আসলে রমজান মাস হচ্ছে, আমরা যদি খুব সহজভাবে বলি সেটা হচ্ছে দয়ার মাস দোয়ার মাস। দয়া নিজের জন্যে দয়া অন্যের জন্যে, দোয়া নিজের জন্যে আর দোয়া অন্যের জন্যে।
আপনারা বলতে পারেন যে, অন্যের জন্যে দয়া তো বুঝি নিজের জন্যে দয়াটা তো বুঝলাম না।
আসলে সত্যিকারের নিজের ওপর দয়া হচ্ছে নিজের দেহ-মন-আত্মার ওপরে কোনো অত্যাচার না করা, কোনো ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন না করা, কোনো ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করা। যখনই কোনো ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করলেন আপনি আসলে নিজের ওপরই জুলুম করলেন, নিজের ওপরই অত্যাচার করলেন। এজন্যে সব ব্যাপারে মিতাচারী হওয়া। অর্থাৎ সব ব্যাপারে পরিমিতি বজায় রাখা।
ধরুন, আপনার এবং আপনার প্রতিবেশীর মধ্যে একটা সীমা আছে। জমির কথাই ধরুন- জমির কী থাকে? আইল থাকে। এখন জমির আইল পর্যন্ত আপনি যত দৌড়াদৌড়ি করেন লাফালাফি করেন নাচানাচি করেন, ঠিক আছে।
কিন্তু আইল পার হয়ে সীমানা পার হয়ে অন্যের জমিতে গিয়ে যদি নাচানাচি করেন, লাফালাফি করেন যে, আমি তো অন্যের কোনো ক্ষতি করছি না, আমি তো লাফালাফি করছি নাচানাচি করছি মনের আনন্দ প্রকাশ করছি।
আপনি হয়তো কিছুই করবেন না, কিন্তু আরেকজন মনে করতে পারে যে, কীরে! আমার জমি দখল করে নিল কিনা! সে হয়তো দেখা যাবে যে, লাঠি নিয়ে ছুটে আসছে। এবং তাকে ছুটে আসতে দেখে আপনি বিরক্ত হচ্ছেন যে, অ্যাই! তুমি লাঠি নিয়ে আসছ কী জন্যে?
দেখা গেল যে, আপনি উত্তেজিত হয়ে সে-ও উত্তেজিত হয়ে কোনো কারণ ছাড়া কথা ছাড়াই কী হলো? একটা মারামারি হয়ে গেল। এবং আপনি আঘাতপ্রাপ্ত হলেন। তার মানেটা কী? আপনি পরিমিতিটা বজায় রাখেন নাই। দেহের ব্যাপারেও তাই।
আসলে নিজের দেহমন এবং আত্মার যে যত্ন নেয়া মমতার সাথে, যেমন আমি অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে ফেলে যদি নিজের দেহমনের ওপরে জুলুম করে থাকি, তো সেটার যত্ন নেয়ার যে সুযোগ, প্রতি বছর রমজান আমাদের সামনে এই সুযোগটাই এনে দেয়।
আসলে রমজানকে আমরা বলতে পারি দেহ এবং মনের সার্ভিসিং মাস। যেরকম একটা কাপড় ধোয়া হয়। এই কাপড় ধোয়াটা হচ্ছে এটার সার্ভিসিং। ঘর পরিষ্কার করা হয়, ঘর পরিষ্কার করাটা এটার সার্ভিসিং। খুব দামি গাড়ি কিনলেন, গাড়ি যদি সার্ভিসিং না করেন তাহলে কী হবে? খুব দামি গাড়িও খুব অল্প সময় নষ্ট হয়ে যাবে। এটার সার্ভিসিং যদি নিয়মিত করা হয়, তো গাড়ি বহুদিন ঠিক থাকবে।
তো এই যে দেহ, এই দেহটা স্রষ্টা যে বুদ্ধি দিয়েছে জ্ঞান দিয়েছে সেই বুদ্ধি জ্ঞানমতোন যখন সার্ভিসিং করবেন, এই দেহ সবসময় ঠিক থাকবে। তো আল্লাহতায়ালা এই দেহের সার্ভিসিংয়ের ম্যানুয়াল দিয়ে দিয়েছেন।
সেটা কী? রোজার মাসে তুমি এইভাবে দেহটাকে রেস্ট দেবে, এইভাবে দেহটাকে পরিষ্কার করবে, মনটাকে পরিষ্কার করবে। তাহলে আবার ১১ মাস তুমি ভালো থাকতে পারবে।
রোজা রাখলেন আপনি আগের চেয়ে সুস্থ হলেন না, আগের চেয়ে এনার্জিটিক হলেন না, আগের চেয়ে বলবান হলেন না, আগের চেয়ে গতিমান হলেন না, তাহলে বুঝতে হবে যে আপনার রোজা যথার্থ হয় নি। যেভাবে সার্ভিসিং দরকার ছিল আপনার বডিটার, বডিটা সেভাবে সার্ভিসিং হয় নাই, মনটা যেভাবে সার্ভিসিং হওয়া দরকার ছিল, মনটা সেভাবে সার্ভিসিং হয় নাই।
আসলে আপনার দেহ-মন-আত্মার ওপরে নিজের নিয়ন্ত্রণ এবং সত্তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাটাই হচ্ছে রমজান মাসের লক্ষ্য।
‘আমি রোজাদার’ মানেটা কী? ‘আই এম ফাস্টিং’ মানেটা কী? ‘আমি উপোস করছি’ অর্থটা কী? রোজা বলেন, উপবাস বলেন ফাস্টিং বলেন- একই জিনিসের নানানরূপ।
আসলে কখন আপনি রোজাদার হবেন? যখন রোজা আপনি রেখেছেন, এটাই আপনার আনন্দ হবে। অর্থাৎ যখন আপনি রোজা রাখবেন, আপনার চেহারাতে একটা নিষ্পাপ আভা আসবে যে, আপনি যে উপোস করতে পেরেছেন, আপনি যে রোজা রেখেছেন, এটাই আপনার আনন্দ।
এবং এই রোজা রাখাটা শুধু খাওয়া-পানি বন্ধ করা না যে, আমি খেলাম না, পান করলাম না কিছু। না! আমার যে প্রবৃত্তির যতরকম তাড়না আছে, দেহের যতরকম তাড়না আছে সমস্ত তাড়নার ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ।
যেরকম, রোজার দিনে একজন মানুষ লুকিয়েও খায় না। কেন? সে সচেতন থাকে যে পানি খেলে খাবার খেলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে, রোজা থাকবে না।
তো একইরকম সচেতন থাকতে হবে রেগে যাওয়া থেকে। রেগে গেলে রোজা নষ্ট হবে। ক্ষোভ যদি থাকে ভেতরে, ঘৃণা যদি থাকে, বিরক্তিভাব যদি থাকে রোজা নষ্ট হবে।
এই যে রোজাদারের কথা বললাম, কেন খেপে যাচ্ছে? তার ভেতরে রোজা রাখার আনন্দ নাই, রোজা রাখার বিরক্তি আছে। সে বাধ্য হয়েছে রোজা রাখতে। এজন্যে রোজা রেখেছে। মানে তেতে আছে একেবারে তাওয়ার মতোন!
তাহলে বুঝতে হবে, তার প্রবৃত্তির তাড়নার ওপরে তার নিয়ন্ত্রণ আসে নাই। তার সংযম আসে নাই, তার ফাস্টিং তার রোজা হয় নাই। রোজা করে যদি আপনি গীবত করেন, পরচর্চা করেন, গসিপ করেন রোজা হবে না।
আমরা গসিপ অনেকভাবে করি। গসিপ আমরা করি, অনেক সময় গসিপ দেখিও। যেমন, কোন নায়ক কোন নায়িকার সাথে কী করেছে! আপনি ওটা সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখছেন। পত্রিকাতে এটা দেখছেন- অমুক নায়ক অমুক নায়িকার সাথে পালিয়ে গেছে বা অমুক নায়ক অমুক নায়িকাকে এই করেছে সেই করেছে!
আপনি এই যে গীবত, এই যে পরচর্চার আপনি অংশীদার হয়ে গেলেন। রোজা আপনার অশুদ্ধ হয়ে গেল।
তো আসলে মেধা এবং শক্তির সব ধরনের অপচয় থেকে দূরে থাকা, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা এটার নাম হচ্ছে রোজা। আমি আমার সমস্ত শক্তিকে সংযত করেছি, আমার কামনা-বাসনা, আমার লোভ-লালসা সবকিছুর আমার নিয়ন্ত্রণে রাখার নাম হচ্ছে রোজা এবং সেটা হাসিমুখে।
আপনাকে দেখে যদি বোঝা যায় যে, আপনি রোজা রেখেছেন তাহলে বুঝতে হবে যে আপনি আসল রোজাদার হতে পারেন নাই, আসল রোজাদার হওয়ার জন্যে আপনাকে চেষ্টা করতে হবে।
একটা ছোট্ট ঘটনা বলি- অনেক আগের ঘটনা এটা। ধরুন এখন থেকে ৫০-৬০ বছর আগের ঘটনা। এক ঘর পালানো তরুণ, কখনো সখনো মনে হলে ঘরে যায়। কখনো যায় না! অনেক সময় ঘরে যায়, ক্ষুধা লাগলে ঘরে যায়। কারণ ঘরে মা আছে, মা গেলে খাবার দেবেই।
একবার সে তরুণের তিন/চার দিন সেরকম কোনো খাওয়া-টাওয়া হয় নি। সে তরুণ এসছে মায়ের কাছেই। তো এসে দেখে ধরুন এখন থেকে ৬০-৭০ বছর আগে কিন্তু ডাইনিং টেবিল ছিল না। তখন মেঝেতেই পাটি বিছিয়ে অথবা পিড়ি বিছিয়ে খাওয়া-দাওয়া হতো।
আগেকার দিনে মায়েরা কিন্তু সন্তানের সাথে অথবা স্বামীর সাথে বসে খেতেন না, তারা সবাই খাওয়া-দাওয়া করার পরে যা অবশিষ্ট থাকত এটাই মায়েদের ভাগ্যে জুটত। এবং তাতেই তারা খুব তৃপ্ত থাকতেন।
তো নিম্নবিত্ত পরিবার ছেলে এসছে। দেখল যে মা-র খাওয়া শেষ এবং হাঁড়িতে কোনো খাবার নেই, ফাঁকা!
তো এখন ছেলে চিন্তা করছে যে, এখন মা যদি বুঝতে পারে যে ক্ষুধার্ত তো এখন মা আবার কী করবে? রান্না করতে হবে তাকে। মা-তো স্বাভাবিকভাবেই খাওয়ার সময় এসছে খাওয়া শেষ হলে কী হবে, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এই তুই খেয়েছিস?
তরুণ বলে যে, ক্ষুধা নাই। মা বলছেন, ক্ষুধা নাই এসছিস কেন? বলে যে, “তোমাকে দেখতে এসছি” বলে হাসি দিল একটা। এবং তার চেহারা এত নরমাল ছিল, এত স্বাভাবিক ছিল যে মা-ও বুঝতে পারে নাই যে দুই তিন দিন ধরে সে তেমন কিছু খায় নি।
তো এটা হচ্ছে আই ক্যান ফাস্ট যে, আমি উপোস করতে পারি যে-কোনো কিছু থেকে। যে-কোনো উত্তেজনার মুখে আমি শান্ত থাকতে পারি। সেটা রাগ হোক, ক্রোধ হোক, কাম হোক, যৌনতা হোক- যে-কোনো উত্তেজনার মুখে আমি শান্ত থাকতে পারি। এটা হচ্ছে আমি রোজাদার। ‘আই এম ফাস্টিং’ অর্থ হচ্ছে এটা।
আপনি দেখেন খন্দকের সময়! তো তখন খাবারের অভাব ছিল। স্বাভাবিকভাবে! অবরুদ্ধ তারা। এক সাহাবী এসে নবীজীকে বললেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! অনেক ক্ষুধা। বলে নিজের জামা উঠিয়ে দেখালেন যে পেটে পাথর বাঁধা। মানে ক্ষুধার জন্যে পেটে পাথর বাঁধা।
আপনি বলবেন যে ক্ষুধা হচ্ছে পেটের ভেতরে, পেটের বাইরে পাথর বাঁধলে কী হয়? আসলে ক্ষুধা লাগলে এসিডিটি বাড়ে। এসিডিটি বাড়লে পেট গরম হয়। তো পেট গরম হলে পাথর দিয়ে রাখলে পেটটা ঠান্ডা থাকে, গরম ভাবটা কেটে যায়।
তো নবীজী (স) হাসলেন। হেসে নিজের জামা উঠালেন! তো সেই সাহাবী দেখে যে, সাহাবীর তো এক পাথর বাঁধা। নবীজীর (স) দুই দিকে পাথর বাঁধা। অর্থাৎ তার ক্ষুধাটা এত ছিল যে তাকে দুটো পাথর বানতে হয়েছিল। কিন্তু সাহাবীও দেখে বুঝতে পারে নাই যে নবীজী (স) এত ক্ষুধার্ত!
তো এটা হচ্ছে ‘আই ক্যান ফাস্ট’। আমি রোজাদার আমি উপোস করছি। অর্থাৎ প্রত্যেকটা জিনিস হবে হাসিমুখে। সকাল থেকে সন্ধ্যা- চেহারায় থাকবে একটা তৃপ্তি, সৌম্যতা, একটা শান্তি।
এবারের রমজানে আমরা এই পর্যায়ে নিজেকে নিয়ে যেতে চাই! নিজেকে দয়া করতে চাই। নিজের দেহের ওপরে মনের ওপরে অত্যাচার করতে চাই না। সীমালঙ্ঘন করতে চাই না।
তো সেজন্যে কী করব?
খেজুর-পানি দিয়ে ইফতার করব এবং রাতের খাবার মোটামুটি খাবো।
আসলে আমরা ভুল করি! আমরা মনে করি যে বেশি খাবার খেলে রোজা কম লাগবে। বেশি খাবার খেলে রোজা বেশি লাগে। খাবার কমালে কষ্ট কম থাকে। অর্থাৎ ক্লান্তি কম হয়।
এবং সেহরি হচ্ছে একদম সাদামাটা। গরু খাসি মাংস মাছ সেহরিতে যত কম খান তত ভালো। কেন? কারণ তখন আপনার পানির তৃষ্ণা বেশি লাগবে, পিপাসা বেশি লাগবে, রোজায় আপনি কষ্ট পাবেন। আর পিপাসা কম লাগলে সবসময়ই রোজা আপনার জন্যে কী হবে? আপনার জন্যে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হবে।
দুই হচ্ছে, যত রাগ ক্ষোভ-এগুলোর ওপরে নিয়ন্ত্রণ যে না আমি রোজাদার, আমি রাগ করতে পারি না। গীবত পরচর্চা গসিপ করা শোনা দেখা এবং পড়া। বলবেন যে আমি তো বলিও নাই শুনিও নাই দেখিও নাই আমি পেপারে পড়েছি আরকি, না।
একটা বিষয় শুধু এই রোজাতে যে, আমি গীবত করব না, গীবত দেখব না, গীবত শুনব না, গীবত বলব না। আপনি রোজার একটা আলাদা আনন্দ পাবেন। আপনার তখন আত্মা আনন্দিত হবে।
মন যত পরিষ্কার হবে, আত্মা তত তৃপ্ত হবে।
আর আত্মার জন্যে প্রথম কাজ হচ্ছে, যাকাত আদায় করা। যারা যাকাতদাতা, যাকাত আদায় করে ফেলবেন রমজানের মধ্যে প্রথমভাগে।
অর্থাৎ যখনই সম্ভব, যাকাত আচ্ছা কয়েকদিন পরে দেবো, না। যাকাত আদায় করার অর্থ হাতে থাকলে সাথে সাথে আদায় করে ফেলবেন। যাকাতের ব্যাপারে আমরা কিন্তু অনেক সময় খুব আলসেমি করি এবং অনেক সময় যাকাত না দেয়ার ফন্দি-ফিকির করি যে কীভাবে হিসাব করলে যাকাত দেয়া যাবে না। বানরের পিঠা ভাগের মতন করি। এটা করবেন না। আল্লাহকে ফাঁকি দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব না।
তো যাকাত যেহেতু ফরজ এবং রমজানে যে-কোনোকিছুর দানের সওয়াব হচ্ছে ৭০ গুণ, অতএব যাকাত এই রমজান মাসে আদায় করে ফেলবেন। এবং যত পারেন দান করবেন রমজান মাসে, এক নম্বর।