এনক বম
গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: ১১ অক্টোবর ২০২৪
‘পাহাড়ি চেহারা! নিশ্চয় কোটায় চান্স পেয়েছ?’ এরকম প্রশ্নের মুখোমুখি আমাকে হরহামেশাই হতে হয়।
কোটা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি কিনা এটা নিয়ে প্রথম বর্ষ থেকে খোঁটা দিয়েছে অনেকেই। এখনো এসবের সম্মুখীন হতে হয়। আগেও আমি এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে এড়িয়ে যেতাম। এখনো তা-ই করি। কারণ সত্যটা তো আমিই জানি। আমি কোনো কোটায় নয়, মেধায় চান্স পেয়েছি। আমি যে বছর পরীক্ষা দেই, চারুকলার ১৩৫টি সিটের মধ্যে মেধা তালিকায় আমি ২৯ তম হয়েছিলাম।
আমার পুরো নাম এনক সাংতিন লিয়ান বম। সংক্ষেপে এনক বম। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সাথেই অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন (২০২৩) করেছি। এখন আমি নিজেকে একজন আত্মবিশ্বাসী তরুণ মনে করি। বলে রাখি, এই আত্মবিশ্বাস কোনো ঔদ্ধত্য নয়। এটি বিনয়ের শিক্ষা। এই শিক্ষা পেয়েছি আমি আমার শিক্ষালয় কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজে, যেখানে আমি প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ১২টি বছর অধ্যয়ন করেছি। এখন ভাবতে অবাক লাগে—১২ বছর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমি অবস্থান করেছি। শিশু বয়সেই চলে এসেছিলাম কোয়ান্টামে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই।
কত স্মৃতি! কত আনন্দ! বন্ধু! শিক্ষক!
আমি ২০০৪ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত কোয়ান্টামমে ছিলাম। ২০০৪ সালে ১ম শ্রেণিতে যখন ভর্তি হই, সে-সময় বিদ্যুৎ ছিল না। জেনারেটর দিয়ে সন্ধ্যার পর লাইট জ্বালানো হতো। প্রায় সময় জেনারেটর নষ্ট হয়ে যেত, পড়াশোনার জন্যে হারিকেন ছিল আমাদের ভরসা।
এখনকার অবস্থা কিন্তু ভিন্ন। কিছুদিন আগে স্কুলে বেড়াতে গিয়ে দেখলাম ক্যাম্পাস সুবৃহৎ আকার ধারণ করেছে। ভাবতেই অবাক লাগে! তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ছনের ঘরে ক্লাস করেছি আমরা। দুপাশে বেড়া নেই, সামনে শুধু একটি ব্ল্যাকবোর্ড। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনেই কিছু স্কুল ভবন নির্মাণ হয়।
চিত্রকলার প্রতি আমার ছোটবেলা থেকেই প্রবল আগ্রহ ছিল। চারুকলা নিয়ে যে পড়াশোনা করা যায় তা জানতে পেরেছি সপ্তম শ্রেণিতে উঠে। ঐসময় ধর্মদাস স্যার জানিয়েছিলেন ছবি আঁকা নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া যায়। তখন আমার মনে স্বপ্ন জন্মেছিল ছবি আঁকা নিয়ে আমি পড়ব।
আমাদের স্কুলে শুধু পড়াশোনাই করানো হতো না। আমাদের প্রত্যেকের কোনো না কোনো খেলাধুলায় বা প্যারেড বা ব্যান্ডে পারদর্শিতা ছিল। সপ্তম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় চার মাস আমি ব্যান্ড ট্রেনিংয়ের জন্যে চট্টগ্রামে ছিলাম। তখন পড়াশোনার পাশাপাশি ছবি আঁকতাম। ধর্মদাস স্যারের সহযোগিতায় বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইনস্টিটিউটে চারুকলার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি এবং কয়েকবার পুরস্কারও পেয়েছি। এমনকি চট্টগ্রাম বিভাগে প্রথম হয়েছিলাম। প্রাপ্ত ক্রেস্টটি এখনো আমাদের স্কুলে সংরক্ষিত আছে।
ছবি আঁকা, পড়াশোনার পাশাপাশি খো খো খেলা ও আর্চারিতে আমি দক্ষ একজন খেলোয়াড় ছিলাম আমাদের ক্যাম্পাসে। খেলাধুলা করতে পারার যে নির্মল একটা আনন্দ আছে এটা প্রত্যেক কোয়ান্টা তার জীবনে উপভোগ করেছে, যেটা হয়তো শহরের ছেলেরা সহজে পায় না।
এবার আমার লেখাপড়ার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। পাবলিক পরীক্ষায় বাণিজ্য বিভাগে এসএসসি-তে এ প্লাস এবং এইচএসসি-তে এ পেয়েছিলাম। কোয়ান্টাম কসমো কলেজের ক্যাম্পাসে বসেই বিবিএ ও চারুকলা দুটো বিভাগের জন্যে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম একমাস। এরপর চিন্তা করলাম আমার যেহেতু ছবি আঁকতে ভালো লাগে এবং কম্পিউটারে গ্রাফিক ডিজাইনেও আগ্রহ আছে, তাই বিবিএ প্রস্তুতি বাদ দিয়ে চারুকলার প্রতি মনোযোগ বাড়ালাম।
নির্দিষ্ট সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। প্রথমে লিখিত তারপর ড্রইং পরীক্ষা হলো। রেজাল্ট বের হলো। মেধা তালিকায় আমার নিজের স্থান দেখে আমি সেদিন অনেক খুশি হয়েছিলাম। মা-বাবাকে ফোন করে জানালাম। মা খুশিতে কাঁদছিলেন। বান্দরবানে লাইমি পাড়ায় আমাদের বম জনগোষ্ঠীর সবাই আমার সাফল্যে সেদিন আনন্দে মেতে উঠেছিল। পাড়াজুড়ে সে কী আনন্দ! আমার বাবা প্রায়ই এই স্মৃতিচারণ করেন।
এগুলো এখন অতীতের সুখস্মৃতি ও আমার জীবনের সংগ্রামের গল্প। আমি আরো উচ্চতর পড়াশোনা করতে চাই। পরিবারের দায়িত্বও অনেক। এখন আমার স্বপ্ন ভালো মানুষ ও ভালো গ্রাফিক ডিজাইনার হওয়া, যাতে নিজের সম্প্রদায়ের জন্যে, দেশের জন্যে কিছু করতে পারি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৫৩ তম সমাবর্তন দিবসে ক্যাম্পাসে মা এসেছিলেন। মা জুমচাষ ও বাসার কাজেই সবসময় ব্যস্ত থাকেন। আর বাবার বান্দরবানের রোয়াংছড়ি থানার কচ্ছপতলি বাজারে একটি ফার্মেসির দোকান আছে। এখন আমাদের এলাকায় লেখাপড়ার বেশ চাহিদা শুরু হয়েছে। কিন্তু ২০ বছর আগে এমনটা ছিল না। আমার মা-বাবা সে—সময় লেখাপড়ার গুরুত্ব
বুঝেছিলেন বলে আমাকে কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে ভর্তি করান। এলাকার অনেকের মুখে তখন বিরূপ মন্তব্য শুনলেও এখন তারাই মা—বাবাকে প্রশংসা করে বলেন, আপনারা সচেতন অভিভাবক।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]