১৮৪৪ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের সংসদভবন থেকে মার্কিন আবিষ্কারক মোর্স ৪০ মাইল দূরের বাল্টিমোর শহরে বিশ্বের প্রথম দূরপাল্লার টেলিগ্রাম পাঠান।
১৮৬২ : টেমস নদীর ওপর ওয়েস্ট মিনিস্টার সেতু উন্মুক্ত করা হয়।
১৯৭২ : কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে ঢাকায় আগমন। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে জাতীয় কবির স্বীকৃতি দান।
১৮১৩ : কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, ঊনবিংশ শতকের অন্যতম বাঙালি শিক্ষাবিদ, ভাষাতত্ত্ববিদ ও খ্রিষ্টধর্মপ্রচারক।
১৯০৫ : মিখাইল শলোখভ, নোবেলজয়ী সোভিয়েত ঔপন্যাসিক।
১৯২০ : সোমেন চন্দ, মার্কসবাদী বাঙালি সাহিত্যিক।
১৯৪১ : বব ডিলান, মার্কিন গায়ক, গীতিকার, লেখক, সঙ্গীতজ্ঞ ও কবি।
১৯৫১ : মুনতাসীর মামুন, বাংলাদেশি অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক।
১৫৪৩ : জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকলাস কপারনিকাস।
১৯০৩ : উনিশ শতকের বাঙালি কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৩২ : জার্মান অণুজীববিজ্ঞানী কার্ল বেন্ডা।
১৯৯২ : ভারতীয় বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ ও রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রশিক্ষক শৈলজারঞ্জন মজুমদার।
২০১০ : ‘গুপী গায়েন’ খ্যাত বাঙালি অভিনেতা তপেন চট্টোপাধ্যায়।
২০১০ : বাংলাদেশি চিত্রগ্রাহক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা বেবী ইসলাম।
শৈলজারঞ্জন মজুমদার ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশেষজ্ঞ সাধক, প্রশিক্ষক ও রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সহচর। তিনি ছিলেন রবীন্দ্র সঙ্গীতের স্বরলিপিকার এবং বিশ্বভারতীর রসায়ন বিজ্ঞানের শিক্ষক। অবিকৃত ও বিশুদ্ধরূপে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা এবং এর প্রচার-প্রসারে খোদ রবীন্দ্রনাথ জীবদ্দশায় যে ক’জন শিষ্যের ওপর নির্ভর করতেন তাদের মধ্যে তার নামটি সবার আগে। কিংবদন্তিতুল্য এই সঙ্গীতসাধক পুরো জীবন রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে সমর্পণ করেছেন।
জন্মগ্রহণ করেন ১৯০০ সালের ১৯ জুলাই নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার বাহাম গ্রামে। বাবা রমণীকিশোর দত্ত মজুমদার ছিলেন নেত্রকোনার ডাকসাইটে আইনজীবী। মা সরলা সুন্দরী ছিলেন গৃহিণী।
নেত্রকোণার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার মেট্রোপলিটন কলেজ (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) থেকে তিনি আইএসসি পাস করেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিএসসি পাস এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে এমএসসি প্রথম শ্রেণীতে পাস করেন। এরপর তিনি তার বাবার ইচ্ছায় আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে আইন পাশ করেন।
শৈশবে ঠাকুরমা সৌদামিনী দেবীর কাছে সঙ্গীতে হাতেখড়ি। জামতাড়া জংবাহাদুর করোনেশন হাইস্কুলে কিছুদিন পড়াকালে ইংরেজি শিক্ষক সুরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সাহচর্য তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি শৈলজারঞ্জনকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে নিয়ে যান। ঠাকুরবাড়িতে উপাসনা, গুণীজনদের বক্তৃতা এবং রবীন্দ্রনাথের গান শুনে মুগ্ধ হন তিনি। কলেজে পড়ার পাশাপাশি চালিয়ে যান সঙ্গীতচর্চা।
প্রথম দেখাতেই রবীন্দ্রনাথের সত্তা এবং প্রভাব তাকে রীতিমতো অভিভূত করে ফেলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র ও দ্বীপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র দিনেন্দ্রনাথের কাছে শেখা ১৪টি গান দিয়ে তিনি ১৯৩২ সালে নেত্রকোনার দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জন্মদিন উদযাপন করেন। শান্তিনিকেতনের বাইরে বাংলাদেশে তো বটেই, বিশ্বের ইতিহাসে এটাই প্রথম রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান। খোদ রবীন্দ্রনাথ নিজেই দিয়ে গেছেন এর দালিলিক স্বীকৃতি। জন্মদিন পালনের খবরে তখন শৈলজারঞ্জনকে চিঠি পাঠিয়ে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন কবি। সেই চিঠি এখনও আছে।
১৯৩২ সালের মাঝামাঝি ওকালতির ব্যবসা যখন সবে শুরু করেছেন তখন শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীতে রসায়নের অধ্যাপক পদে যোগদানের ডাক পান তিনি। বাবার বিরুদ্ধাচরণ করেই তিনি চলে যান বিশ্বভারতীতে। শৈলজারঞ্জনের ভাষায়, ‘জীবনের সবদিকে যে দ্বার খুলে গেল সে অনুভূতিটা শান্তিনিকেতনে না গেলে পেতাম না। সাধারণ গৃহস্থ জীবনেই জড়িয়ে থাকতাম।’
বিশ্বভারতীতে যোগদানের পর দিনেন্দ্রনাথের কাছে নিয়মিত গান শেখা শুরু করেন। একদিন রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে এক আসরে ‘গগণে গগণে আপনার মনে’ গানটি গেয়ে তার প্রশংসা কুড়ান। এরপর থেকে আশ্রমের নিয়মিত সাপ্তাহিক পার্থনাতে গান গাইতে থাকেন। দিনেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর শৈলজারঞ্জনকে অবাক করে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই গান শেখানোর দায়িত্ব নেন। প্রতিদিন বিকেলে গুরুদেবের কাছে গান শিখতে শুরু করেন। গুরুদেব তার প্রিয় গানগুলো শেখাতেন তাকে। গানের স্টক করতেন বলে রবীন্দ্রনাথ তাকে উপাধি দিয়েছিলেন- গীতাম্বুধি (গানের সাগর)। তিনি যখন শিখতে যেতেন তাকে দেখেই রবীন্দ্রনাথ অন্যদের বলতেন, ‘এবার আমার চাকরি শুরু হবে। ওই আসছেন গীতাম্বুধি।’ গুরুদেবের পরামর্শে ছেলে-মেয়েদের নিয়েও ক্লাস শুরু করেন তিনি। পরে স্কুলের সাহিত্যসভার গান পরিচালনার ভারও এসে পড়ে তার ওপর।
অধ্যাপনার পাশাপাশি সঙ্গীত সাধনার মধ্য দিয়ে শৈলজারঞ্জন ক্রমেই রবীন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে কবি তার গানগুলো শুদ্ধরূপে চর্চা, সংরক্ষণ এবং প্রসারের ব্যাপারেও শৈলজারঞ্জনের ওপর অনেকখানি নির্ভর করতে শুরু করেন। তাছাড়া বিদ্বান মেধাবী শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন সমাদৃত। তাই যোগ্যতার বিচার-বিবেচনাতেই ১৯৩৯ সালে শৈলজারঞ্জনকে বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেন কবি। সিদ্ধান্তের প্রাক্কালে শৈলজারঞ্জন কবিগুরুকে বলেন, ‘এ তো আমার পরম সৌভাগ্য। কিন্তু আমি তো তেমন কিছুই জানি না। আমি এখানকার লোকও নই। আমি কি পারবো?’ তখন কবি অভয় দিয়ে বলেন, ‘তুমি তো আমাকে মানো, তা হলেই হবে।’ দীর্ঘ ২০ বছরের বেশি সময় অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক কিছুরই ভার দিয়ে দেন শৈলজারঞ্জনের ওপর।
রবীন্দ্রনাথের দুই শতাধিক গান ও বেশকিছু নৃত্য নাট্যের স্বরলিপি করেছেন শৈলজারঞ্জন। সম্পাদনা করেছেন বেশকিছু স্বরলিপি গ্রন্থ। শুধু সঙ্গীত ভবনের অধ্যক্ষ বা গায়ক-স্বরলিপিকারক হিসেবে নয়, রবীন্দ্রনাথের গান ও নাটকের প্রচার-প্রসারেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের টানে শান্তিনিকেতনের পরিবেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেলেও নিজ দেশ ও জন্মভূমির প্রতি গভীর টান অনুভব করতেন তিনি। জন্মভূমি নেত্রকোনাকে বলতেন ‘দেশ’, বাংলাদেশকে ‘স্বদেশ’ আর নিজের পরিচয় দিতেন ‘‘বাঙাল’ হিসেবে। শান্তিনিকেতনে থিতু হওয়ার প্রায় তিন দশক পরে ১৯৭৪ সালে প্রথম বাংলাদেশে আসেন। এরপর আরও দুইবার আসেন ১৯৭৫ ও ১৯৮৬ সালে। যদিও জন্মভূমির টানে এসেছেন কিন্তু এ-দেশে রবীন্দ্রনাথের গান অবিকৃত ও শুদ্ধরূপে ছড়িয়ে দেওয়া ছিল তার আরেকটি বিশেষ উদ্দেশ্য। প্রত্যেকবার এসে ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে আগ্রহী শিল্পীদের গান শিখিয়েছেন। সভা-সমিতিতে যোগ দিয়ে মূল্যবান বক্তৃতা করেছেন।
১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে সংগীত আকাদেমি পুরস্কার দেন এবং ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিশ্বভারতী থেকে ‘দেশিকোত্তম’ সম্মাননা পান। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট প্রদান করে। রবীন্দ্র চেতনার ধারক ও বাহক শৈলজারঞ্জন মজুমদার এদেশের কৃতি সন্তান হিসেবে সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তার অবদান নিঃসন্দেহে অতুলনীয়। ১৯৯২ সালের ২৪ মে কলকাতার সল্টলেকের বাড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সূত্র: সংগৃহীত