‘নিরাপদ সড়ক দিবস’ ঘোষণার পরেও দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর মিছিল এখনও থামেনি। ঘোষণার একবছর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে গণমানুষের দুর্বার আন্দোলন দেখেছে বাংলাদেশ। সরকার বাধ্য হয়ে সংশোধন করে সড়ক আইনটিও, বাড়ানো হয় ঘাতকদের শাস্তি। কিন্তু তাতেও সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলা, বন্ধ হয়নি মানুষের আহাজারি। তার প্রমাণ মেলে গত ৭ বছরে ৩৭ হাজার ৪২২টি সড়ক দুর্ঘটনায়। এসব দুর্ঘটনায় ৫১ হাজার ৬৬৫ জন মানুষ নিহত হয় এবং আহতের সংখ্যা ১ লাখের বেশি।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিগত ৭ বছরে ৩৭ হাজার ৪২২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১ হাজার ৬৬৫ জন নিহত এবং ১ লাখ ৩৯৭ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত, ২১ হাজার ৮৫৫ জন আহত হয়। ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৪ হাজার ৩১২টি, আর ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত, ১৫ হাজার ৯১৪ জন আহত। ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৯৭ জন নিহত, ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হন ২০১৭ সালে। ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৪৬৬ জন আহত হন। ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮৫৫ জন নিহত, ১৩ হাজার ৩৩০ জন আহত হয়েছেন। ৪ হাজার ৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত, ৮ হাজার ৬০০ জন আহত হন ২০২০ সালে। ২০২১ সালে ৫ হাজার ৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনায় ৭ হাজার ৮০৯ জন নিহত, ৯ হাজার ০৩৯ জন আহত হয়েছেন।
বছরভিত্তিক এই হিসাব বলছে, ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৫৮১টি, যা ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৬২৯টিতে। ২০১৫ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৬৪২ জন, যা ২০২১ সালে ৭ হাজার ৮০৯ জনে নেমেছে। আর ২০১৫ সালে আহত মানুষের সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৮৫৫ জন, যা ২০২১ সালে কমে ৯ হাজার ৩৯ জন হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণা এবং ২০১৮ সালের আন্দোলনের পর দুর্ঘটনা আগের চেয়ে বাড়লেও কমেছে হতাহতের সংখ্যা।
এদিকে, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা আরেক সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুসারে, গত তিন বছরে ১৪ হাজার ৭৯৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে সারা দেশে। এতে প্রাণহানির সংখ্যা ১৬ হাজার ৯২৬ জন, আর আহতের সংখ্যা ২১ হাজার ৯৫০ জন। এর মধ্যে ২০১৯ সালে দুর্ঘটনা ৪ হাজার ৬৯৩টি, নিহত ৫ হাজার ২১১ জন, আহত হয়েছেন ৭ হাজার ১০৩ জন। ২০২০ সালে দুর্ঘটনা ৪ হাজার ৭৩৫টি, নিহত ৫ হাজার ৪৩১ জন, আহত হন ৭ হাজার ৩৭৯ জন। ২০২১ সালে দুর্ঘটনা ৫ হাজার ৩৭১টি, নিহত ৬ হাজার ২৮৪ জন, আহত হয়েছেন ৭ ৪৬৮ জন।
সংগঠনটির হিসাব মতে, নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের পর তিন বছরের ব্যবধানে দুর্ঘটনা, নিহত ও আহত বেড়েই চলেছে। ২০১৯ সালে দুর্ঘটনা ছিল ৪ হাজার ৬৯৩টি, যা ২০২১ সালে বেড়ে ৫ হাজার ৩৭১টিতে পৌঁছেছে। নিহতের সংখ্যা ২০১৯ সালের ৫ হাজার ২১১ জন থেকে বেড়ে ৬ হাজার ২৮৪ জন, আর আহতও ৭ হাজার ১০৩ জন থেকে বেড়ে ৭ হাজার ৪৬৮ জন হয়েছে। এছাড়া চলতি বছরের গত ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ২২৪টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫ হাজার ৫৭ জন এবং আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪১৪ জন। অর্থাৎ দুর্ঘটনা, নিহত ও আহতের ক্ষেত্রে এই হিসাবও পুরো বছরের মোট সংখ্যার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে এরইমধ্যে।
এবার চোখ ফেরানো যাক, মাস ও দিনভিত্তিক পরিসংখ্যানে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলেছে— গত মাসে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে সারা দেশে ৪০৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৭৬ জন এবং আহত ৭৯৪ জন। এ মাসে প্রতিদিন নিহত হয়েছে ১৫ দশমিক ৮৬ জন। আগস্ট মাসে ৩ হাজার ৭৫৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬০৩ জন নিহত এবং ২ হাজার ৯৯০ জন আহত হন। এ মাসে গড়ে প্রতিদিন নিহত হয়েছেন ১৯ দশমিক ৪৫ জন।
নিহতদের অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত বলছে, সেপ্টেম্বরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৪৭৬ জনের মধ্যে ১০৩ জনই ছিলেন পথচারী, যা মোট নিহতের ২১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। নিহতের মধ্যে নারীর সংখ্যা ছিল ৬২, শিশু ৭৭। আগস্টে নিহতদের মধ্যে ৫০ শতাংশই শিশু-কিশোর-তরুণ, যাদের বয়স ৭-২৫ বছর এবং তাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী। সেপ্টেম্বরে শিক্ষার্থী নিহত হন ৬২ জন, শিক্ষক নিহত হন ১৪ জন। এ মাসে দুর্ঘটনায় ১৯-৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হন ৩৮৪ জন, অর্থাৎ ৮০ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৩৪টি (৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ১৫৮টি (৩৮ দশমিক ৮২ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে, ৭৩টি (১৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ) গ্রামীণ সড়কে এবং ৩৬টি (৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৬টি ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ সংঘটিত হয়েছে। দুর্ঘটনাগুলোর ৬৬টি (১৬ দশমিক ২১ শতাংশ) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৮৭টি (৪৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১০৫টি (২৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ) পথচারীকে চাপা বা ধাক্কা দেওয়া, ৪১টি (১০ দশমিক ০৭ শতাংশ) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং আটটি (১ দশমিক ৯৬ শতাংশ) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘মালিকদের অতি মুনাফার লোভ, চালক-সহকারীদের অদক্ষতা এবং পথচারীদের অসচেনতার কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে, বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। দুর্ঘটনা ঘটলেই শোনা যায়, চালকের লাইসেন্স নেই, গাড়ির ফিটনেস নেই। গাড়িটি দ্রুত গতিতে চলছিল, চালক মাদকাসক্ত ছিল। পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানোর জন্য কিংবা মোবাইল ফোনে চালকের কথা বলার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। কিন্তু উত্তরণের কোনও উদ্যোগ বা পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি না। উল্টো সড়কে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য চলছে।’
এ বিষয়ে রোড সেফটির নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি, গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।’
সড়কে দুর্ঘটনা রোধে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সুপারিশগুলো হলো— দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে, বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্ব রাস্তা (সার্ভিস রোড) তৈরি করতে হবে, পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে, গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে, রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমাতে হবে, টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন আরও বলছে— রেল ট্র্যাকে দুর্ঘটনা বাড়ছে। ট্রাক-সহ পণ্যবাহী দ্রুতগতির যানবাহন ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাও কমছে না। মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ড্রাইভারদের বেপরোয়া গতিতে পণ্যবাহী যানবাহন চালানো এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যান্য যানবাহনকে আক্রান্ত করছে। গণপরিবহন সহজ, সাশ্রয়ী ও উন্নত করে, যানজট কমিয়ে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করা অতীব জরুরি।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যস্থাপনার কারণে। এই অবস্থার উন্নয়নে টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। এ জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন বলে জানানো হযেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সুপারিশে।