আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যাটা কোথায়? আমরা স্বাধীন হওয়ার আগে ২০০ বছর ইংরেজদের গোলাম ছিলাম এবং কিছু সময় পাকিস্তানিদের গোলাম ছিলাম। ২০ বছর পাকিস্তানিদের গোলাম, আর ২০০ বছর ইংরেজদের গোলাম ছিলাম। ইংরেজরা যা শিখিয়েছে এবং পাশ্চাত্যের মিডিয়া যা বলে সেটাকেই আমরা মনে করি ‘সত্য’।
আমরা শুধু বুঝি না যে, মিডিয়াগুলো হচ্ছে শোষকদের ক্রীড়নক বা শোষকদের হাতিয়ার। মিডিয়াগুলোর সাধারণত মালিক হচ্ছে শোষকরা। তারা সেটাই বলে, যেটা বললে আমরা হীনম্মন্যতায় ভুগব; তাদেরকে পূজনীয় মনে করব, নম নম করব এবং দাস হয়ে থাকব। তারা এমন তথ্য আমাদেরকে দেয়, যার ফলে আমরা অবিদ্যায় আক্রান্ত হই।
ক্যারেন আর্মস্ট্রং যে কথাটি এত স্পষ্ট করে বলেছেন, আমরা কি তা স্পষ্ট করে বুঝেছি? কয়জন বুঝেছি? কয়জন তার মতো বলতে পারব?
আমরা কি বলতে পারব, হাঁ, আমি আমার রসুলকে ভালবাসি। কয়জন পারব? বরং আমরা সংকোচ বোধ করি এই ভেবে, যদি বলি যে, ভালবাসি নবীজীকে, তো যদি জঙ্গি বলে ফেলে। কেন বলতে পারব না যে, আমি আমার নবীকে ভালবাসি। কেন বলতে পারব না যে, তিনিই সঠিক মানুষ?
এই যে অশান্তি বা জাহেলিয়াত, এই জাহেলিয়াত থেকে বাঁচানোর জন্যে তিনি হচ্ছেন সঠিক মানুষ। তাঁর চিন্তা এবং আদর্শ হচ্ছে সঠিক পথ। কেন আমরা তা বলতে পারি না? কারণ ২০০ বছর ধরে ইংরেজদের অনৈতিক শিক্ষা ও অধর্মের শিক্ষা আমাদেরকে হীনম্মন্য বানিয়ে ফেলেছে।
আগে তারা জোর করে কৃতদাস ধরে নিয়ে যেত আফ্রিকা থেকে, আমেরিকাকে আবাদ করার জন্যে। এখন আমরা নিজেরা পালিয়ে চলে যাচ্ছি, জান দিয়ে চলে যাচ্ছি। অবস্থা এমন- জীবন দিয়ে ফেলব আমেরিকায় যাওয়ার জন্যে, ইউরোপে যাওয়ার জন্যে। ওখানে গিয়ে কী করব- দাসের জীবন। শতকরা ৯৯ জনের ক্ষেত্রে দাসের জীবনের চেয়ে বেশি কিছু নয়। আর শতকরা একজনকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয় দেখানোর জন্যে।
যে-রকম, মানুষ নিজে কিন্তু বন্য হাতি ধরে না। পোষা হাতির মাধ্যমে সে বন্য হাতি ধরে। পোষা হাতিকে ভালোমতো খাওয়ানো হয় বন্য হাতি ধরার জন্যে। আমাদেরও অবস্থা হচ্ছে সেরকম।
অপপ্রচারের ফলে আমরা নিজেরা এখন হীনম্মন্যতায় ভুগি।
আমাদের যে-কাউকে জিজ্ঞেস করেন যে, সভ্যতার শুরু কোথায়? প্রায় সবাই বলবেন, গ্রিস থেকে। গণতন্ত্রের শুরু কোথায়? এর উত্তরও দেবেন, গ্রিস। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা অধিকাংশই তা-ই বলেন। আমাদের আগে পাঠ্যপুস্তকেও তা-ই লেখা হতো যে, সভ্যতার শুরু হচ্ছে গ্রিস থেকে। আর আমরা সেটাই বিশ্বাস করি কেন? কারণ আমরা জানি না তো সভ্যতার শুরু কোত্থেকে। গ্রিসে কোত্থেকে গেল?
সভ্যতা গেল কোত্থেকে- আমরা জানি না। গ্রিসের সভ্যতা গেল ব্যাবিলন থেকে। ব্যাবিলনীয় সভ্যতা আসিরীয় সভ্যতা একই সভ্যতা। মেসোপোটেমিয়া মানে দজলা ফোরাত। টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেতিস এই দুই নদীর মোহনা থেকে সভ্যতা গেল গ্রিসে।
গ্রিক বা ইউরোপিয়ানদের নিজস্ব কোনো ভাষা ছিল না। এখন থেকে ৫০০০ বছর আগে ব্যাবিলনে গ্রিক ভাষার সৃষ্টি হলো। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ বছর আগে সে ভাষা ব্যাবিলন থেকে গ্রিসে গেল।
এখন থেকে ৩৫০০ বছর আগে, খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সালে সবচেয়ে প্রাচীন লাইব্রেরি ছিল মেসোপোটেমিয়ান রাজ্য আক্কাদে। পোড়ামাটির ফলক বা প্লেটে লেখা বই। লিখে মাটিটাকে পুড়িয়ে বই বানানো হতো। আক্কাদের লাইব্রেরিতে প্রায় ৩০ হাজার এমন বই পাওয়া গেছে।
এখন থেকে ৪০০০ বছর আগে সর্বপ্রথম আইন বিধিবদ্ধ করা হয়। সেটি গ্রিসে নয়, রোমে নয়, সেটা হয় হাম্মুরাবির আমলে, ব্যাবিলনে।
ব্যাবিলনীয় সভ্যতার ভাষা ছিল আরামাইক বা এরামাইক। এই এরামাইক ভাষা থেকেই গ্রিক হিব্রু ল্যাটিন আরবি ভাষার সৃষ্টি। ব্যাবিলনে ভাষার যে লিখিত রূপ এটা হচ্ছে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ বছর আগের। আর গ্রিসে ভাষার লিখিত রূপ হচ্ছে খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ বছর আগের। তো প্রাচীন কে?
এখন থেকে ২৫০০ বছর আগেও গ্রিক ভাষা লেখা হতো ডান দিক থেকে বামে। কারণ গ্রিক ভাষা সৃষ্টি হয়েছে এরামাইক ভাষা থেকে। এরামাইক লেখা হতো ডান দিক থেকে বামে। এখন এরামাইক থেকে হিব্রু, হিব্রু থেকে আরবি। এরামাইক থেকে আরবি। আরবি লেখা হয় ডান দিক থেকে বামে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ বছর আগে গ্রিক ভাষা লেখা শুরু হলো বাম দিক থেকে ডানে। এবং গ্রিক বর্ণমালার প্রথম অক্ষর হলো আলফা। আরবি প্রথম অক্ষর কী? আলিফ। আলিফ আর আলফার মধ্যে তফাতটা কোথায়?
আরবি যেটা আলিফ হা আইন ওয়াও ইয়া। এই পাঁচটি হচ্ছে আরবিতে Consonant-ব্যঞ্জনবর্ণ। এই পাঁচটি ব্যঞ্জনবর্ণ ইউরোপীয় সব ভাষায় হয়ে গেল স্বরবর্ণ। ধরুন, আলিফ হা আইন ওয়াও ইয়া। Vowel কয়টা- এ ই আই ও ইউ। আলিফ হা আইন ওয়াও ইয়া, এই পাঁচটা ব্যঞ্জনবর্ণ ইউরোপের সবগুলো ভাষায় হয়ে গেল স্বরবর্ণ।
হয় কী, কখনো কেউ জাতে ওঠার জন্যে বা নিজেকে আলাদা করার জন্যে কী করে- যে-রকম যখন একটু টাকাপয়সা হয় এই যে ধরুন, সব জায়গায় পৃথিবীতে ইংল্যান্ডের দাস যে দেশগুলো ছিল সেখানে গাড়ি চালায় ডান হাতে। অর্থাৎ ড্রাইভারের সিট থাকে গাড়ির ডান দিকে। গাড়ি যখন চলছে গাড়ির ডান পাশে হচ্ছে ড্রাইভারের সিট। আমেরিকাতে কিন্তু বাম হাতে। আমেরিকানরা দেখল যে কী, আমরা এখন জাতে উঠেছি, ইংল্যান্ডের চেয়ে আমরা কম কী, ডান হাত হবে না, বাম হাত হবে। ভাষার ক্ষেত্রেও হলো তা-ই।
এশিয়ানরা সব ইউরোপের ঐ এলাকার সাথে সংযুক্ত যে এলাকাগুলো ব্যাবিলন থেকে শুরু করে আরব ও পারস্য এলাকার সাথে যুক্ত। তারা সবাই ডান দিক থেকে লেখে। ইউরােপের লোকেরা বলল যে না, এরা ডান দিক থেকে লেখে। অতএব আমরা লিখব বাম দিক থেকে। তফাতটা এই। আর আচ্ছা এদের এটি Consonant. এটি আমাদের নাই। ঠিক আছে, এটিকে আমাদের Vowel বানাও।
শূন্য ডেসিমেল পদ্ধতি বা দশমিক পদ্ধতি। এই দশমিক পদ্ধতি আবিষ্কার হলো বাংলায়। বরাহ মিহির আর্যভট্ট। এরা শূন্যের আবিষ্কার ও ব্যবহার করলেন এখন থেকে ১৫০০ বছর আগে। এখান থেকে শূন্য বা ডেসিমেল পদ্ধতি আরবরা নিয়ে নিল যে, এটা একটি দারুণ বিষয়। তারা নিল ৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে। তারপরে আরব থেকে গেল ইউরোপে।
এখন আমরা জানি দশমিক, ডেসিমেল, শূন্যের বা ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার করল ফরাসিরা। তারা চালু করল মিটার, কিলো আর লিটার, শূন্য দিয়ে। কিন্তু শূন্যের আবিষ্কার হয় এই বাংলায়।
আসলে আমরা জানি না যে, সভ্যতার শুরু আমরা করেছি। সভ্যতার শুরু এই এলাকায় হয়েছে!
[০১ জুন ২০১৮, গ্রাজুয়েট আখেরি দোয়া, আইডিইবি ভবন, ঢাকা]