বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার, বিশিষ্ট অধ্যাপক, গবেষক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এর জন্মদিন
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে আজ বছরের ১৫৪তম (অধিবর্ষে ১৫৫তম) দিন। এক নজরে দেখে নিই ইতিহাসের এই দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা, বিশিষ্টজনের জন্ম ও মৃত্যুদিনসহ আরও কিছু তথ্যাবলি।
১৯১৫ : ব্রিটিশ সরকার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৪৬ : ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতারা ব্রিটিশ সরকার প্রস্তাবিত ভারত বিভাজন প্রস্তাব মেনে নেন।
১৯১৯ : ছায়া দেবী (চট্টোপাধ্যায়), ভারতীয় প্রখ্যাত চলচ্চিত্রাভিনেত্রী।
১৯২০ : অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার, বিশিষ্ট অধ্যাপক, গবেষক ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ভূতপূর্ব সভাপতি।
১৯২৬ : অ্যালেন গিন্সবার্গ, মার্কিন কবি এবং লেখক।
১৯৮৬ : রাফায়েল নাদাল, স্পেনের একজন পেশাদার টেনিস খেলোয়াড়।
১৯২৪ : জার্মান ও চেক উপন্যাস ও ছোটগল্প লেখক ফ্রান্ৎস কাফকা।
১৯৬১ : বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি কৃষিবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও লেখক কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৯৬৩ : তুর্কি কবি এবং লেখক নাজিম হিকমত।
১৯৬৯ : সাহিত্যিক মুহম্মদ আবদুল হাই।
২০১৪ : প্রবীণ সাংবাদিক বেনজীর আহমেদ।
২০১৬ : মার্কিন বক্সার মোহাম্মদ আলী।
বিশ্ব সাইকেল দিবস।
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার, বিশিষ্ট অধ্যাপক, গবেষক ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির ভূতপূর্ব সভাপতি। নয় খণ্ডে প্রকাশিত তার বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত একটি হিমালয়-প্রতিম কীর্তি এবং এই গ্রন্থটির জন্যে তিনি সারস্বত সমাজে শ্রদ্ধার বিশেষ শ্রদ্ধার আসন অধিকার করেন।
জন্মগ্রহণ করেন ১৯২০ সালের ৩ জুন উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁতে। বাবা অক্ষয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম চারুবালা দেবী। ১৯২৫ সাল থেকেই তারা হাওড়ায় বসবাস করতে থাকেন। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আমৃত্যু হাওড়াতেই থেকেছেন। হাওড়া জেলা স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। বাংলায় তার তার পাওয়া ৭৭ শতাংশ নম্বর ছিল জেলার মধ্যে এই বিষয়ে সর্বোচ্চ। এরপর তৎকালীন রিপন কলেজ, বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে তিনি আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই পরীক্ষায় বাংলা ও আসাম-এর পরীক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক স্তরে বঙ্গভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনোর সিদ্ধান্ত নেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হন এবং স্বর্ণপদক লাভ করেন। কলেজে পড়ার সময়েই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সায়গন থেকে প্রদত্ত বক্তৃতাগুলো তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন এবং সেগুলো ফরোয়ার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ব্রিটিশ শাসন ও যুদ্ধপরিস্থিতির নিরিখে এ ছিল এক দুঃসাহসিক দেশপ্রেমের পরিচয়।
১৯৪৫ সালে নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধ্যাপনা জীবনের শুরু। এরপর রিপন কলেজে পড়ান। ১৯৫৭ সালে যোগদান করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। ১৯৮৫ সালে সেখান থেকে তিনি অবসর নেন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের মৃত্যুর পরে ২০০২ সালে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতি হয়েছিলেন।
লেখা, গবেষণার পাশাপাশি অধ্যাপনার ভূমিকাতেও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় চিরস্মরণীয়। হাওড়া গার্লস কলেজ, নবদ্বীপের বিদ্যাসাগর কলেজ ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়— যেখানেই গেছেন নিজের পরিচয় রেখে গেছেন। হাওড়া গার্লস কলেজে থাকাকালীন তার সহকর্মী ছিলেন স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ। সে সময় বেশ কাছ থেকে দেখেছেন কবিকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অধ্যাপক’-এর পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন তিনি। আজও তার সুযোগ্য ছাত্ররা স্মরণ করেন তাদের প্রিয় অধ্যাপককে। প্রিয় অধ্যাপক যেমন ছিলেন নিজের পড়াশোনায় সিরিয়াস, তেমনই ছিলেন ছাত্রদরদি। কারোর যদি খরচের অসুবিধা হতো, এগিয়ে আসতেন তিনি। নিজের বাড়ি থেকে বই দিয়ে দিতেন পড়ার জন্যে। ছাত্ররাই যে তার ‘অ্যাসেট’, সে কথা তিনি বারবার বলতেন।
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, নয় খণ্ডে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের বিস্তারিত ইতিহাসগ্রন্থ। এই গ্রন্থের দুটি সহজপাঠ্য সংস্করণ বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত ও বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্তও তার রচনা। তার রচিত অন্যান্য গ্রন্থগুলো বাংলার নবজাগরণ বিষয়ে রচিত। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য – ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ ও বাংলা সাহিত্য, বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর, সাহিত্য জিজ্ঞাসায় রবীন্দ্রনাথ হাওড়া শহরের ইতিহাস (২ খণ্ড) ইত্যাদি। তার সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ গল্প শ্রেষ্ঠ লেখক, জীবনের গল্প গল্পের জীবন, সত্যেন্দ্র রচনাবলী, বিদ্যাসাগর রচনাবলী, সঞ্জীব রচনাবলী উল্লেখযোগ্য। স্মৃতি বিস্মৃতির দর্পনে নামে তার একটি আত্মকথাও রয়েছে। এছাড়া ভারতীয় পণ্ডিত বেদ প্রকাশ উপাধ্যায় রচিত কল্কি অবতার ও মোহাম্মদ সাহেব বইটি গবেষণা পূর্বক হিন্দুধর্মগ্রন্থ বেদ ও পুরাণে মুহাম্মদ নামে অনুবাদ ও সম্প্রসারণ করেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতিত্ব করা ছাড়াও তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গবেষক ছিলেন। একাধিকবার সম্মেলন উপলক্ষে ও অতিথি-অধ্যাপনার জন্যে বিদেশেও গিয়েছেন। ১৯৮১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক বুদ্ধমহাভাব মহাসম্মেলনে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে ভাষণ দেন। চিন্তাবিদ ও গবেষক হিসাবে একাধিক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন অসিতকুমার। তার স্ত্রী হাওড়া গার্লস কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপিকা বিনীতা গঙ্গোপাধ্যায়, তিনিও লেখালেখির সাথে জড়িত ছিলেন।
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার বিশাল সংখ্যক সাহিত্যের ইতিহাস একসঙ্গে যেভাবে তুলে এনেছেন; তাতে করে বাঙালি, বাংলা সাহিত্য তার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে। বাংলা ভাষার গন্ধ, শব্দ তিনি ধারণ করেছিলেন নিজের ভেতর। সব মিলিয়ে জীবনটাকে উপভোগ করে গেছেন প্রাণভরে। ২০০৩ সালের ২১ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র: সংগৃহীত