রাজ্যের নাম চন্দননগর।
রাজ্যের রাজার বেশ সুনাম একজন সদাচারী ও বিনয়ী মানুষ হিসেবে। সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন তিনি। জনগণের যেকোনো প্রয়োজনে সাহায্যও করতেন সাধ্যমতো।
তবে রাজার ছিল এক বিচিত্র স্বভাব।
প্রতিদিন প্রত্যুষে রাজা উজিরকে সাথে নিয়ে নদীর পাড়ে ভ্রমণে বের হতেন। পথেই পড়ত এক চন্দনকাঠ ব্যবসায়ীর দোকান। দোকানের সামনে আসা মাত্রই রাজা কেমন যেন বদলে যেতেন। ব্যবসায়ীকে লক্ষ করে দূর থেকেই তাকে অভিসম্পাত করতেন এবং বলতেন, ‘এই লোক কবে মরবে!’
একদিন কৌতূহলী উজির জিজ্ঞেস করেই ফেললেন, ‘রাজা মশাই, বেয়াদবি নেবেন না। কোনোদিন আপনার মুখে কারো নামে কোনো কটূক্তি শুনলাম না। অথচ প্রতিদিন বেচারা কাঠ ব্যবসায়ীর মৃত্যু কামনা করেন কেন? সে কি আপনার কোনো ক্ষতি করেছে?’
রাজা : সে আমার কোনো ক্ষতি করে নি তবে তাকে দেখলেই মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়! আমি তোমাকে আদেশ করছি, আজ রাতেই তুমি তাকে তলোয়ার দিয়ে হত্যা করবে।
একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে বিনা দোষে হত্যা করতে উজিরের মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু প্রাণনাশের ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারলেন না।
তবে কৌতূহলী হয়ে উঠলেন তিনি। ভাবলেন ঘটনাটা খতিয়ে দেখা দরকার।
রাত হতেই উজির গেলেন ব্যবসায়ীর দোকানে। এই কাঠ সেই কাঠ দেখতে দেখতে বিস্মিত হলেন তিনি। এত ভালো মানের ও সুঘ্রাণযুক্ত চন্দন কাঠ তিনি আগে কোথাও দেখেন নি।
কৌশলে ব্যবসায়ীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ জুড়ে দিলেন।
ব্যবসায়ী : আমার চন্দনকাঠ শুধু এই রাজ্যে নয়, আশেপাশের সব রাজ্যের মধ্যে সেরা। তবে আফসোস! দামটা বেশি বলে বিক্রি প্রায় নেই বললেই চলে, তাই প্রচারও কম। আমি তো অপেক্ষা করে আছি আমাদের রাজা কবে মরবেন!
উজির : কেন কেন? রাজামশাইয়ের মৃত্যুর সাথে কাঠ বিক্রির সম্পর্কটা কি?
ব্যবসায়ী : দেখুন, রাজা মারা গেলে তাকে তো আর যেন-তেন কাঠ দিয়ে দাহ করা হবে না! সেরা কাঠের জন্যে আসতে তো হবে আমার কাছেই। সেদিন নিশ্চয় আমার কপালটা খুলবে!
এবার উজিরের কাছে সব পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল।
তিনি ছিলেন যথেষ্ট বুদ্ধিমান।
উজির : বলেন কি জনাব? রাজামশাই তো আপনার কাঠের মহাভক্ত। তিনি আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন কিছু ভালো কাঠ সংগ্রহ করে নেবার জন্যে।
বিস্মিত ব্যবসায়ীর তো চোখ কপালে! দ্রুত দোকানের সবচাইতে ভালো কিছু কাঠ দিয়ে দিলেন উজিরের হাতে।
ফিরে এসে উজির রাজাকে বললেন, ‘রাজামশাই, কি দেখে এলাম বিশ্বাস করবেন না। এই ব্যবসায়ী তো আপনার মহাভক্ত! দেখুন না, আপনার জন্যে এই কাঠগুলো তিনি উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন।
এবার রাজামশাইয়ের বিস্মিত হবার পালা।
এত ভালো কাঠ আমার রাজ্যে আছে আর আমিই জানি না? এই কাঠ বিদেশে রপ্তানি করলে তো আমাদের লাভ!
পরদিন রাজা সশরীরে উপস্থিত হলেন কাঠের দোকানে। ব্যবসায়ীকে বললেন, তোমার কাঠের মানে আমি সন্তুষ্ট। এই কাঠ প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে পাঠাবো রাজাদের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের জন্যে।
এক মাসের মাথায় ব্যবসায়ীর অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো চন্দননগরের ব্যবসায়ীর নাম। দেশ বিদেশ থেকে কাঠের অর্ডারও বিপুলভাবে আসতে লাগলো।
আর রাজা ও ব্যবসায়ীর কি হলো?
দুজনের মাঝে ঘৃণার বদলে তৈরি হলো কৃতজ্ঞতাবোধ ও পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধের এক সুন্দর সম্পর্ক।