আশেপাশে কোনো হাই স্কুল ছিল না। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বৌদ্ধ অনাথ হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা শুরু হয় আমার। ভর্তি হয়েছিলাম বান্দরবান বৌদ্ধ অনাথালয় নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এখানেই পড়েছি। এরপর ভর্তি হই বান্দরবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেই সময়ে আমার নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য ছিল না। জীবনে বড় কিছু হতে হবে বা বড় কিছু করতে হবে এমন কোনো আগ্রহও ছিল না। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, ঘুরে বেড়ানোই হয়ে ওঠে নিত্যদিনের রুটিন। তাই নবম শ্রেণিতে ফেল করলাম। একই ক্লাসে দুবছর থাকলাম। হতাশ হয়ে গেলাম। ভাবলাম আমাকে দিয়ে কী হবে?
কাকতালীয়ভাবে এসময় আমার দেখা হয়ে যায় লালহিম সাং বম ভাইয়ের সাথে। তিনি তখন একাদশ শ্রেণির একজন কোয়ান্টা এবং বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। লালহিম ভাই বার্ষিক ছুটিতে বাসায় এসেছিলেন। তিনিই প্রথম আমাকে কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজের কথা বলেন, পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম আমাদের গ্রামের আরেক ছেলেও সেখানে পড়ত। নাম রাজীব চাকমা। বর্তমানে সে আন্তর্জাতিক মানের একজন জিমন্যাস্ট। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার আগ্রহ আমার তখন থেকেই।
জিপিএ ৩.১১ নিয়ে এসএসসি পাশ করলাম। কোয়ান্টাম কসমো কলেজে ভর্তির জন্যে ইন্টারভিউ দিলাম। সৌভাগ্যক্রমে টিকেও যাই। তখন থেকেই আমার জীবন বদলে যেতে লাগল।
নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা, আন্তরিকতা এবং সফলতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত দেখলাম এখানে এসে। আমিও এই বিষয়গুলো নিজের মধ্যে নিতে থাকলাম। আমাদের দিন শুরু হতো মেডিটেশনের মাধ্যমে। মেডিটেশনে আমার লক্ষ্য অবলোকন করতাম। যেহেতু আমার এসএসসির জিপিএ ছিল খুবই কম, তাই একাদশে আরো ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকি। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার সময় চলে এলো। পরীক্ষা দিলাম। এবার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির কোচিং করার পালা। আমাদের কলেজে থেকেই এই কোচিং করার সুযোগ ছিল। কিন্তু আমি কসমো কলেজের কোচিংয়ে সিলেক্ট হই নি। কারণ আমার এসএসসি-র রেজাল্ট ভালো ছিল না। আমি তো সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার ফরমও তুলতে পারব না।
কিন্তু আমি ভেঙে পড়ি নি। কোয়ান্টামের একটি কথা সবসময় আমার কানে বাজত—‘কোনো পরাজয়, পরাজয় নয় যদি তা মানসিকভাবে আমাকে পরাজিত না করে।’ কোয়ান্টাম কসমো কলেজ থেকে বের হয়ে আমি পরিচিত এক ভাইয়ের সাথে জীবনে প্রথম ট্রেনে করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসি। ক্যাম্পাসে আসার পর আমার মনছবি আরো শক্ত হয়ে ওঠে যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি একটা জায়গা করে নেবই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে থেকেই আমি ভর্তির প্রস্তুতি নিতে থাকি। পড়তে পড়তে এমনও হয়েছে যে সারারাত কীভাবে পার হয়েছে বুঝতেই পারি নি। জানালা দিয়ে যখন সকালের আলো ঘরে প্রবেশ করেছে তখন খেয়াল করেছি যে রাত পার হয়ে গেছে। সে-সময় আমি পড়ার আগে মেডিটেশন করে নিতাম।
আমার পছন্দের মেডিটেশন ছিল ‘শিক্ষার্থী মনছবি’। এই মেডিটেশন আমার মানসিক শক্তিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিত। পড়াশোনায় নিয়ে আসত আলাদা এক ছন্দ। সময় পেলেই অটোসাজেশন চর্চা করতাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম এবং পালি বিভাগে চান্স পেলাম। অনেকে বলেছিল, এই সাবজেক্টে পড়ে কী হবে? কিন্তু আমার বিষয়টি ভালো লাগে। বরং আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি যে, পালি বিভাগে পড়ছি। দেশের অন্যতম জ্ঞানতীর্থ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগ একটি সমৃদ্ধ ও গৌরবময় বিভাগ।
আমার বিভাগের সবাই আমাকে আমার আচার-আচরণের জন্যে পছন্দ করে। যদিও এসব আমি শিখেছি কোয়ান্টাম কসমো কলেজে গিয়ে। এজন্যে এই কলেজের নৈতিক কার্যক্রমের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ আমি। আমার কথা বলা, চালচলন, ভদ্রতা, কোথায় কেমন পোশাক পড়ব, ছোট-বড়দের সাথে কেমন ব্যবহার করব ইত্যাদি শুদ্ধাচারের মাধ্যমে আমার ব্যক্তিত্বকে নতুন মাত্রা দেয়ার জন্যে এই কৃতজ্ঞতা।
একটি ঘটনা না বললেই নয়। দিনটি ছিল ১৬ আগস্ট ২০২২ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা ‘ক’ ইউনিটে। কোয়ান্টাম থেকে প্রকাশিত শুদ্ধাচার বই ক্যাম্পেইনের পূর্বে মনছবি করেছিলাম যে, যেহেতু শুদ্ধাচার নিয়ে ক্যাম্পেইন করব, তাই আগে নিজের আচরণ সংযত রেখে এবং শুরুতে কুশল বিনিময় দিয়ে শুরু করব। যখন কাজে নেমে পড়ি তখন আমি বুঝতে পারলাম যে, অনেকেই মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছে। আমার আচরণের দ্বারা সাধারণ মানুষ এতটা প্রভাবিত হবে এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। ছোট ছোট শুদ্ধাচারগুলো নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে আমাদের জীবনে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। ফলে জীবনের চলার পথটি যেন আরো মসৃণ হয়ে উঠেছে। আমি দেশের সর্বত্র শুদ্ধাচারের বার্তা পৌঁছে দিতে চাই।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]