থাৎ শিশু-কিশোর।
ফাস্টফুড নিয়ে এমন আশ্চর্য সব খবর আর এর পরিণতি জানা সত্ত্বেও আমেরিকায় সরকারিভাবে তা নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। কিংবা বলা যেতে পারে, নেয়া যাচ্ছে না। কেননা, আমেরিকাতে ফাস্টফুড ইন্ডাস্ট্রি এখন এক বিশাল সাম্রাজ্য। মোট এক ডজন বহুজাতিক কর্পোরেশন এ সাম্রাজ্যের নেপথ্য নিয়ন্ত্রক। আসল খবর হলো, এ শিল্পের সাথে নানাভাবে অতি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ (নাকি স্বার্থযোগ?) রয়েছে সে দেশের রাজনৈতিক ও সরকারি ব্যবস্থাপনার। এ যেন ফাস্টফুড সাম্রাজ্যবাদ!
এসব কিন্তু আমেরিকার নামীদামী ব্র্যান্ডের ফাস্টফুডের কেচ্ছাকাহিনী, তা-ও কেবল এখন পর্যন্ত যেটুকু জানা গেছে। এর বাইরে যে আরো কী ঘটে চলেছে, তাই-বা কে জানে! খোদ আমেরিকার মতো দেশ-যেখানে সবকিছুর মান নিয়ন্ত্রণে এত কড়াকড়ি আর বিধিনিষেধ- সেখানেই যদি ঘটে চলে এমনতর সব কাণ্ডকীর্তি, তখন আমাদের দেশে কী হচ্ছে… থাক্।
আর এর সাথে ইদানীং যুক্ত হয়েছে কিছু বহুজাতিক চেইন ফাস্টফুড রেস্টুরেন্টের মনোহরী চিত্তজয়ী বিজ্ঞাপন। যেমন, আমাদের তৈরি সুস্বাদু খাবারে ব্যবহার করা হয়েছে কিছু ‘হিডেন স্পাইসেস’। অর্থাৎ গোপন মশলাপাতি। কিন্তু কেন এ গোপনীয়তা? ওসবের নাম জানলে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে আপনি খাবারগুলো না-ও খেতে পারেন, তাই? এ কারণেই কি এমন নাটকীয় প্রলোভন?
বার্গারের আছে আরো বিস্ময়কর ‘গুণ’। বোস্টনের প্রখ্যাত ডানা-ফার্বার ক্যান্সার গবেষণা কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের অন্যতম সহযোগী প্রতিষ্ঠান। গত দশকের শুরুর দিকে দীর্ঘ গবেষণার পর তারা মানবদেহে একটি আণবিক উপাদানের সন্ধান পান। পিজিসি-১ বিটা। লিভারে সংঘটিত শরীরের স্বাভাবিক বিপাকক্রিয়ায় এর ভূমিকা রয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগের কথা হলো, এটি বার্গারের ফ্যাটকে সরাসরি ধমনীতে ব্লকেজ সৃষ্টি করতে বিশেষভাবে উদ্দীপ্ত করে।
গবেষকরা দেখেছেন, যখন মাংস ও ডেইরি প্রোডাক্টসহ বিভিন্ন খাদ্যের স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাট লিভারে হাজির হয় তখন পিজিসি-১ বিটা এক ধরনের বায়োকেমিক্যাল সংকেতের প্রবাহ সৃষ্টি করে চলে, যা লিভারকে এলডিএল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড উৎপন্ন করতে প্ররোচিত করে। উল্লেখ্য, এ দুটো উপাদানের মাত্রাধিক্য ধমনীতে ব্লকেজ সৃষ্টি করে, যা পরবর্তীতে হার্ট অ্যাটাকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
গবেষকদের মতে, বার্গারের মতো অন্যান্য যেসব খাবারে স্যাচুরেটেড এবং ট্রান্স ফ্যাট আছে সেসব খাবার খেলেও রক্তে এলডিএলের মাত্রা বাড়বেই। আর ফাস্টফুড বলতে আমরা যা বুঝি তার সবকটিতেই স্যাচুরেটেড এবং ট্রান্স ফ্যাটের অস্তিত্ব আছে বেশ ভালো রকমেই।