1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৭ অপরাহ্ন

এম এন রায় : মানবতাবাদী শোষিতের পক্ষের একজন নিঃস্বার্থ সৈনিক

  • সময় সোমবার, ২২ মার্চ, ২০২১
  • ১১৬১ বার দেখা হয়েছে

ছোট্টবেলাতেই তিনি ভেঙেছিলেন বর্ণবাদের বৃত্ত…

আজকে আমরা একজন বিপ্লবীর জীবন নিয়ে আলোচনা করব।

জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই বাংলায় ১৩৩ বছর আগে এই মার্চ মাসে। ২২ তারিখ।

জন্মসূত্রে নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। ব্রাহ্মণ পরিবার জন্ম। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তিনি সংস্কারের বৃত্ত যেমন ভেঙেছিলেন তেমনি ১৩৩ বছর আগে যখন পৃথিবী কিন্তু গ্লোবাল ভিলেজ হয় নি।

এখন তো পৃথিবীর যে-কোনো জায়গায় যাওয়া হচ্ছে কোনো বিষয় না। কিন্তু সেইসময় এত সহজ ছিল না। এবং পৃথিবীটা খুব কঠিন ছিল বাঙালির জন্যে ভারতবাসীর জন্যে। কারণ আমরা তখন ইংরেজদের গোলাম ছিলাম।

তো নরেন্দ্রনাথ ছোট্টবেলাই বৃত্ত ভাঙলেন, বর্ণবাদের বৃত্ত।

এবং তারপরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে পরাধীনতার বৃত্ত ভাঙার সংগ্রামে নেমে পড়লেন।

চার্লস মার্টিন থেকে হলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়…

উনি তখন কিশোর বলা যায়। মানে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল যখন তখন এই বাংলা ছিল সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের ঘাঁটি। এবং ইংরেজরা বাঙালিদের ভয় পেত সবচেয়ে বেশি।

এবং সেইসময় অরবিন্দ ঘোষ তার অনুশীলন সমিতি যুগান্তর, বাঘাযতীন এদের সবার সাথে নরেন্দ্রর যোগাযোগ ছিল আরকি।

তখন নরেন্দ্রনাথ বেঙ্গল টেকনিকেল ইনস্টিটিউটে যেটা এখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল এবং রসায়ন শাস্ত্রের পড়ার সময়ই বিপ্লবী হয়ে গেলেন পুরোদস্তুর।

দলবল নিয়ে সুন্দরবনে চলে গেলেন বোমা তৈরি এবং গুলিচালনায় প্রশিক্ষণের জন্যে। ২৩ বছর যখন তার বয়স প্রথম গ্রেফতার হন।

এবং জেলখানায় বসে বাঘাযতীনের সাথে সারা ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন।

কারামুক্তির পরে তিনি সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করলেন এবং জায়গায় জায়গায় বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুললেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো এরপরে। বাংলার বিপ্লবী যারা ছিলেন তারা জার্মান সহায়তায় ভারত বর্ষকে স্বাধীনতা করার পরিকল্পনা করলেন।

এবং জার্মান সরকারের সাথে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে তিনি ছদ্মবেশে ইন্দোনেশিয়ায় জাকার্তায় চলে গেলেন এবং নরেন্দ্র হয়ে গেলেন চার্লস মার্টিন। সেখানে জার্মান দূতাবাস কোনোভাবেই সহযোগিতা করল না। সেখান থেকে তিনি চলে গেলেন জাপানে আরকি। বিমানে না, নৌ-পথে।

এবং তখন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু জাপানে ছিলেন। তার সহায়তায় তিনি বৈঠক করলেন। তিনি গেলেন চীনের প্রথম প্রেসিডেন্ট সান ইয়াৎ সেনের সাথে।

ঠিক হলো যে আসাম সীমান্তে জার্মান গোলাবারুদ হস্তান্তর করা হবে আরকি। নরেন্দ্র টোকিও থেকে বেইজিং গেলেন জার্মান রাষ্ট্রদূতের সাথে চুক্তি করার জন্যে। রাষ্ট্রদূত প্রস্তাব করলেন যে, এইখানে হবে না। চুক্তি স্বাক্ষর করতে হলে বার্লিনে যেতে হবে।

কত ঘোরপ্যাঁচ আরকি! কোত্থেকে কোথায়!

গিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ায়। ইন্দোনেশিয়া থেকে জাপান, জাপান থেকে চীন।

চীন থেকে এখন যেতে হবে বার্লিন আরকি মানে।

জার্মান এম্বেসী পাসপোর্টের ব্যবস্থা করল। উনি জার্মান হয়ে গেলেন তখন। তার নতুন নাম হলো ফাদার চার্লস মার্টিন।

তিনি আমেরিকা হয়ে ফ্রান্সে যাবেন নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনার জন্যে, উচ্চতর পড়াশুনার জন্যে। মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, কোরিয়া হয়ে জুন মাসে তিনি পৌঁছলেন আমেরিকান সান ফ্রান্সিস্কোর পথে।

মানে আসলে খুব রোমান্টিক লাইফ। আমরা যখন তরুণ ছিলাম তখন তিনি পরে যে নামে পরিচিত হন এটা পরে আসছি। এখন পর্যন্ত তিনি ফাদার হয়ে গেছেন আরকি। সন্ন্যাসী ছিলেন ফাদার হয়ে গেছেন আরকি।

তো ফ্রান্সিস্কোতে নামার সাথে সাথে যেটা হলো যে, ওখানে নামার পরে ফ্রান্সিস্কোর সান ফ্রান্সিস্কোর খবরের কাগজে দেখলেন যে বড় বড় করে ছাপা হলো একজন বিপজ্জনক হিন্দু বিপ্লবী ও জার্মান গুপ্তচর আমেরিকায় ঢুকে পড়েছে। বোঝেন কী অবস্থা আরকি! নরেন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি হোটেল ছেড়ে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেন। উঠলেন এক বাঙালি অধ্যাপকের বাড়িতে। তার পরামর্শে নাম বদলালেন আরকি মানে। যে আর চার্লস মার্টিন থেকে লাভ নাই। নাম বদলাতে হবে মানবেন্দ্রনাথ রায় হলেন তিনি। এম.এন রয় আরকি মানে। আসলে এই এম.এন রায় নামে তিনি বিখ্যাত হন।

শুরু হলো জীবনের সফল অধ্যায়…

এবং তার সবচেয়ে জীবনের সফল অধ্যায় শুরু হয়। আসলে নাম পরিবর্তনের সাথে অনেক সময় ঐ যে বলে না, নামে নামে যমে টানে। আবার নামে নামে ভাগ্য টানে আরকি।

নামের যে একটা প্রভাব! যে কারণে রসুলুল্লাহর (স) একটি হাদিস হচ্ছে যে, সন্তানের প্রতি মা-বাবার যে চারটা কর্তব্য তার মধ্যে প্রথম হচ্ছে তার জন্যে একটা সুন্দর নাম রাখা। এই যে আমরা অনেক সময় খেদি পেচি তারপরে বল্টু পল্টু মানে এই ধরনের নাম কখনো রাখবেন না। নাম যদি বল্টু রাখেন সেতো বল্টুই হয়ে যাবে আরকি। নাম যদি পটল রাখেন তো সে কী করবে? সে পটল তুলবে আরকি মানে।

তো নাম সবসময় সুন্দর নাম রাখবেন। সন্তানের জন্যে এটা হচ্ছে খুব বড় কর্তব্য। এবং এম এন রয় পরবর্তী সময় তার স্মৃতি কথায় লেখেন যে, এভাবে আমার পুনর্জন্ম ঘটে এবং এই নাম আমাকে ব্যর্থ অতীত থেকে রোমান্টিক এবং কৃতিত্বপূর্ণ ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যায়। এম.এন রয় এবং নাম চেঞ্জ করেই তিনি সান ফ্রান্সিস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের মেয়ে ইভিলিনকে বিয়ে করে ফেলেন আরকি মানে। তো এবং ইভিলিন তার খুব বিশ্বস্ত রাজনৈতিকভাবেও বিশ্বস্ত ছায়াসঙ্গী হয়ে যান।

অবশ্য যেহেতু সানফ্রান্সিস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট অতএব তার তো একটা রাজনৈতিক প্রভাব তো আছে। প্রভাবশালী শ্বশুরের ক্ষোভে পড়ে গেলেন তিনি আরকি মানে যে, আমার মেয়েকে শ্বেতাঙ্গদের দৃষ্টিতে তো এই অন্য চামড়ার যারা তারা তো দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ আরকি।

তিনি স্ত্রীকে নিয়ে পাড়ি জমালেন নিউইয়র্কে। সেখানে সমাজবিপ্লবীদের সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে এবং সোশ্যালিস্ট ধ্যানধারণার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং গভীরভাবে সেখানে মার্কসবাদ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।

তিনি শুধু বিপ্লবী ছিলেন না, আয়ত্ত ছিল ১৭টি ভাষা!

তবে সেখানেও থাকতে পারলেন না। ১৯১৭ সালে যখন আমেরিকা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল তখন এম.এন রয় যেহেতু জার্মান পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছেন সেখানে। তাকে আবার ওখান থেকে পালিয়ে যেতে হলো।

এবার একা পালান নাই, পালালেন স্ত্রীকেসহ। চলে গেলেন মেক্সিকোতে

এবং সেখানকার রাজনীতির সাথে খুব দ্রুত মিশে গেলেন।

আপনি দেখেন আসলে জীবন!

তিনি স্প্যানিশ ভাষা শিখে ফেললেন এবং পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করলেন। এর মধ্যে ফরাসি এবং জার্মান ভাষাও শিখে নিলেন এম এন রয়। ১৭টা ভাষা! তিনি শুধু বিপ্লবী ছিলেন না, ভাষাবিদও বলা যায় যে একজন মানুষ ১৭টা ভাষা!

এবং অল্প সময়ের মধ্যে মেক্সিকোর বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে এবং মেক্সিকোতে মার্কিন আগ্রাসনের মোকাবেলায় তিনি ১৯১৭ সালে সোশ্যালিস্ট পার্টি গড়ে তোলেন।

সেখানে শ্রমজীবী এবং মেহনতি মানুষের দুঃখকষ্ট দূর করার জন্যে তিনি এই পার্টির যে মেনিফেস্টো রচনা করেন তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এবং ১৯১৯ সালে সোশ্যালিস্ট পার্টি কমিউনিস্ট পার্টির রূপ নেয়। এবং সর্বসম্মতিক্রমে এম এন রয় এই পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি হলেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পরে তখন পৃথিবীর প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি আমেরিকাতে। এটা হচ্ছে মেক্সিকান কমিউনিস্ট পার্টি এবং তারা বিপ্লব করে ফেলেন।

যদিও বিপ্লব বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। কারণ আসলে বিপ্লব যদি ভেতর থেকে না আসে কিছু মানুষ রক্তাক্ত বিপ্লব করে এটাকে তারা ধরে রাখতে পারে না।

তো সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে প্রথম যে বিপ্লব হলো যদিও সে বিপ্লব সফল হয় নি এবং দীর্ঘস্থায়ী হয় নি, সে বিপ্লবের নেতা ছিলেন এম এন রয় বাঙালি এম এন রয়।

তখন সোভিয়েত ইউনিয়নে লেলিন হচ্ছেন বিপ্লবের নেতা মেক্সিকো এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলো এবং উচ্ছ্বসিত লেলিন ১৯২০ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস ‘কমিনটার্ন’ বলা হতো এটাকে। এম এন রয়কে আমন্ত্রণ জানালেন। এবং তিনি মস্কোতে গেলেন।

আপনি দেখেন একজন মানুষ আমরা খালি নিশ্চয়তা খুঁজি আরকি সিকিউরিটি খুঁজি আরকি যে এরপরে আমার কী হবে?

এম.এন রয় ভারত থেকে যখন বেরিয়ে ছিলেন টাকাপয়সা নিয়ে যেতে পেরেছিলেন? যে টাকার বান্ডিল নিয়ে গিয়েছে আরকি। কারণ উনি তো কোনো কোম্পানিকে রিপ্রেজেন্ট করেন নাই। কোনো সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে রিপ্রেজেন্ট করেন নাই।

যতটুকু সম্ভব মিনিমাম আরকি নিয়ে বেরিয়েছেন। গিয়েছেন জাকার্তা। জাকার্তা থেকে আবার জাপান, জাপান থেকে চীন।

চীন থেকে আমেরিকাতে গেলেন।

গিয়ে শোনেন তাকে খোঁজা হচ্ছে। খোঁজা হচ্ছে কিন্তু কোনো ভয়ডর নাই। ওখান থেকে শুধু সরে গিয়ে ওখানকার ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্টের মেয়েকে বিয়ে করে ফেললেন।

এবং তারপরে একা পালালেন না, স্ত্রীকে নিয়ে পালালেন আরকি। এবং মেক্সিকোতে গিয়ে বিপ্লব করে ফেললেন। এবং সেখান থেকে মস্কো।

করলেন লেনিনের থিসিসের ওপর পাল্টা থিসিস…

লেনিনের মতো বিপ্লবী লেনিন তখন হচ্ছেন সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান। নাইনটিন টুয়েন্টি। সেখানে গিয়ে লেলিন যে তত্ত্ব দিচ্ছেন কমিউনিস্ট পার্টির বিশ্বকংগ্রেসে। এম.এন রয় বিকল্প তত্ত্ব উপস্থাপন করলেন।

চিন্তা করবেন যে, যেখানে লেনিনের থিসিসের ওপরে আরেকটা পাল্টা থিসিস করা। কতটা জ্ঞানের কতটা গভীরতা থাকলে এটা সম্ভব আরকি। তো যেখানে পুরো সোভিয়েত ইউনিয়নে লেনিনের সাথে ভিন্নমত পোষণ করার সাহস কেউ করত না সেখানে বাঙালি এম.এন রয় সাহস করে প্লেস করলেন। এটা নিয়ে আলোচনা হলো এবং কংগ্রেস দুটো তত্ত্বকেই গ্রহণ করল আরকি তার ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা হিসেবে।

এবং এম এন রয় বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের সবচেয়ে প্রভাবশালী এশীয় সদস্য হিসেবে গণ্য হলেন।

তখনও চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সেভাবে আসে নাই। এবং তিনি ২০’র দশকের পুরোটাই কমিউনিস্ট পার্টির এশীয় প্রতিনিধির মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিনিধি ছিলেন এবং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের কমিনটার্নের এশিয়ান ব্যুরোর দায়িত্ব তিনি পান।

এরপরে তার মিশন ছিল উজবেকিস্তান। দুই ট্রেন ভর্তি অস্ত্রশস্ত্রসহ সাঁজোয়া গাড়ি রসদ সব নিয়ে তিনি তাশখন্দে যান।

তখন উজবেকিস্তানের কেন্দ্র ছিল বোখারা। বোখারার আমির উজবেকিস্তান শাসন করতেন। আমিরের যে স্বৈরাচারী শাসন উচ্ছেদে তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

মধ্য এশিয়ায় যাওয়ার পরে যেহেতু উজবেকিস্তান তাজিকিস্তান কাজাখস্তান একদম মুসলিম অধ্যাসিত এলাকা ছিল। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ইসলামের প্রতি আগ্রহী হলেন। ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করলেন।

তখন ২০’র দশকে আমাদের ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলন এবং এর পাশাপাশি খেলাফত আন্দোলন।

অসহযোগ আন্দোলন ছিল গান্ধীজীর আর খেলাফত আন্দোলন ছিল মাওলানা মোহাম্মদ আলী শওকত আলী এবং অসাম্প্রদায়িকতার এক উজ্জ্বল অধ্যায় ছিল তখন।

খেলাফত আন্দোলন হয়েছিল এও মজার আরকি ভারতবর্ষের লোকজন বিশেষত মুসলমানরা বাইরের ব্যাপারে সবসময় আগ্রহী ছিল।

খেলাফত আন্দোলনটা হচ্ছে তুরস্কের ওসমানিয়া খেলাফত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে তুরস্ক ছিল জার্মান পক্ষে।

জার্মানরা যখন পরাজিত হলো তখন তুরস্কের অবস্থাও একইরকম। তুরস্কের বিভিন্ন জায়গা ইংরেজরা দখল করে নিচ্ছে, এদিক থেকে ইরান হয়ে। তো তখন তুরস্কের খেলাফত রক্ষা করার জন্যে এখানকার মুসলমানদের আন্দোলন ছিল খেলাফত আন্দোলন।

মুচলেকা দিয়ে বাইরে এলে আমি তোমাদের দুজনকে গলাটিপে মেরে ফেলব…

এবং খেলাফত আন্দোলন ইংরেজ বিরুদ্ধ আন্দোলনে রূপ নিল এবং খেলাফত আন্দোলনের নেতা ছিলেন মাওলানা মোহাম্মদ আলী, মাওলানা শওকত আলী দুই ভাই।

দুই ভাইকে বন্দি করা হলো। আসলে মা-রা যে যুগে যুগে কত ইম্পর্টেন্ট রোল প্লে করেছেন। এরা হচ্ছেন আদর্শ মা।

মাওলানা মোহাম্মদ আলী শওকত আলী বন্দি ছিলেন ইংরেজদের কারাগারে এই সময় খবর বের হলো যে, মাওলানা মোহাম্মদ আলী শওকত আলী দুজন মুচলেকা দিয়ে জেলখানা থেকে ইংরেজের কাছে যে আর কখনো আন্দোলন করবে না এই করবে না সেই করবে না। বন্ড দিয়ে তারা বেরিয়ে আসবেন।

তো মাওলানা মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী তার মা ছিলেন বিয়ামি বেগম। তো বিয়ামি বেগমের কানে যখন গেল এটা, যখন উনি শুনলেন তিনি জেলখানায় গেলেন দেখা করতে এবং দেখা করে খুব পরিষ্কারভাবে বলেন, এইরকম জবরদস্ত বিপ্লবী দুই ছেলেকে, বলে যে, দেখ আমি শুনেছি যে তোমরা নাকি ইংরেজদের মুচলেকা দিয়ে বাইরে আসতে চাচ্ছ। যদি মুচলেকা দিয়ে বাইরে আসো আমি তোমাদের দুজনকে গলাটিপে মেরে ফেলব।

এই বৃদ্ধা মহিলার তেজ কী আরকি মানে!

দুই জোয়ান ছেলেকে বলছে যে, গলাটিপে মেরে ফেলব আরকি।

তো মোহাম্মদ আলী বলে যে না, মা; আমরা তো মানে প্রশ্নই ওঠে না। আর এরকম মায়ের ছেলে কখনো মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে আসে না আরকি।

তো এই ছিল খেলাফত আন্দোলন।

এবং খেলাফত আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল এখন থেকে রিক্রুট জোগাড় করা। তুরস্কের খলিফার সাহায্য করার জন্যে এখান থেকে সব লোকজন যাচ্ছে আরকি মানে।

পরিষ্কার হলো কমিউনিজমের একনায়কত্বের স্বৈরাচারী রূপ!

এদের একদল বিপ্লবী তারা আফগানিস্তান হয়ে তাশখন্দের প্রবেশ করল আরকি মানে। এবং এম এন রয় তাদেরকে মিলিটারি ট্রেনিং দেয়ার জন্যে ওখানে ভর্তি করে দিল তার স্কুলে। এবং তারা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করল ইরানে। এবং খোরাসানে মাশাদ থেকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে তাড়িয়ে দিল তারা।

উজবেকিস্তানে এম এন রয়ের নেতৃত্বে সোভিয়েত সরকার গঠিত হলো।

এরপরে তার যে প্রভাব চলতে থাকে ২৪ সাল পর্যন্ত। ২৪ সালে লেলিন মারা গেলেন। স্টালিন ক্ষমতায় এলেন।

লেনিন ভিন্নমতকে পছন্দ করতেন। কিন্তু স্টালিন কোনো ভিন্নমতকে পছন্দ করেন নাই। স্টালিনের সাথে তার আর চিন্তার মিল হলো না। এবং যখন দেখলেন যে, স্টালিনের এখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিপ্লবের জন্যে কাজ করা যাবে না। তিনি অনুভব করলেন যে, এখানে থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

এবং ১৯২৯ সালে স্টালিন তাকে বহিষ্কার করলেন।

বহিষ্কার করার পরে তিনি আবার নাম পরিবর্তন করলেন এম এন রায় হয়ে গেলেন ড. মাহমুদ। এবং ছদ্মনাম নিয়ে তিনি ভারত থেকে বেরোনোর ১৬ বছর পরে আবার ভারতে ফিরে এলেন।

কিন্তু ছদ্মনাম নিলে কী হবে! ইংরেজরা  অপেক্ষা করছিল দে হ্যাভ অল দি ইনফরমেশন। ফেরার কয়েকমাসের মধ্যেই তিনি গ্রেফতার হলেন এবং তাকে জেলে ঢোকানো হলো। ছয় বছর কারাদণ্ড দেয়া হলো।

যখন স্টালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেন তখন কমিউনিজমের  একনায়কত্বের যে স্বৈরাচারী রূপ এই রূপটা এম এন রয়ের কাছে পরিষ্কার হলো।

যখন তিনি ভারতে জেলখানায় তার পড়াশোনার এবং চিন্তার গভীরতা আরো বাড়ল। এবং তিনি নতুন মতবাদ তৈরি করলেন সেটা হচ্ছে রেডিকেল হিউম্যানিজম। রেডিকেল হিউম্যানিজম। বিপ্লবী মানবতাবাদ। যে মানবমুক্তির উপায় খুঁজতে শুরু করলেন।

এবং যখন তিনি মানব মুক্তির উপায় খুঁজছেন তখন স্বাভাবিকভাবে উজবেকিস্তানে থাকার সময় মধ্য এশিয়াতে অভিযান পরিচালনার সময় ইসলাম সম্পর্কে তিনি যে পড়াশোনা করেছিলেন, তিনি যে জ্ঞানার্জন করেছিলেন সেই জ্ঞানের আরো আরো গভীরে তিনি প্রবেশ করতে শুরু করলেন।

জেলে বসে লিখলেন ‘হিস্টোরিকেল রোল অব ইসলাম’

এবং জেলে বসেই তিনি ছোট্ট একটি বই লিখেন। সেটা হচ্ছে হিস্টোরিকেল রোল অব ইসলাম। হিস্টোরিকেল রোল অব ইসলাম।

১৯৩৯ সালে জেল থেকে তিনি মুক্তি পাওয়ার পরেই এটা প্রথম প্রকাশিত হয় এখন থেকে ৮০ বছর আগে। ইটস এ ওয়ান্ডারফুল বুক।

এই বইটি যখন লেখা হয় তখন অবিভক্ত ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতা উসকানোর জন্যে ইংরেজরা প্রচণ্ডভাবে ব্যস্ত এবং তিনি এখানে প্রথমবারের মতন দেখান ইসলামের তিনি যেহেতু একজন বিপ্লবী ছিলেন, তিনি নবীজীকে একজন সমাজ বিপ্লবী হিসেবে একজন সোশ্যাল রেভুলেশনারী হিসেবে অনুভব করেন যে মোহাম্মদ (স) যেটা করেছিলেন সেটা হচ্ছে, একটা সমাজ বিপ্লব। সমাজের অধিকার বঞ্চিত শোষিত নিপীড়িত মানুষের ক্ষমতায়ন করেছিলেন তিনি এবং তার মূলকথা হচ্ছে যে ইসলামের অভ্যুদয় মানবতাকে রক্ষা করেছিল যে সেভ হিউম্যানিটিজ অভ্যুদয় না যদি না ঘটত তাহলে মানবতা রক্ষা পেত না।

এবং তিনি ভূমিকায় খুব দুঃখ করে বলেছেন যে, ইন্ডিড দেয়ার ইজ নো আদার এক্সাম্পল অব টু কমিউনিটিজ লিভিং টুগেদার ইন দি সেম কান্ট্রি ফর সো মেনি হান্ড্রেড ইয়ার্স, এন্ড ইয়ার্ড হ্যাভিং সো ডিটেলস এপ্রিসিয়েশন অব ইচ আদার্স কালচার। নোর সিভিলাইজড পিপল ইন দি ওয়ার্ল্ড ইজ সো ইগনোরেন্ট অব ইসলামিক হিস্টোরি এন্ড কনটেমসিয়াস অব দি মোহামেডান রিলিজিয়ন এজ দি হিন্দুজ।

তিনি খুব দুঃখ করেছেন যে, আসলে পাশাপাশি থাকার পরেও ইসলাম সম্পর্কে আমরা এত কম জানি এবং ইসলামের যে ঐতিহাসিক অবদান এই অবদান সম্পর্কে আমরা কম জানি। এবং ওনার কনক্লুশন খুব চমৎকার তিনি বলেছেন যে ফেনোমেনাল সাকসেস অব ইসলাম ওয়াজ প্রাইমারিলি ডিউ টু দি রেভুলেশনারি সিগনিফিকেন্স এন্ড ইটস এবিলিটি টু লিড দি মেসেজ আউট অব দি হোপলেস সিচুয়েশন ক্রিয়েটেড বাই দি ডিকে অব এন্টিক সিভিলাইজেশন নট অনলি অব দি গ্রিস এন্ড রোম বাট অব পার্সিয়া এন্ড চায়না এন্ড অব ইন্ডিয়া আরকি।

যে আসলে সারা পৃথিবীতে সভ্যতার যে অবক্ষয় ঘটেছিল গ্রিসে, রোমে, পারস্যে, চীন এবং ভারতে। এই অবক্ষয় থেকে মুক্ত করেছিল ইসলাম এবং ইসলামের মূল গুরুত্ব হচ্ছে এটা। এবং তিনি বলছেন যে, দি গ্রেট হিস্টোরিয়ান গিভান্স ডেসক্রাইবড দি রাইজ এন্ড এক্সপানশন অফ ইসলাম এজ ওয়ান অফ দি মোস্ট মেমোরেবল রেভুলেশন্স হুইচ হ্যাজ ইমপ্রেসড এ নিউ এন্ড লাস্টিং কারেক্টার অন দি ন্যাশনস অব দি গ্লোব।

ওয়ান ইজ সিম্পলি এমেইজড টু দি কমপ্লিট এন্ড ইনক্রিডেবল রেপিডিটি উইথ হুইচ দি টু মাইটিয়েস্ট এম্পায়ার্স অব দি এনশিয়েন্ট টাইম ওয়্যার সাবভার্টেড বাই দি কম্পারেটিভলি স্মল ব্যান্ডস অব নোমাডস ইসুয়িং ফ্রম দি এরাবিয়ান ডেজার্ট ফায়ারড উইথ দি জিল অব দি নিউ ফেইথ।

তিনি খুব চমৎকারভাবে বলেছেন যে, পার্সিয়ান এবং রোমান সাম্রাজ্য বাইজেন্টাইন সম্রাটরা দেড় হাজার বছর যুদ্ধ করেছে পরস্পরকে পরাজিত করার জন্যে।

দেড় হাজার বছর যুদ্ধ করে যা পারে নাই এই আরবের কিছু মানুষ তারা নতুন বিশ্বাসে উজ্জীবিত হয়ে ১৫ বছরে দুই সম্রাজ্যকে শেষ করে দিল। এন্ড দেন এস্টাবলিস্ট দেমসেলভ অনলি ওয়ান পাওয়ার ইন দি ওয়ার্ল্ড

এবং তার কনক্লুশন লার্নিং ফ্রম দি মুসলিম ইউরোপ বিকেম দি লিডার অব দি মর্ডান সিভিলাইজেশন ইভেন টু ডে হার বেস্ট সানস আর নট এশেমড অব দি পাস্ট ইনডেটনেস। আনফরচুনেটলি ইন্ডিয়া কুড নট ফুলি বেনিফিটেড বাই দি হেরিটেইজ অব ইসলামিক কালচার বিকজ শি ডিড নট ডিজার্ট দি ডিসটিংকশন।

ইসলামের আবির্ভাব ঘটার আগে সামাজিক ন্যায় বিচারের কোনো ধারণাই ছিল না…

আসলে এম এন রয়ের এই যে উপলব্ধি, তিনি ইসলাম সম্পর্কে যে মত ব্যক্ত করেছেন তার উপলব্ধি যে ইসলামের আবির্ভাব ঘটার আগে সোশ্যাল জাস্টিস সামাজিক ন্যায় বিচারের কোনো ধারণাই ছিল না।

ধারণা ছিল শোষিত আরো শোষিত হবে- এটাই তার নিয়তি। মানুষ হিসেবে তাদের কোনো মর্যাদা ছিল না।

এবং ইসলাম সামাজিক সম্পর্কের চিরাচরিত ধারণাগুলোকে আমূল বদলে দেয় এবং যে উৎপাদন ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। আগে উৎপাদন ব্যবস্থায় যে উৎপাদনকারী শ্রমিক তার কোনো ন্যায় অংশ ছিল না। কিন্তু ইসলাম এসে এই অংশ এস্টাবলিশড করে যা সে আগে পেত না আরকি।

এম.এন রয় খুব পরিষ্কারভাবে বলেছেন, যে কারণে ইসলামের রাষ্ট্রে ব্যবসা এবং বাণিজ্যের দ্রুত বিস্তার ঘটে। কারণ এই ব্যবসা-বাণিজ্য এবং উৎপাদনে শ্রমিকরাও তাদের একটা ন্যায্য অংশ পেত। যে কারণে ইসলাম সেইসময় এত দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিল।

শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্যে সবসময় সত্যকে নিঃসংকোচে বলেছেন এম এন রয়…

এম এন রয় আগাগোড়া বিপ্লবী ছিলেন। কিন্তু বিপ্লব এবং বিপ্লবকে সুসংবদ্ধ করা দুটো জিনিসের মধ্যে কিন্তু তফাৎ রয়েছে।

বিপ্লবকে দৃঢ়মূল করার জন্যে যে ধৈর্য প্রয়োজন যে সহনশীলতা প্রয়োজন যে সিনথেসিস প্রয়োজন এম এন রয় সেই সিনথেসিস করার চেষ্টা করেছেন পরবর্তী জীবনে তার রেডিকেল হিউম্যানিজমের মধ্য দিয়ে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই সেইসময় তিনি সেভাবে আর সংগঠন করে তুলতে পারেন নাই। তার সে চেতনাও তার মৃত্যুর পরে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

এম এন রয়কে একজন বলেছেন যে, তিনি একটি জায়গাতে খুব স্থির ছিলেন যে শোষিতের অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে তিনি সারা পৃথিবী বিচরণ করেছেন।

এবং সারা পৃথিবী বিচরণকারী এক নিঃসঙ্গ সিংহের সাথে আরকি। যিনি কখনো আপস করেন নাই। কিন্তু ধীরে ধীরে নিঃসঙ্গ হয়ে গেছেন। এবং তিনি ১৯৫৪ সালে দেরাদুনে মারা যান।

আমরা তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি যে, একজন অসাম্প্রদায়িক বাঙালি ছিলেন তিনি। এবং শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্যে যখনই যেটা সত্য মনে করেছেন সে সত্যকে নিঃসংকোচে বলেছেন। এবং তার যে পারস্পরিক সম্প্রদায়িক মিলনের যে প্রচেষ্টা রেডিকেল হিউম্যানিজমের মধ্য দিয়ে তিনি সেটাই ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছেন।

যে, আসলে দুই সম্প্রদায় এই ভূখন্ডের প্রধান সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে যত পরস্পর জানাশোনা হবে, পরস্পরের চিন্তা পরস্পরের ধর্ম পরস্পরের বিশ্বাস পরস্পরের সংস্কৃতি সম্পর্কে তারা যত জানবে তত তারা উদার হবে এবং তত তাদের জাতিসত্তার বিকাশ ঘটবে এবং তত তাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটবে।

এম এন রয় অসাম্প্রদায়িকতার এবং শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ নিঃস্বার্থ একজন সৈনিক। এবং তার প্রতি আমরা আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

[প্রজ্ঞা জালালি, ০৪ মার্চ, ২০২০]

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All Rights Reserved © rmgbdnews24.com