আসসালামু আলাইকুম। আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। এবং ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি, শুধু আমাদের ভাষা শহীদ দিবস নয়; আজ সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
তো যাদের ত্যাগের ফলে সারা পৃথিবীব্যাপী একটি দিবস প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আর তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনটা তখনই সফল হবে যখন সারা পৃথিবীর মানুষ যে ভাষারই হোক এবং সে জনগোষ্ঠী যত ক্ষুদ্র হোক তারা সবাই যখন নিজ নিজ মাতৃভাষায় গর্ব সহকারে কথা বলতে পারবে, নিজ নিজ মাতৃভাষায় লিখতে পারবে, নিজ নিজ মাতৃভাষায় চর্চা করতে পারবে। আসলে সেইদিনই ভাষা শহীদদের ত্যাগ ভাষার জন্যে যে ত্যাগ সেই ত্যাগ সার্থক হবে।
তো আমরা প্রার্থনা করব যে, পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তের যে-কোনো জনগোষ্ঠী যে-কোনো মানুষ সে যেন তার মায়ের ভাষায় নির্ভয়ে নির্ভাবনায় কথা বলতে পারে। নির্ভাবনায় লিখতে পারে এবং নির্ভাবনায় মায়ের ভাষার চর্চা করতে পারে।
তো সুবচনের চর্চা বাড়ালে কথার শুভ প্রভাব বাড়ে। অর্থাৎ কথাটা যদি সুন্দর হয় প্রভাবটা সুন্দর হবে। এবং সেই কথার প্রভাব দূরপ্রসারী হবে।
আসলে একটা সুন্দর কথা, সুন্দর বচন মানুষকে আকৃষ্ট করে। আর একটা খারাপ কথা, খারাপ বচন, খারাপ বাক্য মানুষকে মানুষ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। একটা সুন্দর কথা একটা সুন্দর বচন মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। একটা বিশ্রী বচন, বিশ্রী ভাষা বিশ্রী, কথা বিশ্রী গালি মানুষকে দুঃখিত, ব্যথিত, বিমর্ষ এবং অনেকসময় হতাশও করে ফেলে। একইভাবে একটা সুন্দর কথা ভালো কথা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
তো সুন্দর কথা যেরকম ভালো কথা তেমনি সত্য কথা। কারণ সত্য ছাড়া সুন্দর হয় না। মিথ্যা কখনও সুন্দর হয় না।
এবং এই সুন্দর বচন বা খারাপ বচন এটা সবসময় গড়ে ওঠে সঙ্গের ওপরে। বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় তাদের প্রভাব এই বচনের ওপরে সবচেয়ে বেশি পড়ে।
বস্তিতে যে বাচ্চাটি বড় হয়ে ওঠে দেখা যায় যে, ছোটবেলা থেকেই সে গালিগালাজ শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
আবার পরিশীলিত পরিবেশে যে বাচ্চা বড় হয়ে ওঠে সে বাচ্চা সুশীল এবং সুবচনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
একটি প্রাচীন গল্প আছে, সঙ্গ কীভাবে সুভাষী করে আবার সঙ্গ কীভাবে কুভাষী করে। গল্পটা বৈদিক যুগের গল্প।
তখনকার দিনে পেশাগতভাবে প্রিয় ছিল তিনটি পেশা। এক হচ্ছে কৃষি তারপরে মাছ জেলেরা মাছ ধরত; মাছের পেশা। আর শিকারি ছিল এক দল যারা বন্য পশু প্রাণী শিকার করে তার মাংস বিক্রি করত।
তো একবার হলো গ্রামের একজন মানুষ মোটামুটি ভদ্র মানুষ। সে এক শিকারির বাড়িতে গিয়েছে ভোরবেলা মাংস কেনার জন্যে; তো শিকারির বাসায় যেতেই দেখে যে একটা কাকাতুয়া।
কাকাতুয়া আমরা অধিকাংশই হয়তো এখন ছবিতে দেখেছি। কাকাতুয়া বাস্তবে দেখার সুযোগ আমাদের খুব কম হয়েছে।
তো কাকাতুয়া টিয়ার মতোই আরও সুন্দর, আরও বড়। এবং খুব মিষ্টিভাষী। সে ভাষা যা শোনে মানুষের মতোই শোনে সে ভাষা বলতে পারে। সে ভাষায় সম্বোধন করতে পারে এবং ভাষা মনেও রাখতে পারে।
তো এত সুন্দর কাকাতুয়া দেখে সেই মানুষটি খুব উল্লসিত হয়ে গেল। এবং কাকাতুয়ার খুব প্রশংসা করে ফেলল। বাহ! কত সুন্দর! তুমি কত সুন্দর! এবং প্রশংসা করার সাথে সাথে কাকাতুয়া তাকে গালিগালাজ শুরু করল অশ্রাব্য ভাষায়।
তো সে খুব বিস্মিত হলো যে এত সুন্দর পাখি আর এত বিশ্রী তার কথা!
এবং সে দ্রুত ওখান থেকে- তার মন খুব খারাপ হয়ে গেল যে এত সুন্দর পাখি এরকম গালিগালাজ করতে পারে!
খারাপ মন নিয়ে সে ভাবল যে, সাতসকালে এইরকম একটা ঘটনা ঘটল… কারণ যারা গালি শুনে অভ্যস্ত না তাদের কাছে গালিটা খুব উত্তেজক মনে হয়।
তো মন ভালো করার জন্যে বলল যে, ঠিক আছে এই সকালবেলা যখন এরকম একটা বাজে ঘটনা ঘটল সামনেই সাধুর বাড়ি। সাধুর সাথে একটু দেখা করে যাই।
তো সাধুর বাসায় যখন যাবেন যেতেই দরজাতে পা দিয়েই দেখেন যে ঐ রকম সুন্দর আরেক কাকাতুয়া পাখি বসে আছে।
তো এর আগে কাকাতুয়ার গালি খেয়েছেন। বুঝতেই পারছেন কাকাতুয়া দেখার সাথে সাথে কোনো কথা না বলে উল্টো দিকে যাওয়া শুরু করেছেন।
তো কাকাতুয়া খুব সুন্দরভাবে পেছন থেকে বলে উঠেছে, “আদাব আদাব। আপনি যাবেন না। আপনি আসুন। সাধু বাবা আছেন। আপনি আসুন। আপনি যাবেন না।”
তো এ তো অবাক! এক কাকাতুয়া বকার চোটে আমি বেরিয়ে এলাম; আরেক কাকাতুয়া আমি দেখে চলে আসছি; আর সে আমাকে আদাব আদাব বলে ডাকছে আসুন বসুন।
থামলেন এবং বিস্মিত হয়ে সেই কাকাতুয়ার দিকে তাকালেন। তাকিয়ে বললেন যে দেখো, আমি তো বুঝতেও পারছি না।
তোমারই মতো এক কাকাতুয়া সে আমাকে দেখে কি গালিগালাজ করল একটু আগে। আর তুমি আমাকে এত সুন্দরভাবে আহ্বান জানাচ্ছ, বসার জন্যে আমন্ত্রণ জানাচ্ছ। অদ্ভুত ব্যাপার!
তো কাকাতুয়া হেসে বলল- কারণ সাধুর কাকাতুয়া তো আর কি! সেও মোটামুটি কাউন্সেলিং বোঝে, তথ্য বোঝে। কারণ সৎসঙ্গে স্বর্গবাস অসৎসঙ্গে সর্বনাশ। তো এখন সে কাকাতুয়া বলল যে, আসলে দোষ ঐ কাকাতুয়ার না। দোষ সঙ্গদোষ।
আমরা একই মায়ের পেটের দুই ভাই। ভাগ্যক্রমে আমি সাধুবাবার হাতে এসে পড়েছি। আর ও পড়েছে শিকারির হাতে। প্রত্যেকদিন ভোরবেলা থেকে তার গালি শিকারীর গালিগালাজ শুরু হয়। এবং সে ঐ গালিগালাজই শিখেছে।
আর আমার ভোর শুরু হয় সাধুবাবার বেদের গান শুনে, সুন্দর সুন্দর কথা শুনে, সুন্দর সুন্দর উপদেশ শুনে। তো দোষ ওর নয়। দোষ সঙ্গের।
তো আসলে একজনের ভাষা একজনের বচন তার সঙ্গটাকে প্রতিনিধিত্ব করে। আপনার বচন আপনার সঙ্গকে প্রতিনিধিত্ব করে। আপনার বচন আপনার সমাজ, পরিবার ও দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে।