১৫ মে ২০২১
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে আজ বছরের ১৩৫তম (অধিবর্ষে ১৩৬তম) দিন। এক নজরে দেখে নিই ইতিহাসের এই দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা, বিশিষ্টজনের জন্ম ও মৃত্যুদিনসহ আরও কিছু তথ্যাবলি।
১৮১৮ : বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র বেঙ্গল গেজেট প্রকাশিত হয়।
১৯৫১ : দৈনিক সংবাদ-এর আত্মপ্রকাশ।
১৯৭২ : বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ব্রাজিল।
১৭২০ : ম্যাক্সিমিলিয়ান হেল, স্লোভাকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
১৮১৭ : দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভারতের ধর্মীয় সংস্কারক; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা।
১৮৫৭ : উইলিয়ামিনা ফ্লেমিং, স্কটল্যান্ডীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
১৮৫৯ : পিয়েরে কুরি, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী।
১৯০৩ : মারিয়া রাইখ, জার্মান বংশোদ্ভূত গণিতবিদ এবং প্রত্নতত্ত্ববিদ।
১৯০৭ : সুখদেব থাপার, ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধা।
১৯৩২ : সাগর সেন, প্রখ্যাত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী।
১৮৯৪ : বিশিষ্ট লেখক এবং শিক্ষাবিদ ভূদেব মুখোপাধ্যায়।
১৯৩৬ : ভারতের যশস্বী বাঙালি শিল্পপতি স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস।
সাগর সেন বাংলা সঙ্গীত জগতের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি সর্বকালের সেরা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে একজন। জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩২ সালের ১৫ মে ফরিদপুরে। দেশভাগের সময় তাদের পরিবার পাড়ি জমায় কলকাতায়। সেখানে বরানগরে থাকতে শুরু করে তার পরিবার। সাগর সেনের প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্গীত শিক্ষার হাতেখড়ি হয় সেখানেই।
ছোটোবেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রকৃতিদত্ত কণ্ঠের অধিকারী। সেই কণ্ঠকেই ধীরে ধীরে পরিশীলিত, পরিমার্জিত করে তুলেছিলেন তিনি নিজের চেষ্টা ও দক্ষতায়। তীর্থপতি ইন্সটিটিউশনে স্কুল শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভ করেছিলেন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। এরপর পাবলিক ফাংশনের মাধ্যমে শ্রোতাদের সামনে উপস্থিত হওয়া এবং ১৯৫৮ সালে প্রথম বেতারে সঙ্গীত পরিবেশন। এইভাবেই তার সঙ্গীতজীবনের সূত্রপাত।
সঙ্গীতজীবনের প্রথম থেকেই সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তার কণ্ঠের অসামান্য ব্যাপ্তি ও গভীরতা ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় এবং ভাবের জটিলতম মিশ্রণের অনায়াসসাধ্য পরিবেশনাতে অত্যন্ত সফল ছিলেন তিনি। ১৯৬১ সালে মেগাফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয় তার রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম রেকর্ড; গান দুটি ছিল ‘ওগো জলের রাণী’ এবং ‘নূপুর বেজে যায়’। এর এক বছরের মধ্যেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষাকেন্দ্র ‘রবিরশ্মি’। অচিরেই ‘রবিরশ্মি’র নথিভুক্ত ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা হাজার অতিক্রম করে এবং তার অনুগামীদের সংখ্যাও বেড়ে ওঠে ক্রমশ। একই বছর তিনি সুমিতা দেবীর সঙ্গে পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হন।
১৯৬৮ সাল হলো সাগর সেনের সঙ্গীত জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বছর। সে বছর গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয় তার কণ্ঠে ‘সখী বহে গেল বেলা’ এবং ‘আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান’- রবীন্দ্রনাথের ‘মায়ার খেলা’ নাটকের গান। ‘আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান’- গানটি সাগর সেনকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল। এইভাবেই ‘রবিরশ্মি’-‘র প্রতিষ্ঠাতা সাগর সেন হয়ে উঠলেন এক সচল প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ঈপ্সিত হয়ে উঠলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতানুরাগী মানুষদের কাছে; জন্ম হলো এক কিংবদন্তির। এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছরই সাগর সেনের রেকর্ড প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৭৯ সালে ‘পরিচয়’ ছায়াছবিতে তার গাওয়া ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’ গানটির জন্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতে শ্রেষ্ঠ নেপথ্যকণ্ঠশিল্পী হিসেবে ‘বিএফজেএ’ পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা ছায়াছবির জগতে তিনিই প্রথম পুরুষ শিল্পী, যিনি ছায়াছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তার স্বল্পায়ু সঙ্গীতজীবনে তিনি প্রায় ১০০টি রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছেন, যেগুলো প্রায় আড়াই দশক ধরে প্রকাশিত হয়েছে মেগাফোন, কলম্বিয়া, এইচএমভি রেকর্ড লেবেলে।
তিনি ছিলেন বেতারের নিয়মিত শিল্পী। ‘তোমরা যা বলো তাই বলো’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, ‘তোমার সুর শুনায়ে যে ঘুম ভাঙাও’ ইত্যাদি গান তিনি বেতারে পরিবেশন করেছেন বিভিন্ন সময়ে।
অনন্য উপলব্ধি এবং আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি তার রেকর্ড করা প্রতিটি রবীন্দ্রসঙ্গীতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। বহু অপ্রচলিত রবীন্দ্রসঙ্গীত তার কণ্ঠে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার জনমানসে। বিভিন্ন গীতিনাট্যে কণ্ঠদান তো বটেই, নির্দিষ্ট একটি বিষয় নিয়ে সংকলিত মঞ্চানুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অন্যতম পথপ্রদর্শক। এই অনুষ্ঠানগুলোর পরিকল্পনা, পরিচালনা ও নির্দেশনায় থাকতেন সাগর সেন নিজেই। সমকালীন সময়ে সাগর সেন ছিলেন এক বিস্ময়কর মঞ্চায়োজক।
সঙ্গীতজীবনের শেষ পর্যায়ে সাগর সেন আধুনিক গান রেকর্ড করা শুরু করেন। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত সলিল চৌধুরীর সুরে ‘কি হলো চাঁদ কেন মেঘে ঢেকে গেলো’ এবং ‘এ জীবন এমনি করে আর তো সয় না’ এখনও বিশেষভাবে জনপ্রিয়। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় তার কণ্ঠে আরও দুটি আধুনিক গান; একটি বিশ্বনাথ দাসের কথায় ‘তোমার জন্য সবটুকু সুখ’ এবং অপরটি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ‘এ জীবন সূর্যের স্বপ্ন’; দুটি গানেই সুর দিয়েছিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়াও আকাশবাণী আর্কাইভে তার গাওয়া বেশকিছু আধুনিক গান সংরক্ষিত রয়েছে, যার মধ্যে ইন্দিরা দেবীর কথায় ও বিমান ঘোষের সুরে ‘তোমার আকার নাই কি কোনো’, অরবিন্দ ভট্টাচার্যর কথায় ও নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে ‘বন্ধু রে, যাবি কতদূর’, অনিল ভট্টাচার্যর কথায় ও বিমান ঘোষের সুরে ‘আমি গেঁথেছি বকুলমালা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সঙ্গীতশিল্পী ছাড়াও সাগর সেন ছিলেন একজন প্রতিভাবান ভাস্কর। কিশোর বয়সেই দেশের বাড়ির একচালা দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করতেন একা হাতে। ভবানীপুরে এক আত্মীয়ের বাড়ির দুর্গাপূজায় টানা আধঘণ্টা-একঘণ্টা ঢাক বাজাতে পরিবারের অনেকেই দেখেছেন তাকে। এছাড়া খুব ভালো ছবিও আঁকতেন তিনি।
একজন আদর্শ সঙ্গীতশিল্পীর সমস্ত গুণই ছিল তার মধ্যে। অত্যন্ত নিয়মমাফিক জীবনযাপন করতেন তিনি। নিয়মিত সকালে উঠে রেওয়াজে বসতেন। অতি মশলাদার বা ঠাণ্ডা জিনিস খেতেন না একেবারেই। তার অত্যন্ত প্রিয় খাবার ছিল চিংড়ি মাছ ও খাঁটি ইলিশ। শুধুমাত্র কণ্ঠের যত্নের কথা মাথায় রেখে এইসব খাবার ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। তার সময়জ্ঞানও ছিল অত্যন্ত প্রখর। তাকে দিয়ে ঘড়ির সময় মেলানো যেত। হাজার ঝড়-জল-বৃষ্টিতেও পূর্ব-নির্ধারিত সময়েই শুরু করতেন প্রতিবারের ‘শ্রাবণসন্ধ্যা’ অনুষ্ঠান।
বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন ধরনের গান শোনার শখ ছিল। ইংরেজি, গ্রিক, জার্মান ইত্যাদি ভাষার গানও শুনতেন এবং চিন্তা করতেন কীভাবে সেই সঙ্গীতশৈলী সুচিন্তিত, সাবলীল এবং মার্জিতভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবকে অক্ষুণ্ণ রেখে প্রয়োগ করা যায়।
সাগর সেন শুধুমাত্র একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিভাই নন, তিনি ছিলেন একাধারে সঙ্গীত-পরামর্শদাতা, আয়োজক, সঙ্গীত পরিচালক এবং সর্বোপরি একজন মানবদরদি মানুষ। নিজের আয়োজিত বহু চ্যারিটেবেল পাবলিক ফাংশনের মাধ্যমে তিনি অক্লান্তভাবে জনহিতকর কাজের প্রেক্ষিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন, বিশেষ করে সত্তরের দশকের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলে তিনি বিপুল পরিমাণ আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। কত মানুষকে নিঃশব্দে কত দান করেছেন তিনি, পরিবারের কাউকে কখনও জানতে দেননি। তার বহু ছাত্র ও অসংখ্য অনুরাগীদের কাছে তিনি ছিলেন ঈশ্বরতুল্য মানুষ, একজন পথ-প্রদর্শক, একজন অভিভাবক, একজন পরহিতব্রতী ব্যক্তিত্ব, তাদের প্রিয় ‘সাগরদা’!
সাগর সেন মৃত্যুর সময় রেখে যান তার স্ত্রী ও তিন পুত্র- প্রিয়ম, প্রীতম ও প্রমিতকে। এর মধ্যে প্রমিত সেন পরবর্তীতে একজন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
খ্যাতির মধ্যগগনে থাকাকালীনই তিনি ভয়াবহ কর্কট রোগে আক্রান্ত হন। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে ১৯৮৩ সালের ৪ জানুয়ারি এই অসামান্য সঙ্গীতপ্রতিভা মৃত্যুবরণ করেন।
সাগর সেনের গায়কীর শক্তিমান দিক হচ্ছে তার কণ্ঠে অতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কাজের দক্ষতা। পাশাপাশি তার ভোকাল টিম্বার এবং কণ্ঠের আবেগ তার গীত রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়। তিনি আজ নেই। তবে তার গান আছে, গানের মাধ্যমে তিনিও বেঁচে আছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শ্রোতাদের হৃদয়ে।
সূত্র: সংগৃহীত