ভারতীয় উপমহাদেশের একজন স্মরণীয় শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও ভাষাতত্ত্ববিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে আজ বছরের ১৯১তম (অধিবর্ষে ১৯২তম) দিন। এক নজরে দেখে নিই ইতিহাসের এই দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা, বিশিষ্টজনের জন্ম ও মৃত্যুদিনসহ আরও কিছু তথ্যাবলি।
১৯৪৬ : ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা
১৯৫৭ : ড. হীরালাল চৌধুরীর গবেষণায় ভারতে মাছ চাষে প্রণোদিত প্রজনন পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়
১৯৬২ : যোগাযোগ উপগ্রহ ‘টেলিস্টার’ মহাশূন্যে উৎক্ষেপণ করা হয়
১৯৮৯ : বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সংবিধানের ৯ম সংশোধনী পাস
১৮৯৩ : কেশবচন্দ্র নাগ, বাংলার প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ ও গণিতের সর্বাধিক প্রচলিত পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা
১৮৮৫ : ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলাদেশি বহুভাষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ
১৯০২ : কুর্ট আলডার, নোবেলজয়ী জার্মান রসায়নবিদ
১৯২৫ : ডা. মাহাথির মোহাম্মদ, মালয়েশীয় রাজনীতিবিদ ও মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী
১৯৩১ : মতি নন্দী, ভারতের বাঙালি লেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিক
১৮৯৩ : শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক নওয়াব আব্দুল লতিফ
১৯৭৭ : প্রখ্যাত বাঙালি চিত্রশিল্পী অতুল বসু
২০১৪ : ভারতীয় অভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী এবং নৃত্য পরিচালক জোহরা সেহগল
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের একজন স্মরণীয় শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও ভাষাতত্ত্ববিদ। তিনি ছিলেন বাঙালি ও বাংলাদেশি ব্যক্তিত্ব, বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক। তিনি চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া নামে পরিচিত ছিলেন। বিবিসি বাংলার জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ বিশ বাঙালির তালিকায় ১৬তম স্থানে আসেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার পেয়ারা গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে। বাবা মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন মধ্যযুগীয় পীর গোরাচাঁদের দরবার শরিফের খাদেম। মায়ের নাম হুরুন্নেসা।
পৈতৃক পেশা থেকে বেরিয়ে ব্যতিক্রমী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষা ও জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হন। ছোটবেলায় ঘরোয়া পরিবেশে উর্দু, ফারসি ও আরবি শেখেন এবং স্কুলে সংস্কৃত পড়েন। হাওড়া জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ পাস করার পর তিনি হুগলি কলেজে পড়াশোনা করেন। কিন্তু অসুস্থতার কারণে অধ্যয়নে সাময়িক বিরতির পর তিনি কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বি.এ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ পাস করেন। এর দুই বছর পর তিনি বি.এল ডিগ্রিও অর্জন করেন।
কর্মজীবন শুরু করেন যশোর জেলা স্কুলের শিক্ষক হিসেবে। এরপর সীতাকুন্ড হাইস্কুলে কিছুদিন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করার পর তিনি চবিবশ পরগনা জেলার বশিরহাটে আইন ব্যবসায়ে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি পৌরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে শরৎচন্দ্র লাহিড়ী গবেষণা-সহকারী হিসেবে কাজ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন। সেটি ছিল ১৯২১ সাল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা তার জীবনের সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এখানে শিক্ষাদানকালে তিনি বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে মৌলিক গবেষণা করেন এবং ১৯২৫ সালে প্রমাণ করেন যে, গৌড়ী বা মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।
১৯২৬ সালে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্যে তিনি ইউরোপ যান। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বৈদিক ভাষা, বৌদ্ধ সংস্কৃত, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, তিব্বতি ও প্রাচীন পারসিক ভাষা এবং জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন খোতনি, প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা শেখেন। ১৯২৮ সালে তিনি বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদাবলি বিষয়ে গবেষণা করে প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। একই বছর ধ্বনিতত্ত্বে মৌলিক গবেষণার জন্যে তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমাও লাভ করেন এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। অতঃপর সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগ ভেঙে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ হলে ১৯৩৭ সালে তিনি বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ হন এবং ১৯৪৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি আবারো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগীয় প্রধান ও কলা অনুষদের ডীন হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ (১৯২২-২৫) ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে (ফরাসি ভাষার) খণ্ডকালীন অধ্যাপক (১৯৫৩-৫৫) হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫-৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস নিযু্ক্ত হন।
অধ্যাপনার বাইরে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ করাচির উর্দু উন্নয়ন সংস্থার ‘উর্দু অভিধান প্রকল্প’, (১৯৫৯-৬০), ঢাকার বাংলা একাডেমীর ‘পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্প’ (১৯৬০) এবং ‘ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্প’-এ (১৯৬১-৬৪) সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষক (১৯২১-২৫), ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রভোস্ট (১৯৪০-৪৪), ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সদস্য (১৯৬৩-৬৪), ইসলামিক একাডেমীর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য (১৯৬৩-৬৪), বাংলা একাডেমীর বাংলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার ও দাউদ সাহিত্য পুরস্কার কমিটির স্থায়ী চেয়ারম্যান ছিলেন।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ ছিলেন। তার জীবদ্দশায় তিনি ইংরেজি, লাতিন, আরবি, উর্দু, ফারসি, জার্মানি, ফরাসি, হিব্রু, গ্রিক, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, সিংহলি, সিন্ধিসহ প্রায় ২৪টি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। এর মধ্যে ১৮টি ভাষাতে তার অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল এবং সেই ভাষাগুলোতে তিনি অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারতেন। কোটি বাঙালির প্রাণের স্পন্দন এই বাংলা ভাষায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কৃতিত্ব যেন ভোলার মতো নয়।
১৮টি ভাষায় সুপণ্ডিত হলেও গভীরভাবে ভালোবাসতেন বাংলাভাষাকে। বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই ছিলেন সোচ্চার। ১৯৪৭ সাল থেকেই তিনি এ বিষয়ে তীব্র দাবি উত্থাপন করছিলেন বিভিন্ন প্রবন্ধ ও ভাষণে। তিনি বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হয়ে উর্দু বা আরবী হলে তা হবে গণহত্যার শামিল। তিনি পাকিস্তান সরকারের সকল প্রকার ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে বাংলা ভাষার পক্ষে তার সংগ্রাম চালিয়ে যান। ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের জন্যে তিনি ছিলেন প্রধান প্রেরণা। একুশে ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের পর তিনি প্রথম কালো ব্যাজ ধারণ করেন।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সবসময়ই সাহিত্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এম.এ পাস করার পরই তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক হন। ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন। তিনি উর্দু অভিধান প্রকল্পেরও সম্পাদক ছিলেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেক বই লিখেছেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো-
ভাষা ও সাহিত্য
বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত
দীওয়ানে হাফিজ
রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম
নবী করিম মুহাম্মাদ
ইসলাম প্রসঙ্গ
বিদ্যাপতি শতক
বাংলা সাহিত্যের কথা (২ খণ্ড)
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
ব্যাকরণ পরিচয়
বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান
মহররম শরীফ
টেইল ফ্রম দি কুরআন
Buddhist Mystic Songs (১৯৬০)
Hundred Sayings of the Holy Prophet
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমেরিটাস অধ্যাপক পদ লাভ করেন। একই বছর ফ্রান্স সরকার তাকে সম্মানজনক পদক ‘নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্টস অ্যান্ড লেটার্স’ দেয়। ঢাকা সংস্কৃত পরিষদ তাকে ‘বিদ্যাবাচস্পতি’ উপাধিতে ভূষিত করে। পাকিস্তান আমলে তাকে ‘প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পদক (১৯৫৮)’ ও মরণোত্তর ‘হিলাল ই ইমতিয়াজ খেতাব’ প্রদান করা হয়। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স তাকে সম্মানিত সদস্য (ফেলো) রূপে মনোনয়ন করে কিন্তু পাকিস্তান সরকারের অনুমতি না থাকায় তিনি তা গ্রহণ করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে মরণোত্তর ‘ডি. লিট’ উপাধি দেয়। ১৯৮০ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। তিনি ‘চলন্ত শব্দ কল্পদ্রুম’ বলেও পরিচিত।
একাধারে শিক্ষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক, আইনজীবী, অনুবাদক, কবি, সাহিত্যিক, লোকবিজ্ঞানী, দার্শনিক, জ্ঞানতাপস ও ভাষাসৈনিক হিসেবে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সর্বস্তরের মানুষের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছিলেন। উদার মনোভাবের জন্যে সব ধর্মের মানুষের হৃদয়ে তিনি নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছেন। ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি’, তার এ বাণীই প্রমাণ করে যে বাঙালি জাতির প্রতি তার কত ভালোবাসা এবং তিনি কতটা মহৎ, দেশপ্রেমিক ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
‘জ্ঞানতাপস’ হিসেবে পরিচিত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ভাষাক্ষেত্রে তার অমর অবদানকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদুল্লাহ হল। এছাড়াও তার নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কলা ভবনের নামকরণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল চত্বরে মহান এই মনীষীকে সমাহিত করা হয়।
সূত্র: সংগৃহীত