যারা কোভিড-১৯ সৃষ্ট উৎকণ্ঠা বিষণ্ণতা দূরের জন্যে এই সময়ে বিশেষভাবে কাজ করেছেন তাদের একজন হলেন প্রফেসর স্টিভেন লরিস।
তিনি একজন নিউরোলজিস্ট হিসেবে বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি অব লিজ হাসপাতালের নিউরোসায়েন্স গবেষণার প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।
নিউ সায়েন্টিস্ট সাময়িকীর ৩রা এপ্রিল ২০২১ সংখ্যায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ব্রেনকে রিটিউন করার পাশাপাশি মহামারির সুদূরপ্রসারি ও ক্ষতিকর নানা প্রভাব থেকে মুক্তি দেয়ার ক্ষেত্রে মেডিটেশন চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’।
তিনি তার সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে এমন অনেক রোগী আছেন যারা দীর্ঘদিন ধরে ব্যথা-বেদনা দুশ্চিন্তা ও বিষণ্ণতায় ভুগছেন। তাদের অসুস্থতা ও কষ্ট আরো বেড়ে গেছে কোভিডের সময়ে।
প্রচলিত চিকিৎসার পাশাপাশি আমরা তাদেরকে মেডিটেশনে উদ্বুদ্ধ করি। এবং এই রোগীরা প্রায়ই আক্ষেপ করে বলেন, “খুব ভালো হতো যদি মেডিটেশনের কথা আরো আগে জানতে পারতাম।”
প্রফেসর স্টিভেন লরিস বলেন, ‘আসলে দেহে রোগ-বালাই বাসা বাধার পরে নয় বরং আরো আগেই যদি মেডিটেশনের চর্চা শুরু করা যায় তাহলে রোগজীবাণু প্রতিহত করাটা অনেক সহজ হবে’।
তিনি বলেন, ‘মেডিটেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর চর্চা ব্রেনকে রিটিউন করে। সহজ ভাষায় মেডিটেশন হলো ব্রেনের ব্যায়াম’।
যখন কেউ নিয়মিত দৌড়ায় স্বাভাবিকভাবেই তার পায়ের পেশি মজবুত হয়।
যখন কেউ সাঁতার কাটে তার কাঁধ ও হাতের পেশির শক্তি বাড়ে।
তেমনি যখন কেউ মেডিটেশন করে তখন তার ব্রেনের ভেতরে আসে নানা ইতিবাচক পরিবর্তন।
নিয়মিত মেডিটেশন ব্রেন স্কেন করে দেখা যায় দীর্ঘদিন নিয়মিত মেডিটেশনের ফলে ব্রেনের গ্রে-ম্যাটারের পরিমাণ বাড়ে, যা মনোযোগায়নের ক্ষেত্রে মনোযোগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সেইসাথে ব্রেনের হিপোক্যাম্পাস অংশ বিস্তৃত হয় এবং এই হিপোক্যাম্পাস অংশ স্মৃতিশক্তির জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইনসুলার কর্টেক্স ও লেফট প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। এবং এই পরিবর্তন আমাদের আভ্যন্তরীণ অনুভূতি ও ভাবাবেগের ভারসাম্য বজায় রাখে।
তিনি বলেন, অনেকে প্রশ্ন করেন, মেডিটেশন কি কোভিড-১৯ থেকেও আমাদের রক্ষা করতে পারে?
আসল সত্য হচ্ছে, দেহের ওপর এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর মনের যে প্রভাব তা আমরা অল্পদিন হলো বুঝতে শুরু করেছি।
দুশ্চিন্তা-উদ্বিগ্নতা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। আর দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে মেডিটেশন একটি অসাধারণ প্রক্রিয়া।
আর এটাও প্রমাণিত যে, যে-কোনো ভ্যাকসিন বা রোগের চিকিৎসা কতটা কার্যকরী হবে তা অনেকটাই নির্ভর করে ব্যক্তির মানসিক অবস্থার ওপর। সেই বিচারে বর্তমান প্রেক্ষাপটে মেডিটেশন চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রফেসর স্টিভেন লরিস বলেন, ‘আমরা সবাই জানি, এই মহামারির প্রভাব থেকে শিশুরাও মুক্ত নয়। তাদেরও স্বাভাবিক প্রাণবন্ত জীবনে ফিরিয়ে আনতে অবশ্যই মেডিটেশনের শিক্ষা দিতে হবে।
আশ্চর্য হলেও সত্য, আমাদের স্কুলগুলোতে জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করার জন্যে অনেক শিক্ষক আছেন, শারীরিক শিক্ষা ও ফিটনেসের জন্যেও শিক্ষক আছেন।
তাহলে মনের যত্ন কীভাবে নিতে হবে সেই শিক্ষা দেয়ার জন্যে কোনো শিক্ষক কেন থাকবেন না? এ বিষয়টি আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরেই অবহেলিত।’
ড. স্টিভেন বলেন, ‘যদি আমার কথাই ধরি আমাকে শেখানো হয়েছে কীভাবে চিকিৎসক হওয়া সম্ভব। কিন্তু কেউ শেখায় নি কীভাবে আমি নিজেকে ভালো রাখব।
মেডিটেশন আমাদের চারপাশের ঘটনাগুলোকে বদলে ফেলতে পারবে না। কিন্তু প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিত প্রতিটি ঘটনায় আমাদের দেহ-মন কীভাবে প্রভাবিত হবে সেই বিষয়টির ওপর নিয়ন্ত্রণ এনে দেবে মেডিটেশন।
আমি বিশ্বাস করি একসময় আমাদের প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পরিণত হবে মেডিটেশন।
প্রফেসর স্টিভেন লরিস মেডিটেশন সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছেন, আমরা কোয়ান্টামে ৩০ বছর ধরে এই কথাগুলোই বলছি।
আসলে মেডিটেশন ভালো রাখার জন্যে ভালো থাকার জন্যে কীভাবে কাজ করে কীভাবে ভালো রাখে সুস্থ রাখে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ভেতরে মনোবল সৃষ্টি করে সেটা তো করোনাকালে আমরা নিজেরাই দেখেছি।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন যে, করোনা গত দেড় বছরে সারা পৃথিবীতে যে ট্রমা সৃষ্টি করবে পোস্ট কোভিড ট্রমা সেটা কাটাতে পৃথিবীর ৩০ বছর সময় লাগবে।
যেরকম ভিয়েতনাম যুদ্ধের যে ট্রমা এই ট্রমা কাটাতে যুক্তরাষ্ট্রের লেগেছিল ৩০ বছর।
পরম করুণাময়ের ওপর ভরসা করে বলতে পারি আমরা যেহেতু স্রষ্টার বিশেষ অনুগ্রহভাজন জাতি এবং যে-কোনো দুর্যোগে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি আমাদের সবচেয়ে বেশি, যেহেতু আমরা সবচেয়ে সফলভাবে করোনা পরিস্থিতি এবং করোনা সৃষ্ট আতঙ্ক থেকে সবচেয়ে অল্প সময়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছি, যেহেতু আমাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে অনেক গুণ বেশি- এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির অন্যতম অনুঘটক হচ্ছে মায়ের বুকের দুধ।
এবং এই দুগ্ধদানের ক্ষেত্রে আমরা যেহেতু এখন পৃথিবীতে প্রথম স্থানে অবস্থান করছি, আর যে মেডিটেশন চর্চা ব্রেনকে রিটিউন করতে পারে এই চর্চার ইতিহাস আমাদের ৩০ বছরের।
তো অন্যদের যদি ৩০ বছর লাগে এই ট্রমা কাটাতে আমরা যদি আন্তরিকভাবে সবাইকে যত্নায়ন দমচর্চা ইয়োগা মেডিটেশন এবং প্রার্থনায় সাধারণ মানুষকে একাত্ম করতে পারি তো ইনশাল্লাহ পোস্ট কোভিড ট্রমা কাটাতে আমাদের লাগবে ৩০ মাস।
প্রিয় সুহৃদ! যেখানে আমাদের কথাগুলোই আজ নিউরোসায়েন্টিস্ট এবং নিউরোলজিস্টরা বলছেন, অতএব চারপাশে কোয়ান্টামের বাণীকে নিঃসংকোচে ছড়িয়ে দিন। সবাইকে মেডিটেশনে নিয়ে আসুন।
৩০ মাসে ট্রমামুক্ত হয়ে নতুন উদ্যমে নতুন লক্ষ্য দিয়ে নতুন ইতিবাচকতায় আমরা আমাদের জাতিকে নতুন উচ্চতায় এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি।
আসলে যেখানে সংকট যেখানেই সমস্যা যেখানেই চ্যালেঞ্জ সেখানেই কোয়ান্টাম অগ্রণী ভূমিকা রাখতে চায়।
যেভাবে কোভিড মোকাবেলায় করোনাযোদ্ধা হিসেবে আমরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছি, একইভাবে পোস্ট কোভিড ট্রমা উত্তরণে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখব ইনশাল্লাহ।
আপনারা সবসময় নিজের যত্ন নেবেন। যত্নায়নের জন্যে যা যা করতে হয় করবেন।
দমচর্চা করবেন ইয়োগা করবেন মেডিটেশন করবেন। এবং প্রার্থনায় একাত্ম থাকবেন। তাহলেই আমরা সবাই ভালো থাকব।