বিভিন্ন গবেষণা বলছে, ওষুধের রাসায়নিক বিক্রিয়ার মতো মেডিটেশন চর্চার ফলেও দেহে সৃষ্ট ইতিবাচক স্পন্দন রোগ নিরাময়ে একই পরিবর্তন আনে।
গবেষক-চিকিৎসকেরা বলছেন, রোগ নিরাময়ে ওষুধের সার্থক বিকল্প হতে পারে মেডিটেশন।
আর দেহের আটটি বৃহত্তম অঙ্গের সুস্থতাই আপনাকে করবে নিরোগ, সুস্থ ও প্রাণবন্ত।
একজন ধ্যানীর মস্তিষ্কের কর্পাস কলোসামের পুরুত্ব বাড়ায় মেডিটেশন।
কর্পাস কলোসাম ব্রেনের ডান ও বাম বলয়ের সমন্বয় সাধন করে। আর মটর ও সেনসরি নিউরোনের কাজের ওপর এই অংশের প্রভাব ব্যাপক।
মেডিটেশন মস্তিষ্কের প্যারাইটাল লোবকে শান্ত রাখে। ফলে একাকিত্ববোধ ও নেতিবাচক আবেগ দূর হয়।
মেডিটেশন মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে (তত্ত্বসূত্র : bangla.aajtak.in)
মেডিটেশন চর্চা ব্রেনের গ্রে-ম্যাটারকেও করে সমৃদ্ধ এবং হিপোক্যাম্পাসকে করে সতেজ। ফলে স্মৃতিশক্তিজনিত রোগ দূর হয়।
মানব দেহের সমুদয় রক্ত দিনে প্রায় ৪০ বার কিডনির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। তাই কিডনিকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব আপনারই।
কিডনিকে সুস্থ রাখতে মেডিটেশন অনেক কার্যকরি।
নিয়মিত মেডিটেশন কিডনিকে রাখে সুস্থ (তত্ত্বসূত্র : www.manobkantha.com.bd)
গবেষণায় দেখা গেছে, কিডনির ঊর্ধ্বভাগে এড্রিনালিন গ্লান্ড থেকে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল উৎপাদনের মাত্রা কমায় মেডিটেশন। ফলে কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে না।
২০২১ সালে ভারতে ক্রনিক কিডনি রোগে আক্রান্ত ১৭৫ জন রোগীর ওপর একটি গবেষণা করা হয়। ১২, ১৭ ও ২১ মাসের নিয়মিত মেডিটেশন ও ফলো-আপের পর গবেষকরা জানান, ধ্যানচর্চার ফলে রোগীদের শারীরিক অবস্থার উন্নতির হয়েছে।
একটি গবেষণা মতে, ৫০ বছর বয়সী যারা অস্টিওপরোসিসের মতো হাড়ের ক্ষয়জনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের প্রতি ১০ জনের ৯ জনই নারী। তবে ৭০ বছর বয়সীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা কিছুটা বেড়ে সাধারণত এ অনুপাত হয় ৬:৪ বা ৭:৩।
বয়সজনিত হাড়ের ক্ষয়জনিত রোগে মেডিটেশন খুবই কার্যকারী
আর এই ক্ষয়জনিত ব্যথাবেদনা দূর করতে, গঠন মজবুত করতে ও হাড়ের ক্ষয়প্রাপ্ত টিস্যু মেরামত করতেও সক্ষম মেডিটেশন।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার এমোরি ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের সাইকোলজিস্ট ও বিহেভিয়ারাল সায়েন্টিস্ট ডোনাল্ড নোবেল দমচর্চার ওপর দীর্ঘ গবেষণা করে বলেন, ধ্যানীদের শ্বাস-প্রশ্বাসের হার তুলনামূলক কম থাকে।
নিয়মিত দম চর্চা ফুসফুসকে অধিক সক্রিয় রাখে (তত্ত্বসূত্র : www.dhakatimes24.com)
মেডিটেশনকালে ধীর লয়ে নেয়া দম ফুসফুসকে অধিক সক্রিয় করে তোলে। একই হারে শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে তা হৃদস্পন্দনকেও প্রভাবিত করে।
বর্তমান বিশ্বে এক নম্বর ঘাতক ব্যাধি হলো হৃদরোগ। হৃদরোগের মূল কারণ স্ট্রেস বা মানসিক চাপ এবং অসম খাবার ও অতিভোজন।
মেডিটেশনে স্বাভাবিক গতির চেয়ে অর্ধেক গতিতে গভীরভাবে দমচর্চা করলে প্যারাসিম্প্যাথেটিক এবং ভেগাস স্নায়ু উদ্দীপিত হয়। ফলে রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে। হৃৎপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ায় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও কমে।
মেডিটেশন ও দম চর্চা হৃৎপিণ্ডের রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে ও হৃদরোগ প্রতিরোধে এ দারুণ উপকারি (তত্ত্বসূত্র : www.jugantor.com)
মূলত নিয়মিত মেডিটেশন মানসিক চাপ কমায়, রক্তে ইনসুলিন হোমিওস্ট্যাসিস পুনরুদ্ধার করে। ফলে দেহে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
যারা সাধারণত হজমের সমস্যায় ভুগছেন তাদের কারণটা কিন্তু শারীরিক নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানসিক। কারণ পাকস্থলীতে যে এসিড উৎপন্ন হয় তাতে লোহা দিলে, লোহাও গলে হজম হয়ে যাবে।
এই এসিড এত শক্তিশালী যে, পাকস্থলী যাতে নিজেই হজম না হয়ে যায়, সেজন্যে প্রতি পাঁচ দিনে পাকস্থলীর আবরণ বদলে যায়।
হজমের সমস্যায় ভুগছেন তাদের কারণটা কিন্তু শারীরিক নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানসিক (তত্ত্বসূত্র : eisamay.com)
মেডিটেশনে গভীরভাবে দম নেয়ার ফলে অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত সারা শরীরজুড়ে প্রবাহিত হয়, যা পরিপাকতন্ত্র বিশেষ করে পাকস্থলী ও অন্ত্রের আবরণকে সুস্থ রাখে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে পুষ্টি সরবরাহ করার জন্যে নিয়োজিত কোষগুলোকে উজ্জীবিত করে ফলে পেটের সমস্যা যেমন এসিডিটি, আইবিএস, আইবিডি থেকে মুক্ত থাকা যায়।
দম চর্চার ক্ষেত্রে আমাদের ঐতিহ্য কমপক্ষে পাঁচ হাজার বছর আগের।
মুনি ঋষি দরবেশদের ত্বক, চোখ ও চেহারায় যে ঔজ্জ্বল্য ও আভা দেখা যেত তার অন্যতম কারণ ছিল ঠিকভাবে দম নেয়া অর্থাৎ পর্যাপ্ত অক্সিজেন গ্রহণ।
মার্কিন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এমি ওয়েশলার বলেন, মস্তিষ্ক এবং ত্বক একই ভ্রূণীয় স্তর থেকে তৈরি হয় এবং এদের মধ্যে আন্তঃসংযোগ রয়েছে।
ধ্যান শরীরের প্রদাহ প্রক্রিয়ার গতি কমিয়ে ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নত করে। ত্বকের মসৃণতা ও কোমলতা ধরে রাখে এবং চর্মরোগ ও ব্রণ কমাতে সাহায্য করে। এমনকি হরমোনে ভারসাম্যের ক্ষমতার কারণে পাশ্চাত্যে নারীদের ধ্যানচর্চায় আগ্রহও বেড়েছে।
ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নত করতে পাশ্চাত্যে নারীদের ধ্যানচর্চায় আগ্রহও বেড়েছে। (তত্ত্বসূত্র : barta24.com)
২০১৯ সালে ২৯টি গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যান্সারে আক্রান্ত যে রোগীরা মেডিটেশন করেন তাদের মানসিক যন্ত্রণা, ক্লান্তি, ব্যথা এবং বিষণ্নতার লক্ষণগুলো কম থাকে।
কান শরীরের এমন একটি অঙ্গ যা দিয়ে আপনি প্রিয়জনের কণ্ঠস্বর, সুমধুর গানসহ পাখির আওয়াজ শুনতে পান এবং তৃপ্ত হন।
তাই যদি এই কান সংক্রান্ত সমস্যায় ভোগেন তাহলে মেডিটেশন আপনাকে সাহায্য করবে।
আমেরিকান টিনিটাস এসোসিয়েশনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ১ কোটি ২০ লাখ মানুষের ক্রনিকাল টিনিটাসে (কানে শব্দ বেজে ওঠা রোগ) আক্রান্ত।
গবেষণায় প্রমাণিত কান সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে মেডিটেশন দারুন সাহায্য করে (তত্ত্বসূত্র : bangla.aajtak.in)
তাই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, শ্রবণশক্তি বাড়াতে ও শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে মেডিটেশন অনুশীলন জরুরি।
এড্রিনালিন হরমোনের অধিক নিঃসরণে কানের ভেতর রক্ত সঞ্চালন হ্রাস পায়। ফলে ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি কমতে থাকে। অন্যদিকে মেডিটেশন এড্রিনালিন হরমোনের নিঃসরণ কমায়। ফলে একজন ধ্যানীর শ্রবণশক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে বিভিন্ন শব্দ বোঝার ক্ষমতাও বাড়ে বহুগুণ।
তাই আসুন, বুক ফুলিয়ে দম নিন, মেডিটেশন করুন, নিজের যত্ন নিন, আপনি থাকবেন সুস্থ ও প্রাণবন্ত।