কথায় বলে, ‘বনের বাঘে খায় না মনের বাঘে খায়।’ মনের বাঘে যে কিভাবে খায় বাংলার প্রাচীন উপকথাই হতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ :
জঙ্গলের মাঝে গভীর তপস্যায় নিমগ্ন এক যুবক। একাগ্রচিত্তে সে ধ্যান করে যাচ্ছে। ঈশ্বরের সন্তুষ্টি লাভে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছে। বৈষয়িক কোনো ব্যাপারেই এখন তার কোনো আগ্রহ নেই। জঙ্গলে হিংস্র প্রাণীর কোনো অভাব না থাকলেও তার ভয়ডর বলে কোন কিছু ছিল না। সাধনার ফলে এই যুবক একদিন ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করে। ঈশ্বর তাকে বর দেন, ‘তুমি যা ভাববে, তা-ই হবে।’
ঈশ্বরের বর পেয়ে যুবক আত্মহারা। ভাবল এই গহীন জঙ্গলে সোনার এক বিশাল প্রাসাদ হলে কেমন হয়। সাথে সাথে হলোও তা-ই। আনন্দে লাফিয়ে উঠল সে। হঠাৎ মনে হলো ক্ষুধা লেগেছে তার। ভাবল সোনার থালায় সব সুস্বাদু খাবারের কথা। সাথে সাথে সামনে হাজির। মজাদার সব খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলল সে। শরীর এখন একটু বিশ্রাম চাচ্ছে। সোনার পালঙ্কে গা এলিয়ে দিল।
হঠাৎ তার মনে হলো প্রাসাদের মাঝে থাকলেও এর চারপাশে রয়েছে গহীন জঙ্গল। এখন যদি একটা বিরাট বাঘ এসে তাকে খেয়ে ফেলে! আর যায় কোথায়! যেই মনে করা ওমনি এক বিরাট বাঘ এসে তাকে খেয়ে ফেলল। সোনার প্রাসাদে পড়ে রইল শুধু তার কয়েক টুকরো হাড়।
এ যুবক বছরের পর বছর জঙ্গলে কাটিয়েছিল, বাঘ তার ধারে কাছেও আসেনি। কিন্তু নিরাপদ সোনার প্রাসাদেও সে মনের বাঘ থেকে রেহাই পেল না।
গল্পটি থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই, তাহলো কথা শুধু বাস্তবতার বিবরণই দেয় না, বাস্তবতা সৃষ্টিও করে। এক অনন্যসাধারণ দক্ষতা ও সম্ভাবনার উৎস হলো মানবমস্তিষ্ক। আর এ মস্তিষ্ককে চালায় মন। কাজেই মস্তিষ্কের ক্ষমতাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করার জন্যে প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণার পর বলেছেন, একজন প্রোগ্রামার যেভাবে কম্পিউটারকে পরিচালিত করে, তেমনি মন মস্তিষ্ককে পরিচালিত করে। মস্তিষ্ক হচ্ছে হার্ডওয়্যার আর মন হচ্ছে সফটওয়্যার। নতুন তথ্য ও নতুন বিশ্বাস মস্তিষ্কের নিউরোনে নতুন ডেনড্রাইট সৃষ্টি করে। নতুন সিন্যাপসের মাধমে তৈরি হয় সংযোগের নতুন রাস্তা। বদলে যায় মস্তিষ্কের কর্মপ্রবাহের প্যাটার্ন। মস্তিষ্ক তখন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নতুন বাস্তবতা উপহার দেয়।
নতুন বাস্তবতা ভাল হবে না খারাপ হবে, কল্যাণকর হবে না ক্ষতিকর তা নির্ভর করে মস্তিষ্কে দেয়া তথ্য বা প্রোগ্রাম-এর ভাল-মন্দের উপর। কল্যাণকর তথ্য ও বিশ্বাস কল্যাণকর বাস্তবতা সৃষ্টি করে আর ক্ষতিকর তথ্য বা বিশ্বাস ক্ষতিকর বাস্তবতা উপহার দেয়।
তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, জীবনের নতুন বাস্তবতার চাবিকাঠি হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি বা নিয়ত। সাধারণত যারা অসুখী বা হতাশায় ভোগে বেশি তারা নেতিবাচক চিন্তা বেশি করে। তাদের জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই। তারা কোনো পরিকল্পনা করতে পারে না। ফলে ব্যর্থ হয়। পরিণামে আরো বেশি হতাশায় ভোগে। নেতিবাচকতার শৃঙ্খলেই আবর্তিত হয় তাদের জীবন।
জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে আপনাকে তাই আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। আপনি কী বলেন আর কী ভাবেন তার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।
আপনি কি আত্মবিশ্বাসী? আপনার যা আছে তা নিয়ে কি আপনি কৃতজ্ঞ? আপনার ভবিষ্যৎ নিয়ে কি আপনি আশাবাদী? যদি না হয়, তাহলে আপনাকে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। ইতিবাচক চিন্তা করুন। এখন থেকে আপনি প্রতিনিয়ত কি শব্দ ব্যবহার করছেন সে ব্যাপারে সচেতন হোন।
আপনি কি ভাবেন, কি বলেন আর আপনাকে কি বলা হয় তা বিশ্লেষণ করুন। আপনার কথাবার্তা থেকে সকল নেতিবাচক শব্দ ও বাক্য বাদ দিন। কোনো নেতিবাচক শব্দ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলে সাথে সাথে ‘তওবা তওবা’ বা ‘বাতিল বাতিল’ বলুন। নেতিবাচক শব্দটিকে বাতিল করে দিন।
প্রতিদিন মনের বাড়িতে গিয়ে অন্তত একবার বলুন, ‘অমূলক ভয়-ভীতি, নেতিবাচক চিন্তা ও কথার প্রভাব থেকে আমি সবসময় মুক্ত থাকব।’ নেতিবাচক কথা হঠাৎ উচ্চারিত হলে ইতিবাচক কথা দিয়ে বক্তব্য শেষ করুন। ইতিবাচক কথাই আপনার জীবনে ইতিবাচক ফল আনতে সক্ষম।