উপলক্ষ- বিজয় দিবস। এই উপলক্ষ প্রতিবছর আসে ঠিকই। তবে এবারে আনন্দটা যেন একটু বেশি-ই! কারণ এবারের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। আজ থেকে ৫০ বছর আগে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর আমরা মুক্তিলাভ করেছিলাম পরাধীনতার নিগড় থেকে। সেদিন থেকেই যাত্রা শুরু হয়েছিল এক সোনার বাংলা বিনির্মাণের।
বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে বিশ্বের সেরা দশ সমৃদ্ধ জাতির একটিতে- কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলাকে কোয়ান্টাম এভাবেই অবলোকন করেছিল ‘মনছবি ২০২৫’-এ।
এরপর একে একে কেটে গেছে ২৮ বছর। মনছবির পূরণের অভিযাত্রায় কতটা এগোলো প্রিয় স্বদেশ?
সবচেয়ে গরিব মানুষটিরও রয়েছে ৩ বেডরুমের বাড়ি, এয়ার কন্ডিশনড গাড়ি। যানজটমুক্ত সড়ক। বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার। কম্পিউটারাইজড নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আর রাস্তার গাড়ি- সবই বাংলাদেশে তৈরি।
সকল মজা খাল-বিল-নদী পুনরুদ্ধার, নদীশাসন ব্যবস্থায় বিশাল বিশাল জলাশয় মাছে পরিপূর্ণ ও গ্রাম-গঞ্জ-শহর পাখির কলকাকলিতে মুখরিত। বন্যামুক্ত দিগন্তবিস্তৃত ভূমি পরিপূর্ণ শস্যে। দেশে দান ও যাকাত গ্রহণ করার মতো কোনো মানুষ নেই।
বারো মাসে আবারো হচ্ছে তেরো পার্বণ। সারা পৃথিবী থেকে ছাত্র ও গবেষকরা আসছেন বাংলায় উচ্চতর গবেষণার জন্যে। বাংলাদেশের কোচরা ইউরোপ-আমেরিকায় যাচ্ছেন খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দিতে। বিশ্বসংস্কৃতির কেন্দ্রভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছে ঢাকা।
এক মানবিক মহাসমাজ। প্রত্যেকের অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান নিশ্চিত। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-অঞ্চল নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের স্বাধীন আত্মবিকাশের অধিকার সুরক্ষিত।
উন্নয়নের চিরায়ত ধারণা, বিশেষজ্ঞদের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, আরোপিত কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ—কোনো প্রতিকূলতাই পারছে না এই অগ্রযাত্রাকে রুখতে। আর এই অভিযাত্রাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে কোয়ান্টাম!
১ জানুয়ারি, ২০২২ কোয়ান্টাম শুরু করতে চলেছে ৩০ তম বছরের পথচলা। আত্মশুদ্ধির পাশাপাশি সেবা, সমমর্মিতা ও দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৯৩-এ সূচনা ঘটেছিল যে সঙ্ঘবদ্ধ উদ্যোগের, তিন দশকের কালপরিক্রমায় জাতীয় জীবনে তা হয়ে উঠেছে আস্থা ও কল্যাণের প্রতীক।
বেঁচে থাকতে চাই আশা, টিকে থাকতে চাই আশা। আশা চাই সমৃদ্ধি অর্জনেও! অথচ কোয়ান্টাম যখন জাতীয় সমৃদ্ধির মনছবি করলো তখন কথোপকথন, সংবাদপত্র কিংবা বিশ্লেষণী কলাম- কোথাও ভুল করেও উচ্চারিত হতো না দেশ নিয়ে কোনো আশাবাদ।
অবস্থা বদলেছে! মানুষ আশাবাদী হয়েছে; ফলাফলও এসেছে হাতেনাতে! এসেছে জাতীয় সমৃদ্ধি; কোয়ান্টামের তিন দশকের মনছবির অনেক কিছুই এখন বাস্তব!
বহু সূচকেই বাংলাদেশ ইতোমধ্যে প্রবেশ করেছে শীর্ষ দশে। বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রনেতা, অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক, বিশ্লেষকেরাও এখন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ।
হাঁটি হাঁটি পায়ে কীভাবে এগিয়ে যেতে হয়, পেছন থেকে সামনের সারিতে আসতে হয় তার রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। স্রষ্টার নেয়ামত এই দেশের মাটির প্রতিটি কণায়।
মুক্তিযুদ্ধকালে তদানীন্তন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বিধ্বস্ত এই দেশকে অভিহিত করেছিলেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। ১৯৭৪-৭৫ সালে বিশ্বের শীর্ষ দুই উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ তাচ্ছিল্যভরে বলেছিলেন, “বাংলাদেশ যদি অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করতে পারে তাহলে দুনিয়ার যে-কোনো দেশই উন্নত হতে পারবে।”
বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, “বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় প্রতিবছর যদি ২ শতাংশ হারে বাড়ে তবুও মানসম্পন্ন মাথাপিছু আয়ের তালিকায় যেতে বাংলাদেশের ১২৫ বছর লাগবে। ৩ শতাংশ হারে বাড়লে লাগবে ৯০ বছর!”
স্বাধীনতার ৪৪ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে মধ্যম আয়ের দেশে। পৃথিবীর ৪১ তম আর এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১৩ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ এখন বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের মতে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে। আর বিশেষজ্ঞদের আশাবাদ হচ্ছে, ২০৩২ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ উঠে আসবে ২৪ তম স্থানে।
দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে করোনা অতিমারির ধাক্কা কিছুটা লাগলেও তা সামলে নিতে দেরি হয় নি। করোনার প্রভাবে যেখানে ধনী-গরিব সব দেশেরই কোটি কোটি মানুষ উপার্জন হারিয়েছে, অধিকাংশ দেশের জিডিপি কমে গেছে, সেখানে বেড়েছে বাংলাদেশের জিডিপি।
করোনায় শত প্রতিকূলতার মধ্যেও জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ২০২০-এ বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৩য়!
এবং ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হচ্ছে আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি অবজ্ঞা করত যে পাকিস্তান, তাদের দেশেই বাংলাদেশের সাথে তুলনা শুরু হয়ে গেছে!
কিছুদিন আগে তাদের একজন বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের তুলনা করে বলেন, পিটিআই (পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দল) যদি সবকিছু ঠিকঠাক করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের পর্যায়ে যেতেই আরো ১০ বছর লাগবে!
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর ইমরান খান পাকিস্তানকে সুইজারল্যান্ড বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন-এ বিষয়ে তিনি বলেন, সুইজারল্যান্ড লাগবে না! আমাদের বাংলাদেশ বানিয়ে দাও, তাতেই আমরা খুশি হব!
এই শতাব্দীর শুরুর দিকেও দেশের বেশিরভাগ পরিবারে বড় মাছ জুটত কদাচিৎ। মুরগী ছিল ঈদ বা বিয়ের মতো ধর্মীয়-সামাজিক উৎসবের খাবার। আর এখন সপ্তাহে অন্তত একদিন মুরগী খায় না- এমন পরিবার বিরল!
আপেল, কমলা, আঙুর, নাশপাতি, খেজুরের মতো আমদানি করা যে ফলগুলো জুটত কালেভদ্রে, সেগুলো এখন শহরের রাস্তায়, ফুটপাতে বা গলিতে গলিতে বিক্রি হয় কার্টে (ভ্যানে)!
বেশিরভাগ পরিবারে নতুন কাপড়-চোপড় পাওয়া যেত কেবল দুই ঈদের একটিতে বা পূজা-ক্রিসমাসে। একটু বড় হওয়ায় গায়ে লাগছে না বলে বড় ভাই বা বোন যে পোষাকটি আর পড়তে পারত না সেটাই পড়ত ছোট ভাই বা বোন। অথচ এখন বছরের যে-কোনো সময়েই নতুন পোষাক পাওয়াটা আর নতুন নেই!
কেবল ঈদেই নয়, সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেও নামীদামী শপিং মলগুলোতে উপচেপড়া ভিড় দেখে বোঝা যায় কতটা বেড়েছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা।
৭০’র দশকে বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, বিপুল জনসংখ্যার ভারে খাদ্যসংকটে পড়বে বাংলাদেশ। কিন্তু আজকের দিনে বাস্তবতা হচ্ছে, আয়তনে পৃথিবীর ৯৪ তম দেশ হওয়া সত্ত্বেও খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান এখন ১০ম।
ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। গত একযুগে দ্বিগুণ হয়েছে মানুষের মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণ।
ধানের ফলন বাড়িয়েও, ফল-শাকসবজির ফলনের রেকর্ড করেও, মিঠাপানির মাছ চাষে বিস্ময়কর সাফল্য লাভ করার পরও বাংলাদেশ নিজস্ব উৎপাদন থেকেই কোরবানির পশুর বিশাল চাহিদা মেটাতে পারছে।
১ম | ইলিশ উৎপাদন |
পাট রপ্তানি | |
২য় | পাট উৎপাদন |
তৈরি পোষাক রপ্তানি | |
কাঁঠাল উৎপাদন | |
৩য় | চাল উৎপাদন |
সবজি উৎপাদন | |
স্বাদুপানির মাছ উৎপাদন | |
৪র্থ | ছাগল উৎপাদন |
৭ম | প্রবাসী আয় |
আম উৎপাদন | |
আলু উৎপাদন | |
৮ম | ফ্রিল্যান্সিং |
বাইসাইকেল রপ্তানি | |
পেয়ারা উৎপাদন | |
১০ম | মৌসুমি ফল উৎপাদন |
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী অ্যাপ্লাইড অপটিকস-এর মতে, গত অর্ধশতাব্দীতে বিশ্বে বিজ্ঞান গবেষণায় সর্বোচ্চ অবদান রাখা ৫০ জন বিজ্ঞানীর একজন ড. আতাউল করিম।
জার্মানি ও চীন উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে ম্যাগলেভ বা উড়ন্ত ট্রেনের জন্যে মাইলপ্রতি ব্যয় ছিল ১২০ মিলিয়ন ডলার। ড. করিমের উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে যা মাত্র ১১ মিলিয়ন ডলার!
দেশে বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার হচ্ছে- কোয়ান্টামের ১৯৯৫ সালের মনছবি সময়টাতে ফ্লাইওভারের কোনো চিহ্ন আমাদের দেশে ছিল না। কিন্তু এখন রাজধানী ও দেশের অন্যান্য বড় বড় শহরগুলো ছাড়াও ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে দক্ষিণবঙ্গের সড়কগুলোতে অনেকগুলো ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে এবং নির্মাণাধীন রয়েছে।
পঞ্চায়েত প্রধানের সামনে থাকবে কম্পিউটার- পঞ্চায়েত প্রধান তো বটেই এখন প্রত্যেকের হাতে হাতে কম্পিউটার, ইন্টারনেট।
কক্সবাজার থেকে দিনাজপুর রেলগাড়ি চলবে- এটা ১০ বছর আগেও কেউ কল্পনা করতে পারেনি। কিন্তু এটাই এখন বাস্তবতা। পুরোপুরি নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এই পর্যায়ে জাতির জীবনে সবচেয়ে বেশি দরকার নৈতিকতা, মানবিকতা, সমমর্মিতার স্ফূরণ; শুদ্ধাচার চর্চার মধ্য দিয়ে যা হয়ে ওঠে স্থায়ী। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিকসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যত বেশি মানুষ শুদ্ধাচারী হয়ে উঠবে, তত সম্ভবপর হবে আমাদের জাতিগত উত্থান।
আমাদের অতীত মহান ছিল। উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের আগে পৃথিবীর ৬ষ্ঠ সমৃদ্ধ জাতি ছিলাম আমরা। আমাদের জিডিপি ছিল বৈশ্বিক জিডিপির ২৩ শতাংশ, যার ১২ শতাংশ আসত এই বাংলা থেকে।
আমাদের ভবিষ্যতও মহান হবে, যদি আমরা আমাদের অনন্য মেধাকে কাজে লাগাই, শুদ্ধাচারী হই, নিজের কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে করি।