চারপাশের অস্থিরতা, রাগ-ক্ষোভ, নেতিবাচকতায় মানুষ যখন দিশেহারা তখন একটু প্রশান্তি একটু ভালো লাগার জন্যে মানুষ ছুটে আসে প্রশান্তির ভূবন আলোকায়নে। জ্যৈষ্ঠের কড়া রোদ, ট্রাফিক জ্যাম কোন কিছুই যেন আটকাতে পারে না। সকাল দুপুর কি সন্ধা প্রতিটি সেশনেই হলরুম থাকে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। আলোকfয়নে প্রতি সপ্তাহেই উপস্থিতি হাজারেরও বেশি। নতুন আর পুরাতনের উপস্থিতিতে আলোকায়ন চত্বর যেন হয়ে থাকে সরগরম।
গত ৮ মে দুপুর ১২টার সেশনটি ছিলো একটু ব্যতিক্রম। সেদিন আলোকায়নে আলোচনা করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষা হামিদা আলী। প্রায় অর্ধশতক ধরে তিনি আছেন শিক্ষকতায়। দীর্ঘ ২১ বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন ভিকারুননিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজে। এ প্রতিষ্ঠানটির আজকের অবস্থান মূলত তার হাতেই করা।
স্বনামধন্য সাউথ পয়েন্ট স্কুলেরও তিনি প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। দায়িত্বে আছেন এখনো। ৭৫ বছর বয়সেও ঈর্ষণীয় কর্মক্ষমতার অধিকারী এই মানুষটি আলোকায়নে বলেছেন তার জীবন, অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধির কথা। তার আলোচনারই কিছু অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্যে।
একটি মাত্র মেয়ে ছিলো আমার। বিয়ের পর স্বামীর সাথে আমেরিকাপ্রবাসী হয়েছিলো। প্রথম সন্তানের মা হলো। দ্বিতীয়বারের মতোও মা হতে যাচ্ছিলো। কিন্তু দুঃখজনকভাবে একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মেয়েটি আমার মারা গেলো।
স্বাভাবিকভাবেই একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে আমি উদভ্রান্তের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। ছুটে গেলাম আমেরিকায়। মনে হলো স্বাভাবিক জীবনে বোধ হয় আর কখনো ফিরতে পারবো না। কিন্তু ভিকারুন্নেসার মেয়েরা আবার পুনর্জন্ম দিলো।
প্রতিদিন সকালে আমেরিকায় ছাত্রীদের একটা দুটা করে ফোন পেতাম। আপনার একমাত্র মেয়ে নেই আমরা তো আছি। আমরাও তো আপনার মেয়ে। আপনি ফিরে আসেন। সত্যি সত্যি ওদের টানে আবার ফিরে এলাম। আমি যখন এলাম তখন ভিতরে ছিলো নীরব কান্না….কিন্তু সেই সাথে পেয়েছি অনেক অনেক ভালোবাসা। অনেক কিছু।
২০০২ সালে চাকুরি জীবন শেষ হলো। ৭ জুলাই, ২০০২ অবসর নিলাম আর আগস্টের ১ম সপ্তাহেই সাউথ পয়েন্ট স্কুল এন্ড কলেজের কাজ শুরু করলাম।
ইতোমধ্যেই আমি শারীরিকভাবে কিছুটা হতাশ হলাম। কাজ করছিলাম, কিন্তু নিরাপদ বোধ করছিলাম না। তখনই আমার কাছে কোয়ান্টামের ডাক এলো এক পরিচিত শিক্ষকের মাধ্যমে। তিনি কোর্স করেছেন। তিনি বললেন আপনার এই শারীরিক সমস্যাগুলো কোর্স করলেই ভালো হয়ে যাবে।
১ম দিন গিয়েই মনে হলো আমি যেন কোয়ান্টাম পরিবারের সদস্য হয়ে গেছি। আপনারা যারা নতুন এসেছেন আপনাদের উপলব্ধির জন্যে বলছি, আপনারা আসুন, দেখবেন আপনাদেরও একই অনুভূতি হবে।
আমি যখন কোর্স করলাম তখন অনেকেই অবাক হয়েছেন, আপনিও শেষ পর্যন্ত! তাদেরকে আমি বলেছি, হ্যাঁ, আমি কোয়ান্টামে এবং আমি খুব ভালো আছি। এই কথাটা অনেককেই উদ্বুদ্ধ করেছে, অনেকেই কোর্স করেছে, এবং সবাই বলেছে আমরাও ভালো আছি।
কোয়ান্টামে এসে আমি এক নতুন জগত পেয়েছি যে জগতটা আমার জানার বাইরে ছিলো। কোয়ান্টাম কোর্সে অংশগ্রহণ করে আমি যা বুঝেছি, জীবন আমাদের একটাই। একমাত্র আমরা নিজেরাই পারি এই জীবনটাকে সমৃদ্ধ করতে, সফল করতে। সেখানে ইচ্ছাটা থাকতে হবে, আগ্রহের সাথে সততাও থাকতে হবে এবং কাজটি সুনিপুণভাবে শেষ করার যে ব্যবস্থা সেটাও থাকতে হবে।
সেই জীবনের একটা শ্লোগান ইতোমধ্যেই কোয়ান্টাম থেকে আমরা পেয়েছি, “সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন র্কম ব্যস্ত সুখী জীবন”। আমরা জীবনের জন্যে যুদ্ধ করছি। কেন করছি? একটি সুখী জীবনের জন্যে। জীবনে আমরা যেন সুখী হই। সেই সুখকে খুঁজতে গিয়ে আমাদের কী করতে হবে? কর্মব্যস্ত থাকতে হবে। কারণ যারা কর্মী, যারা কাজ করেন, তারা আহরণ করেন।
আর্থিক দিক তো আছেই। তাছাড়া মানুষের সংগে মেশা, সৌহার্দ্য, ভালোবাসা…কর্মব্যস্ততা আমাদের থাকতে হবেই। জীবনকে সমৃদ্ধ করতে হলে আমাদের কষ্ট করতে হবে। সুখী জীবনের জন্যে কর্মব্যস্ত থাকতে হলে মনকে প্রশান্ত রাখতে হবে। মনকে প্রশান্ত রাখতে প্রয়োজন সুস্থ জীবন। যে চেষ্টা করে পরিশ্রম করে আল্লাহ তাকে সকল কাজে সাহায্য করেন এবং আমরা জীবনে জয়ী হতে পারি।
জীবনের চাহিদা অনেক বেশি। শিশু জন্মের সাথে সাথে কেঁদে উঠে অন্ন দাও, বস্ত্র দাও, বাসস্থান দাও। মানুষের চাওয়া পাওয়ার প্রতিফলন ঘটে তার পরিবারে। পরিবার যদি সুস্থ থাকে পরিবারের মানুষের মন যদি প্রশান্ত থাকে সবাই যদি ব্যস্ত থাকে, তাহলেই একটি সুখী পরিবার পাওয়া যাবে।
আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য একটি ভালো ও সুস্থ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গড়া, নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের অনেক আশা। বাংলাদেশে সব আছে। দেশকে সমৃদ্ধ করার জন্যে সব আয়োজন আছে। দেশকে আমরা ভালোবাসতে পারি না, তাই করণীয় কাজ আমরা করি না। আর না করার কারণে আমরা প্রতিদিন পিছিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু দেশকে সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টা আমাদের থাকতে হবে।
জীবনে যদি পরিমিত বোধ জাগ্রত করা যায়, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে যার যা প্রাপ্তি তা নিয়েই যদি সন্তুষ্ট থাকা যায় তবে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয় না।
আমরা আমাদের সন্তানকে সঠিকভাবে মানুষ করতে পারছি না । চাওয়ার আগেই বাচ্চাদের হাতে সব কিছু তুলে দেওয়া হচ্ছে। এতে করে তাদের ভেতর পরিমিত বোধ জাগ্রত হচ্ছে না। বাবা মায়ের আহ্লাদ সন্তানকে করূণ পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক এই সংসারে টিকে থাকার জন্যে তাকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। শিশুদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ ও আত্মশক্তি জাগাতে হবে।
আমরা আলোকিত মানুষ চাই। মানুষ গড়ার সঠিক কারিগর চাই। সুনিপুণ ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্র চাই। আমাদের সমাজকে কলুষ মুক্ত করে, যেখানে যে আবর্জনা অছে সবকিছু পরিহার করে, আমরা যেন সুস্থভাবে বাঁচতে পারি। তাহলেই বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হবে। আমাদের এখনও আশা তরুণ প্রজন্ম এসে এমন কিছু করবে যাতে, দেশ সোনার বাংলাদেশ হবে। গৌরবে গৌরবান্বিত হয়ে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।