‘আসসালামু আলাইকুম’ এর অর্থ আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক তা আমরা সবাই জানি।
সামাজিক শিষ্টাচার ও চারিত্রিক উৎকর্ষ অর্জন মুসলিমের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। সেজন্যই ইসলামে সামাজিক আদব-শিষ্টাচারকে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং সামাজিক আচার-আচরণের ক্ষেত্রে ইসলামের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে।
ইসলামের সামাজিক বিধান এতটাই পরিপূর্ণ ও সুবিন্যস্ত যে, মানবসভ্যতায় এর নজির বিরল। এখানে আমরা ইসলামের সামাজিক অনন্য দুটি আদব-শিষ্টাচার নিয়ে আলোচনা করব।
কেউ ভুল সালাম দিলে আপনার করণীয় কী?
কেউ যদি ভুল করে ফেলে সেটা আপনারই ভাই আপনারই বোন। তাকে বলবেন যে আপা, আমি কি ভুল শুনলাম? আমি যেন শুনলাম সালামালেকুম। আমি কি ভুল শুনলাম, নাকি আসসালামু আলাইকুমই বলেছেন? উনি তো তখন বলবেন যে না না, আমি আসসালামু আলাইকুম বলেছি। আচ্ছা ঠিক আছে।
তো কী হলো? উনি তো সতর্ক হয়ে যাবেন এরকম দুজনের কাছ থেকে যদি শোনেন।
আসলে আমরা আল্লাহর রসুল এবং তাঁর আহলে বায়াত এবং সাহাবীদের জীবন তো দেখি না। যার ফলে বুঝি না যে, একজনের ভুলটাও কীভাবে বলতে হয়!
ইমাম হোসাইন এবং ইমাম হাসান যখন ছোট্ট শিশু। তারা দেখছে যে, একজন বেদুইন অজু করছেন ভুলভাবে, অজু ঠিক হচ্ছে না। বয়স্ক মুরব্বি।
তো হাসান হোসেইন দুজনে বুদ্ধি করে ঝগড়া শুরু করলেন। একজন বলে যে, আমার অজু ভলো, আরেকজন বলে যে, আমার অজু ভালো! তারপরে তাকে মুরব্বি মানলেন যে, আপনি বিচারক। আমরা দুজনে অজু করি, কার অজু ঠিক হয় এটা আপনি বিচার করবেন। এবং দুজনেই অজু করলেন।
বেদুইন দেখল, দুজনে একই অজু করছে। তখন সে বুঝল যে, আরে আমি তো আসলে এভাবে অজু করেছি। আমার অজু ঠিক হয় নাই।
দেখেন, এই যে সম্মানবোধ। আহালে বায়াতের ইমামরা তো দেখিয়ে গেছেন যে, সম্মান কীভাবে করতে হয়!
তো একজন ভুল হতে পারে বা আমি ভুল শুনতেও পারি। কিন্তু পারস্পরিক ক্ষেত্রে আমরা এই সৌজন্যটার পরিচয় দেবো।
সালাম : এক অতুলনীয় সামাজিক বিধান
সমাজে চলতে গেলে একজন মুসলিমের সাথে অন্য মুসলিমের সাক্ষাৎ হয়। তখন একে অন্যের কল্যাণ কামনায় সালাম দিয়ে কথা শুরু করে। সালাম মুসলিমের স্বতন্ত্র সামাজিক শিষ্টাচার।
স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে সালামের আদেশ দিয়েছেন এবং এসংক্রান্ত আদব শিখিয়েছেন। আর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর অগণিত হাদীসে সালামের বিধি-বিধান বর্ণনা করেছেন। যেগুলো জমা করলে স্বতন্ত্র একটি বই হয়ে যাবে।
কারো ঘরে প্রবেশের সময় আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে সালামের দির্দেশ দিয়েছেন–
فَاِذَا دَخَلْتُمْ بُیُوْتًا فَسَلِّمُوْا عَلٰۤی اَنْفُسِكُمْ تَحِیَّةً مِّنْ عِنْدِ اللّٰهِ مُبٰرَكَةً طَیِّبَةً.
যখন তোমরা ঘরে ঢুকবে নিজেদের লোকদের সালাম করবে– কারণ এটা সাক্ষাতের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে প্রদত্ত বরকতপূর্ণ ও পবিত্র দুআ। –সূরা নূর (২৪) : ৬১
আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَدْخُلُوْا بُیُوْتًا غَیْرَ بُیُوْتِكُمْ حَتّٰی تَسْتَاْنِسُوْا وَ تُسَلِّمُوْا عَلٰۤی اَهْلِهَا .
হে মুমিনগণ! নিজ গৃহ ছাড়া অন্যের গৃহে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না অনুমতি গ্রহণ কর এবং তার বাসিন্দাদের সালাম দাও। –সূরা নূর (২৪) : ২৭
আর সালামের জবাব কীভাবে দিতে হবে তাও শেখানো হয়েছে কুরআনে। সালামের বাক্য থেকে উত্তম বাক্যে, বাড়িয়ে উত্তর দেবে; নাহলে অন্তত সালামদাতার সমান বাক্যে উত্তর দেবে। যে ব্যক্তি সালাম শুনেছে, সালামের জবাব দেয়া তার উপর ওয়াজিব। জবাব দেয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা গ্রহণযোগ্য নয়–
وَ اِذَا حُیِّیْتُمْ بِتَحِیَّةٍ فَحَیُّوْا بِاَحْسَنَ مِنْهَاۤ اَوْ رُدُّوْهَا.
যখন তোমাদেরকে কেউ সালাম দেয়, তখন তোমরা (তাকে) তদপেক্ষা উত্তমরূপে সালাম (জবাব) দিয়ো, কিংবা (অন্ততপক্ষে) সে শব্দেই সালামের জবাব দিয়ো। –সূরা নিসা (৪) : ৮৬
একজন সত্যিকারের মুসলিম কখনো সালাম থেকে গাফেল হতে পারে না।
সালাম দেওয়ার জন্য শরীয়ত নির্ধারিত বাক্য হল–
السّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ.
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও উপরোক্ত বাক্যে সালাম দিতেন এবং মুসলিমদের এভাবে সালাম দিতে শিখিয়েছেন। এক ব্যক্তি এসে নবীজীকে সালাম দিল (এ বাক্যে)–
عَلَيْكَ السّلَامُ يَا رَسُولَ اللهِ.
তখন নবীজী বললেন–
إِنّ عَلَيْكَ السّلَامُ تَحِيّةُ المَيِّتِ…
عَلَيْكَ السَّلَامُ এটা তো মৃতদের অভিবাদন (একথা তিনি তিনবার বললেন)। এরপর বললেন–
إِذَا لَقِيَ الرَّجُلُ أَخَاهُ المُسْلِمَ فَلْيَقُلْ: السّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ.
যখন কেউ তার মুসলিম ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে তখন যেন বলে–
السّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ.
–জামে তিরমিযী, হাদীস ২৭২১
সালামের বাক্য স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা নির্বাচন করেছেন। আদম সন্তানদের জন্য এই বাক্যকেই তাহিয়্যাহ তথা অভিবাদন স্বরূপ নির্ধারণ করেছেন। এ বাক্যের ভাব ও ভাষা, শব্দ ও সৌন্দর্য তুলনাহীন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টির পর বললেন–
اذْهَبْ فَسَلِّمْ عَلَى أُولَئِكَ مِنَ المَلاَئِكَةِ، فَاسْتَمِعْ مَا يُحَيّونَكَ، تَحِيّتُكَ وَتَحِيّةُ ذُرِّيّتِكَ، فَقَالَ السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ، فَقَالُوا: السّلاَمُ عَلَيْكَ وَرَحْمَةُ اللهِ، فَزَادُوهُ: وَرَحْمَةُ اللهِ.
যাও! ফিরিশতাদের ওই দলকে সালাম দাও এবং খেয়াল করে শোনো তারা তোমার সালামের কী জবাব দেয়; কারণ, এটিই হবে তোমার এবং তোমার বংশধরের সালাম অভিবাদন। তখন আদম আলাইহিস সালাম বললেন–
السّلاَمُ عَلَيْكُمْ
ফিরিশতারা জবাবে বললেন–
السّلاَمُ عَلَيْكَ وَرَحْمَةُ اللهِ
ফিরিশতারা وَرَحْمَةُ اللهِ বাড়িয়ে বললেন। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩২৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮৪১
মোটকথা, সালামের এ শব্দ-বাক্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই এসেছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
فَاِذَا دَخَلْتُمْ بُیُوْتًا فَسَلِّمُوْا عَلٰۤی اَنْفُسِكُمْ تَحِیَّةً مِّنْ عِنْدِ اللّٰهِ مُبٰرَكَةً طَیِّبَةً .
যখন তোমরা ঘরে ঢুকবে নিজেদের লোকদের সালাম করবে– কারণ এটা সাক্ষাতের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে প্রদত্ত বরকতপূর্ণ ও পবিত্র দুআ। –সূরা নূর (২৪) : ৬১
উপরোক্ত বর্ণনায় আমরা দেখলাম, আদম আলাইহিস সালামের উত্তরে ফিরিশতারা ‘ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বাড়িয়ে বললেন– এ আদব আল্লাহ তাআলাই শিখিয়েছেন। যেমনটি আমরা উপরে সূরা নিসার ৮৬ নং আয়াত থেকে জানতে পারলাম। আর এ বাড়িয়ে বলার ফযীলতও বর্ণিত হয়েছে হাদীস শরীফে। ইমরান ইবনে হুছাইন রা. বলেন–
أَنّ رَجُلًا جَاءَ إِلَى النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فَقَالَ: السّلَامُ عَلَيْكُمْ، قَالَ: قَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: عَشْرٌ ثُمّ جَاءَ آخَرُ فَقَالَ: السّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ، فَقَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: عِشْرُونَ. ثُمّ جَاءَ آخَرُ فَقَالَ: السّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ، فَقَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: ثَلَاثُونَ.
একবার এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম দিল–
কেউ তো ইচ্ছাকৃত ভুল করতে চায় না। সালামালাইকুম সে অভ্যাসবশত বলে, সে কিন্তু ইচ্ছা করে বলে না। সে আসসালামু আলাইকুমই বলতে চায়, বেরুনোর সময় সালামালাইকুম বেরিয়ে যায়, যেহেতু দীর্ঘদিনের অভ্যাস।
যে-রকম আমি মণ বলতে অভ্যস্ত ছিলাম। আমার যারা সঙ্গী সাথি বলে যে, মণ না। আমি বলি যে, মণ না! তাহলে কী? বলে যে, মণ মানে হচ্ছে এক মণ। আমি বলি তাহলে মন, বলে যে এটা মণ না এটা মোন। ম-ও-কার। আমি বলি যে, লেখাতে তো ম। বলে যে, এটা লেখায় হয় না, এটা উচ্চারণ করতে হয়। আমি বহুবার চেষ্টা করেছি মোন, বলতে গেলে মণ বেরিয়ে যায়। তারপরে আস্তে আস্তে এখন মণ থেকে মোন হয়েছে। এখন এটা তো অভ্যাসের ব্যাপার।
এজন্যে যখন বার বার স্মরণ করিয়ে দেবেন, স্মরণ করিয়ে দিলে জিনিসটা একটা সময় ঠিক হয়ে যাবে। শিষ্টাচার কণিকাতে আছে, আসসালামু আলাইকুম বলতে হবে এবং ওয়ালাইকুম বলা যাবে না, ওয়ালাইকুম আসসালাম বলতে হবে। সব শিষ্টাচার কণিকায় আছে পড়ে নেবেন। আর আসসালামু আলাইকুমই হচ্ছে মূল জিনিস।
[সজ্ঞা জালালি, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯]