মনের জানালায় স্মৃতির হাওয়া
– শেখ শাহাদাৎ হোসেন
( আমার একটা সুপ্ত আকাঙ্খা ছিল যে, জীবন স্মৃতির মত কিছু একটা লিখব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন আমার এক প্রিয় শিক্ষকের রুমে বসে তাঁর সঙ্গে কথা বলছি (এখনো তিনি কর্মরত আছেন); কথায় কথায় স্যার জানালেন যে, একটি প্রকাশনী তাঁকে তাঁর আত্নকাহিনী লেখার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু স্যার তাঁদের বলেছেন যে, তিনি এমন কোন উল্লেখযোগ্য কেউ নন। এ কথা শোনার পর আমার মস্তিস্ক হতে আত্নকথা লেখার চিন্তা বিদায় নিল। কিন্তু জীবনের মধ্যগগণ পেরিয়ে এসে মনে হল, নাই বা হতে পারলাম তেমন কিছু ; কিন্তু আমিও একজন মানুষ তো! বুনোফুলের সুবাস কেউ গ্রহণ না-ও করতে পারে; তাই বলে কি তার সুগন্ধ বিলানো বন্ধ রাখবে? ধরেই নিচ্ছি, আমার এই সাধারণ জীবন কথা কেউ পড়বে না। তবুও আমি লিখে যাব; কারণ তাতেই আমার আনন্দ। তবে নামকরণ নিয়ে ধন্ধে পড়ে গিয়েছিলাম; এমন সংকটে আমার প্রস্তাবিত অনেকগুলোর মধ্য থেকে একটি নাম বেছে নিয়ে ’একজন’ আমায় উদ্ধার করলেন। তবে তিনি আদৌ এই ‘প্যাঁচাল’ পড়বেন কি না; তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে আমার। কারণ, জীবনের সব হিসাব নিকাশ পুরোপুরি কখনো মেলে না; অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। শেষে বলে রাখা ভালো, কম ধৈর্য আর পেশাগত কারণে আমার এই লেখামালা এলোমেলো হতে পারে; ঘটনা পরম্পরা আপাতত হয়তো ঠিক রাখা সম্ভব হবে না। তবে যদি কখনো এই কথাগুলো গ্রন্থাকারে বের করার সুযোগ হয়, তখন সাজিয়ে লেখার চেষ্টা করব।)
পর্ব – ১
“ধ্যাত্তেরি, শেষে ঘাড়টা ভাঙবো নাকি” বলেই বড় ভাই শওকত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা তার মাথার ওপর থেকে লাল কাপড়ের তোষকটা ঝপ্ করে ফেলে দিল।
ভাই অনেকক্ষণ ধরে বলছিল তার ঘাড়টা ব্যথা করছে। তা হওয়ারই কথা; কারণ তার বয়স কেবল বারো চলছে, আর আমার বেলায় ঠিক তার অর্ধেক। তোষকের ওপরে অতিরিক্ত হিসেবে একটা বালিশও আছে। সমস্যা তেমন একটা হত না,যদি না ধান কেটে নেওয়ার পর তার লম্বা লম্বা নাড়া (খড়) রয়ে যেত। তা-ও কাদা পানিতে ভেজা; হাঁটতে গেলেই পায়ে জড়িয়ে যায়। দু’জনেই কয়েকবার হোঁচট খেতে খেতে শেষ মুহুর্তে সামলে নিয়েছি। আমাদের এমন মেঠোপথে হাঁটার অভ্যাস নেই । কারণ আমরা থাকি সুন্দরবনে কাঠের তৈরি বাংলো টাইপের কোয়ার্টারে। নৌকো চড়ে নদী পার হয়ে বগী প্রাইমারী স্কুল বা রায়েন্দা, তাফালবাড়ি বাজারে হেঁটে চলে যাই। মাঠের মধ্যে হাঁটা পড়ে খোন্তাকাটা গ্রাম বা চালিতাবুনিয়া হাটে যাওয়ার সময়; তবে সে মাঠ অধিকাংশ সময় থাকে শুকনো।
আমাদের এলাকার অনেকের মত বড়ভাইকে আমরাও মিয়াভাই বলি; যদিও শুনতে সেকেলে লাগে। সে আমাকে বলল, “তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি যা, গিয়েই আকবর ভাই আর ওমরকে পাঠিয়ে দে”। আমার একমাত্র ফুফুর ছেলে ওঁরা ( বর্তমানে দু’জনই প্রয়াত ), একই বাড়ির ওপরে দু’পরিবারের আবাস। আকবর ভাই মিয়াভাইয়ের বেশ বড়, আর ওমর আমার বড় বছরখানেকের। ভাইয়ের আদেশ তো শুনলাম, সে অনুযায়ী সামনের দিকে তাকালাম; প্রায় মাইলখানেক দুরে ছোট ছোট টিলার মত জায়গায় বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে। দুরত্বের কারণে সেগুলো দেখা যাচ্ছে আবছা আবছা;যেন কুয়াশাচ্ছন্ন। কিন্তু এই বিশাল খোলামাঠ পেরিয়ে সেখানে পৌঁছাব কি করে? নিজেদের বাড়ি এসেছি মাত্র কয়েকবার,তা-ও বহুদিন পর পর; সে জন্যে ভালো করে চিনিও না। কিন্তু সেটা কি করে বলি? ক্ষুদ্রকায় হলেও মান সম্মান বলে একটা ব্যাপার আছে না !
আমার হাতে মাঝারি সাইজের একটা বাজারের ব্যাগ। তার মধ্যে টুকিটাকি কিছু জিনিস; সের পাঁচেক ওজন তো হবেই। আমার দেহতরীখানার বর্ণনাও আবশ্যক( অবশ্য আল্লাহর ইচ্ছাতেই সব হয়)। আমার মস্তক আর কাঁধের মাঝখানে ঘাড়ের অস্তিত্ব অপেক্ষাকৃত খাটো। তবে উদরসর্বস্ব আমি; হালাল খাবার যা পাই,তাতে না নেই ( মাশআল্লাহ, এ বয়সেও তেমনটি অব্যাহত আছে)। মেজোভাই লিয়াকত আমাকে ’পেইটকো’( পেটুক ) বলে ক্ষেপায়; আমি অবশ্য তাতে থোড়াই কেয়ার করি। সব কথায় মাইন্ড করলে আখেরে লস-ই হয়। এত কথা বলার কারণ, আমার বডি আর উচ্চতা অনুযায়ী হাতের বোঝাটা কম ঝক্কির নয়। বাবার কথা হল, একটা চামচ নিয়েও বাড়িতে ফেলতে পারলে তাই লাভ। বলাবাহুল্য,পিতৃ আদেশ শিরোধার্য।
এবার পেছনের বৃত্তান্তটা একটু বলা যাক। সপরিবারে এতদিন আমরা বাবার কর্মস্থল সুন্দরবনে থেকেছি। এখন পড়াশোনার প্রয়োজনে গ্রামের বাড়িতে আসতেই হল। নয়দিন পূর্বে বড়সড় এক নৌকোয় আমাদের যাত্রা শুরু। কত নগর জনপদ যে পার হয়ে এলাম, তার ইয়ত্তা নেই। কত মানুষজন, হাটবাজার দেখলাম, কত অম্ল মধুর স্মৃতি অর্জন করলাম;তা কি বলে শেষ করা যাবে! টিটা হাট যেখানে বসে সেখানে আজ খুব ভোরে আমাদের বিশাল নৌ-যান নোঙর করেছে। মাঝি একজন আছেন বটে, কিন্তু যাবতীয় কষ্ট বাবারই হয়েছে; বরাবর তাই হয়। নৌকোর তিনের এক অংশ জুড়ে ছাউনি আছে ঠিকই, তাতে মা সহ আমরা ক’জন ঘুমাই। বছরখানেক বয়সের ছোটভাই রহমত মায়ের কোলে, আর ঝরণার বয়স চারের কাছাকাছি। বাবা আর মাঝি চাচা বাইরে ঘুমিয়েছেন। শুধু প্রবল বৃষ্টি হলে ছাউনির মধ্যে সকলেরই বসে থাকতে হয়েছে।
( ছবি- সংগৃহীত ; লেখাটি ধারাবাহিকভাবে চলবে। )