বাংলাদেশি পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ কাজী মোতাহার হোসেন এর জন্মদিন
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে আজ বছরের ২১১তম (অধিবর্ষে ২১২তম) দিন। এক নজরে দেখে নিই ইতিহাসের এই দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা, বিশিষ্টজনের জন্ম ও মৃত্যুদিনসহ আরও কিছু তথ্যাবলি।
১৫০২ : চতুর্থ সমুদ্রযাত্রায় ক্রিস্টোফার কলম্বাস হন্ডুরাসের উপকূলবর্তী গুয়ানাজা দ্বীপে অবতরণ করেন।
১৯৩৫ : বিশ্বখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইনের বই প্রথম প্রকাশিত হয়।
১৯৮০ : পূর্ব অষ্ট্রেলিয়ার দ্বীপ দেশ ভানুয়াটো স্বাধীনতা লাভ করে।<
১৮৬৩ : হেনরি ফোর্ড, উদ্ভাবক, মার্কিন ব্যবসায়ী এবং বহু উৎপাদন পদ্ধতিতে ব্যবহৃত বিন্যাসকরণ সজ্জার জনক।
১৮৯৭ : কাজী মোতাহার হোসেন, বাংলাদেশি পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ।
১৮৯৮ : হেনরি মুর, ইংরেজ শিল্পী।
১৯৪৭ : আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার, অস্ট্রিয়ান-আমেরিকান বডিবিল্ডার, অভিনেতা ও মডেল।
১৯৫৫ : ববিতা, বাংলাদেশি অভিনেত্রী।
১৭৭১ : ইংরেজ কবি টমাস গ্রে।
১৯৫৬ : বাঙালি পণ্ডিত ও বাঙলা শব্দকোষ প্রণেতা যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি।
১৯৮০ : বাঙালি চারুশিল্পী গোপাল ঘোষ।
১৯৮৭ : ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়।
২০২০ : ভারতের লেপচা সংস্কৃতির ধারক, বাহক ও সংরক্ষক সোনম শেরিং লেপচা।
কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একজন বাংলাদেশি পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। তিনি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সঙ্গীত, দাবা, বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তিনি অসাধারণ ভূমিকা রাখেন। মুক্তবুদ্ধি আন্দোলনের তিনি ছিলেন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু। তিনি একনাগাড়ে প্রায় ৩০ বছর অবিভক্ত বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানে একক চ্যাম্পিয়ন ছিলেন।
জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার লক্ষ্মীপুর গ্রামে মামার বাড়িতে। পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার বাগমারা গ্রামে। বাবা কাজী গওহরউদ্দীন আহমদ। মায়ের নাম ছিল তাসিরুন্নেসা। বাগমারাতেই তার শৈশব কাটে।
শিক্ষাজীবনের শুরু হয় কুষ্টিয়াতে। মেধাবী ছাত্র হিসেবে বৃত্তি নিয়ে ১৯০৭ সালে নিম্ন প্রাইমারি ও ১৯০৯ সালে উচ্চ প্রাইমারি পাস করেন। ১৯১৫ সালে কুষ্টিয়া মুসলিম হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা পাস করে ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে। ১৯১৭ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯১৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় বাংলা ও আসাম জোনে প্রথম স্থান দখল করে মাসিক ত্রিশ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। ১৯২১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধীনে পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান দখল করে এমএ পাস করেন। উল্লেখ্য, ওই বছর কেউ প্রথম শ্রেণি পাননি।
এমএ ক্লাসের ছাত্র থাকাকালেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ডেমোনেস্ট্রেটর পদে চাকরিতে যোগ দিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। তারপর এমএ পাস করে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার পদে যোগ দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালীন ১৯৩৮ সালে তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান প্রখ্যাত বিজ্ঞান সাধক প্রফেসর সত্যেন্দ্রনাথ বসুর আগ্রহ ও পরামর্শে কলকাতায় ড. প্রশান্তচন্দ্র মহলনবীশের অধীনে স্ট্যাস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে সংখ্যাতত্ত্ব বিষয়ে লেখাপড়া করে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যাতত্ত্ব পড়ানোর ভার নেন এবং সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগ ও ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। দেশে সংখ্যাতত্ত্ব পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে তিনিই ১৯৫০ সালে ‘ডিজাইন অফ এক্সপেরিমেন্টস’ বিষয়ে গবেষণার জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। কাজী মোতাহার উদ্ভাবিত পদ্ধতি ‘হোসেইনস্ চেইন রুল’ নামে অভিহিত হয়।
১৯৫৪ সালে তিনি ‘প্রফেসর’ পদ লাভ করেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ‘ডিন’ ছিলেন। ১৯৬৪ সালে কাজী মোতাহার সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরে তাকে ‘সুপারনিউমেরারি প্রফেসর অব স্ট্যাটিস্টিক’ পদে নিযুক্ত করা হয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অফ স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (আইএসআরটি) নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর ছিলেন।
এর পাশাপাশি কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু। দাবাগুরু মোতাহার হোসেন ১৯২৯ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত একনাগাড়ে প্রায় ৩০ বছর অবিভক্ত বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানে একক চ্যাম্পিয়ন ছিলেন।
সাহিত্য জগতেও তিনি ছিলেন সর্বজনপ্রিয় এক নাম। অমর কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার দাবা খেলার সাথী ছিলেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য এক দিক। কাজী মোতাহার হোসেন নজরুল সম্পর্কে অনেকগুলো প্রবন্ধ ও একটি গ্রন্থ রচনা করেন। অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী এবং সেই আলোকে দেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সুদৃঢ় ভিত গড়ে তোলার জন্যে তিনি লেখনী পরিচালনা করেন। কাজী আব্দুল ওদুদ, সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল ফজলের সাথে তিনি ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ গড়ে তুলেছিলেন। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে তিনি কিছুকাল ‘শিখা’ নামক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। কাজী মোতাহার হোসেন বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতির উপর বেশকিছু বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে প্রবন্ধ সংকলন ‘সঞ্চয়ন’, নজরুল কাব্য পরিচিতি, সেই পথ লক্ষ্য করে, সিম্পোজিয়াম, গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস, আলোক বিজ্ঞান, নির্বাচিত প্রবন্ধ, প্লেটোর সিম্পোজিয়াম (অনুবাদ) অন্যতম।
১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৬৬ সালে প্রবন্ধসাহিত্যের জন্যে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বিজ্ঞান চর্চায় অসাধারণ অবদানের জন্যে ১৯৭৯ সালে দেশের ‘সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার’ হিসেবে পরিচিত ‘স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৭৪ সালে বিজ্ঞান ও কলা বিষয়ে অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ডি.এস.সি ডিগ্রি দ্বারা সম্মানিত করে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত করে।
এছাড়াও ১৯৬৯ সালে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রফেসর এমিরিটাস’ পদে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে তাকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব সায়েন্স’ (ডিএসসি) ডিগ্রি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশের ‘জাতীয় অধ্যাপক’ এর মর্যাদা দেয়া হয় ১৯৭৫ সালে।
ব্যক্তিজীবনে তিন কন্যা ও দুই পুত্রের জনক কাজী মোতাহার হোসেন। পুত্র-কন্যাদের প্রায় সকলেই জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সনজীদা খাতুন, কাজী আনোয়ার হোসেন জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজ ‘মাসুদ রানা’র রচয়িতা, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুন রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিষ্ঠিত শিল্পী এবং প্রয়াত কনিষ্ঠ পুত্র কাজী মাহবুব হোসেনও অনুবাদ সাহিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
কাজী মোহাহার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করেন। শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর দাবিতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তিনি ছিলেন তার একজন দৃঢ় পৃষ্ঠপোষক। বিচিত্র ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কাজী মোতাহার হোসেন ১৯৮১ সালের ৯ অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র: সংগৃহীত