মানুষ সাধারণভাবে সে অভ্যাসের দাস। সে সবসময় একটা নিরাপদ বলয়ে থাকতে পছন্দ করে।
অভ্যাস এবং সংস্কারটা হচ্ছে একটা নিরাপদ বলয়। সেটা মা-বাবার সংস্কার হতে পারে, পিতৃপুরুষের সংস্কার হতে পারে।
আবার এটা অভ্যাস হতে পারে। ধরুন একটা বাচ্চাকে যদি আপনি ডান কাতে শোয়ানোর অভ্যাস করিয়ে ফেলেন, তাকে যদি বাম কাতে শোয়ান, একটু পরেই সে ডান কাতে চলে যাবে। ডান কাত বাম কাত তো বাচ্চা বোঝে না, কিন্তু অভ্যাস।
এবং আমরা আমাদের অধিকাংশ কাজ করি চিন্তাভাবনা অভ্যাস এবং সংস্কার দিয়ে। দেখে। ভুল দেখলেও সেটা আমরা অনুসরণ করি। ঠিক হলেও আমরা সেটা অনুসরণ করি।
এবং এই নিয়ে বিখ্যাত গল্প আছে।
গল্পটা ২০০/৩০০/৪০০ বছর আগের। যখন ইউরোপে ফ্যামিলি-পরিবার বড় ছিল এবং একত্রিত ছিল। একটা সময় আসলে একান্নবর্তী পরিবারই সারা পৃথিবীতে ছিল।
তো এটা ক্রিসমাসের গল্প। ক্রিসমাসের সবচেয়ে উপাদেয় খাবারের মধ্যে হচ্ছে হ্যাম- এটার রোস্ট। আস্ত শুকরছানার রোস্ট এটা হচ্ছে তাদের খুব ফেভারিট ডিশ।
তো এক মেয়ে তার মাকে দেখছে প্রত্যেক বছরই সে যখন হ্যামরোস্ট করে, শুকরছানার রোস্ট করে, তখন এই মাথা-গলার এই অংশ কেটে দেয় এবং লেজ কেটে দেয়। ওটা রোস্ট করছে।
তো একদিন তার মনে প্রশ্ন জাগল। জিজ্ঞেস করল মাকে যে মা, তুমি এই রোস্ট করার সময় গলা এবং লেজ কেটে ফেল কেন? বলে যে, আমি এরকমই দেখে আসছি। আমার মাকে এইভাবেই করতে দেখেছি।
বলে যে, কেন করছ এটা তুমি জান না? বলে যে না, এটা তোমার অত জানতে ইচ্ছা হলে তোমার নানিকে জিজ্ঞেস কর গিয়ে। আমার অত জানার ইচ্ছা নাই।
তো তার কৌতূহল হলো, নানির কাছে গেল। বলল মাকে দেখলাম এটা করতে। মা বলেছে তোমাকেও এভাবেই রোস্ট বানাতে দেখেছে। কারণটা কী? মা বলল যে, তোমাকে জিজ্ঞেস করতে।
তো নানি বলল যে দেখ, আমাকে জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ নাই। আমিও আমার মাকে এভাবেই করতে দেখেছি, আমিও করেছি। অতএব তোমার যদি কিছু জানতে অত ইচ্ছা হয়, তো তোমার বড় নানিকে, আমার মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।
তো তার তো কিশোরী-কৌতূহল। গেল তার কাছে। তো সে-তো আবার বয়স হয়েছে! একেবারে খুবই বৃদ্ধা! কিছু কানে শোনে, কিছু শোনে না। একটা বললে আরেকটা শোনে। তো যাই হোক খুব জোরে চিৎকার করে সে বলল।
বলার পরে বলল যে, ও আচ্ছা এই হ্যামরোস্টের ব্যাপারে এসেছো জিজ্ঞেস করতে? তাহলে আসল ঘটনা শোনো। আমি যখন এই সংসারে এলাম তখন আমি তরুণী। সংসারে খুব অভাব ছিল।
তো ক্রিসমাসের সময় যে কড়াইতে রোস্ট করা হবে কড়াইটা ছোট ছিল এবং আমাদের বড় কড়াই কেনার সামর্থ্য ছিল না। আস্ত মাথাসহ ঐখানে রোস্ট করা সম্ভব ছিল না। এজন্যে আমরা মাথাটা কেটে, লেজ কেটে যেটুকু পরিমাণ এই কড়াইতে আঁটে সেটুকু পরিমাণ করে রোস্ট করতাম।
তরুণী বলল যে তারপরে? বলে যে, কয়েক বছর করতে করতে এটা অভ্যাস হয়ে গেল। এরপরে যখন সংসারে প্রাচুর্য এল, কড়াই বড় হলো, কিন্তু আমার অভ্যাস আর গেল না।
আমি সেই অভ্যাসবশত ঐভাবেই রোস্ট করতাম। তোমার নানিও ঐটা করতে দেখে ঐভাবে রোস্ট করছে। তোমার মা-ও ঐভাবে করছে। এবং তুমিও হয়তো ঐভাবেই করবে।
সে বলে যে না, আমি তো বুঝতে পেরেছি তোমরা কেন এটা শুরু করেছিলে। অতএব আমি আর করব না।
তো এখন এই যে অভ্যাস এই অভ্যাসের বৃত্ত ভাঙা এটা খুব কঠিন কাজ। এবং আত্মনিমগ্ন না হওয়া পর্যন্ত কেউ আসলে এই অভ্যাসের বৃত্ত ভাঙতে পারে না।
কেন আমরা প্রাজ্ঞ হতে পারিনা? প্রত্যেকের মধ্যে সম্ভাবনা আছে, কিন্তু আমরা এই অভ্যাসের বৃত্তটাকে ভাঙতে পারি না।
এই যে সংস্কার! অভ্যাস।
এক মহিলা তিনি কখনো ডাব খেতেন না। ডায়রিয়া হলেও তাকে ডাব খাওয়ানো যেত না। বলে যে, না, ডাব খাব না।
কেন খাবে না? তার মা খায় না এজন্যে।
তো জিজ্ঞেস করা হলো যে, আপনার মা খায় না। কী জন্যে খায় না? মানে এই মহিলার এক ভাই মারা গেছে। তো ভাই অসুখ হয়েছিল। তো সে ভাই ডাব খেতে চেয়েছিল।
কিন্তু সেই-সময় গ্রামে গাছে ডাব না থাকলে তো তখনকার দিনে এখন থেকে ৬০-৭০-৮০ বছর আগে তো বাজারে তো ডাব পাওয়া যেত না। আর গ্রামের বাজারে তো ডাব ওঠে না। এবং ডাব না খেয়েই তার ভাই মারা গেছে। এইজন্যে তার মা ডাব খায় না।
যেহেতু মা খায় না, সে-ও খায় না। সে শুনেছে। সে কিন্তু ঘটনা দেখেও নি।
তো একটা জিনিস হচ্ছে যে, তার মার ইমোশন আছে একটা, ঠিক আছে, আমার ছেলেকে আমি ডাব খাওয়াতে পারি নি, আমি ডাব খাব না। তা-ও এটা অযৌক্তিক।
কিন্তু তার মেয়ে খাবে না এটা তো আরো অযৌক্তিক। এমনকি অসুস্থ হলে যেখানে ডাব প্রয়োজন, খাবে না। তাকে স্যালাইন দিতে হবে, তবুও ডাব খাবে না। তো এই যে সংস্কার, অভ্যাস। এই সংস্কারের বৃত্ত হচ্ছে মানুষের জন্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর।
আমরা বার বার অভ্যাসের বৃত্তে জড়িয়ে যাই।
কোনো ব্যাপারেই আমরা আসলে রিস্ক নিতে চাই না। কারণ ক্রিয়েটিভিটি একটা রিস্ক। ইট মে ওয়ার্ক অর মে নট ওয়ার্ক।
তো এই রিস্কটা সাধারণ মানুষ নিতে চায় না কখনো। যে কারণে শোষকরা এটাকেই পুঁজি করে।
এই যে ব্র্যান্ডেড জিনিস আমরা কেন কিনি? আহ ব্র্যান্ড, এক ফুটানি আছে। দুই হচ্ছে এক ধরনের বদ্ধমূল ধারনা যে না, এটা খারাপ হবে না। খারাপ হলে আবার ওয়ারেন্টি আছে। সেইজন্যে।
এবং তাদের ব্যবসার মূলধন হচ্ছে আমাদের অনিশ্চয়তা, আমাদের অস্থিরতা এবং আমাদের জ্ঞানের অভাব।
তো এই সংস্কারের বৃত্ত ভাঙার জন্যে এই কোয়ান্টায়ন, এই মৌনতা, নিজের ভেতরে ডুব দেয়া। এবং ডুব দিতে দিতে দিতে আত্মার সাথে সংযুক্ত হওয়া। এবং যত প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত ধর্ম রয়েছে, ধর্মের মূল জিনিসই ছিল এই সংস্কারের বৃত্ত ভাঙা।