সূরা লোকমানের ৩৪ নম্বর আয়াতে আছে, ‘নিশ্চয়ই কখন কেয়ামত হবে তা শুধু আল্লাহই জানেন। তিনি মেঘ থেকে বৃষ্টিবর্ষণ করেন। তিনি জানেন জরায়ুতে কী আছে। অথচ কেউই জানে না আগামীকাল তার জন্যে কী অপেক্ষা করছে এবং কেউ জানে না কোথায় তার মৃত্যু হবে। শুধু আল্লাহই সর্বজ্ঞ, সব বিষয়ে অবহিত। আমার প্রশ্ন হলো, বর্তমানে আবহাওয়া দফতর মেঘ বা বৃষ্টির পূর্বাভাস বেশ নিখুঁতভাবেই দিতে পারে। তেমনি চিকিৎসাপ্রযুক্তির মাধ্যমে এখন গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গ শুধু নয়, তার শারীরিক বিষয়েও অনেক কিছু জানা সম্ভব। তাহলে এটা আর গায়েব থাকল কোথায়?
আসলে এই আলোচনাতে যাওয়ার আগে আমাদের বুঝতে হবে গায়েব কী? গায়েব হচ্ছে মানবীয় জ্ঞান বুদ্ধি প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের অগম্য বিষয়। মানবীয় জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রযুক্তি বিজ্ঞান যে পর্যন্ত যায় নি সেটাই হচ্ছে গায়েব।
সাধারণভাবে আমাদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা আছে যে ধর্ম ও বিজ্ঞান বোধ হয় পরস্পরের সাথে সাংঘর্ষিক। বিজ্ঞান ধর্ম মানে না। আবার ধার্মিক হতে হলে বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া যাবে না।
অথচ বাস্তব সত্য হচ্ছে, ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ তো নেইই, বরং একটি আরেকটির পরিপূরক। বহু বিজ্ঞানী আছেন, যারা আস্তিক শুধু নন, রীতিমতো ধর্মানুসারী। আর যথার্থ বিজ্ঞানমনস্ক না হলে ধার্মিক হওয়া সম্ভব নয়।
আসলে বিজ্ঞান হচ্ছে প্রযুক্তি বা বস্তুগত জ্ঞান আর ধর্ম হচ্ছে নৈতিক বিধিবিধান। অর্থাৎ এই প্রযুক্তি দিয়ে কীভাবে মানুষের কল্যাণ করা যাবে, কতটুকু করা যাবে আর কতটুকু করা যাবে না- এই নৈতিকতাবোধ তৈরি করে ধর্ম।
আবার বিজ্ঞানের সীমানা দৃশ্যমান জগত পর্যন্ত। গায়েব বা অদৃশ্যজগত নিয়ে বিজ্ঞানের কোনো কাজ নেই। যেমন, হিসাবনিকাশের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানীরা আন্দাজ করেন যে, ধূমকেতু এসে পৃথিবীকে ধাক্কা দেবে। কিন্তু কখন ধাক্কা দেবে তা কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে কারো পক্ষে বলা সম্ভব না। এটা একমাত্র আল্লাহই জানেন। এজন্যেই মর্মবাণীতে আমরা উল্লেখ করেছি, কখন কেয়ামত হবে, তা শুধু আল্লাহই জানেন।
বৃষ্টির ব্যাপারে আয়াতটাও খুব পরিষ্কার। তিনি মেঘ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। কিন্তু আল্লাহ বলেন নি যে, বৃষ্টির ব্যাপারে শুধু আমিই জানি।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বৃষ্টি হওয়ার আগেই যে বিজ্ঞান জানছে, বলছে, সেটা তাহলে কী? আমরা যদি লক্ষ করি, আবহাওয়া পূর্বাভাসের প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে? স্যাটেলাইটসহ যতরকম উন্নত প্রযুক্তি আছে, তা দিয়ে তারা দেখছে, উপাদানগুলো যখন সৃষ্টি হয়েছে, দৃশ্যমান জগতে যখন তা আসছে। কাজেই তা কিন্তু আর গায়েব থাকছে না।
যেমন, এই হলে যারা আছেন, তারা আমাকে সরাসরি দেখছেন। কিন্তু যারা এই হলের বাইরে আছেন, তারাও তো আমাকে দেখছেন। যদিও আমি সেখানে সরাসরি নেই। কিন্তু সেটা কি গায়েব? না সেটা গায়েব নয়। বরং সেটা হলো যন্ত্রপাতি।
অতএব পূর্বাভাস বা ফরকাস্টিং হচ্ছে একটা ক্যালকুলেটেড গেজওয়ার্ক। এটা অর্থনীতি নিয়ে করা হয়, রোগীর রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে করা হয়। আপনারা তো নিশ্চয়ই জানেন, অনেক রোগীকেই ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দেন। বলেন, এত বছর বাঁচবেন। কিন্তু দেখা যায়, ডাক্তারদের ভবিষ্যদ্বাণী অগ্রাহ্য করে রোগী সে সময়ের পরও বেঁচে আছে! আবার উল্টোটাও হয়। ডাক্তার হয়তো বলছেন, বাসায় নিয়ে যান। আর চিন্তা নাই। কিন্তু বাসায় যাওয়ার পরই রোগী মারা গেল!
কাজেই আবহাওয়াবিদরা যে পূর্বাভাস বা ফরকাস্টিং দিচ্ছেন, বলছেন আগামীকাল বৃষ্টি হবে বা হবে না- এটা গায়েব না। কারণ আগামীকাল তো অলরেডি দৃশ্যমান হয়ে গেছে। যেমন, মৌসুমী বায়ু বঙ্গোপসাগর দিয়ে রওনা হয়ে গেছে। বায়ুর গতিপথ ধরে আবহাওয়াবিদরা বলছেন এই হবে বা ঐ হবে। কিন্তু এটা যদি পাঁচ বছর, দশ বছর পর হতো, তাহলে এটা গায়েব হতো। যেমন, কেউ যদি বলে যে, ১০ বছর পর আজকের তারিখে একটা ঘুর্ণিঝড় হবে বা অন্য কিছু হবে। সেটা হবে গায়েব। আর সেটা কারো পক্ষে সম্ভব না।
এই পূর্বাভাস নিয়েও মজার কাহিনী আছে। তুরস্কের এক গ্রামের ঘটনা। সেখানে আমেরিকান বিজ্ঞানীরা গেছেন। বৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করার জন্যে। গবেষকরা গিয়ে যখন মাঠে যন্ত্রপাতি বসাচ্ছেন, হঠাৎ তাদের চোখ পড়ল এক রাখালের দিকে। রাখাল তার ছাগলের পাল নিয়ে মাঠ থেকে খামারের দিকে ফিরছিল। তারা জিজ্ঞেস করল, এরকম চমৎকার রোদ ঝলমলে দিনে তুমি তোমার ছাগলের পাল মাঠে না চড়িয়ে খামারে ফিরছ কেন। সে বলল, কারণ একটু পরে বৃষ্টি নামবে।
বিজ্ঞানীরা তো অবাক! কারণ ঝকঝকে আকাশে মেঘ বা বৃষ্টির কোনো আভাসই নেই। তারা তাদের যন্ত্রপাতি দিয়েও পরীক্ষা করল। সেখানেও বৃষ্টির কোনো পূর্বাভাস ধরা পড়ল না। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো, একটু পরে ঠিকই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। বিজ্ঞানীরা পাকড়াও করলেন, সেই রাখালকে। বললেন, যে বৃষ্টির আভাস আমাদের যন্ত্রপাতিতেও ধরা পড়ছে না, সেই বৃষ্টি সম্পর্কে তুমি কি করে আগেভাগে বললে?
রাখাল বলল, দেখ এটা আমি না, আমার ছাগলরা ঝুঝতে পেরেছে। কারণ আমি আমার রাখাল থাকার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বৃষ্টি আসার আগে আমার ছাগলগুলো তাদের লেজ দুপায়ের মাঝখান দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়! মানে, ছাগল আসলে বৃষ্টি বা পানিকে খুব ভয় পায়। তো বৃষ্টি আসার আগে তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় সে যখন এটা বুঝতে পারে, নিশানা হিসেবে সে তার লেজকে পায়ের ফাঁকে ঢুকিয়ে দেয়। গৃহপালিত পশু হিসেবে যেহেতু তাকে চলাফেরা করতে হয় তার পালকের ইচ্ছানুযায়ী, কাজেই পানি থেকে বাঁচার জন্যে এটা তার মতো করে এক ধরনের প্রতিরক্ষা কৌশল।
আমেরিকান বিজ্ঞানীরা হতভম্ব হয়ে গেলেন। একজন ক্ষোভের সাথে বললেন এতসব যন্ত্রপাতির চেয়ে ছাগলের লেজের সংবেদনশীলতাই তো তাহলে বেশি!
অর্থাৎ প্রকৃতিরও একটা নিজস্ব পূর্বাভাস প্রক্রিয়া আছে। যা এই পশুদের মধ্যেও সক্রিয়। যেমন, আমরা অনেকেই জানি, ভূমিকম্পের সময় ইঁদুর তার গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। এমনকি দেখা গেছে, ভূমিকম্প হয়েছে ১২ ঘণ্টা পরে। কিন্তু ১২ ঘন্টা আগেই ইঁদুর বেরিয়ে এসেছে। তেমনি একজন সাধারণ কৃষক যে প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে তার জীবিকা নির্বাহ করে, এরকম ছোটখাটো অনেক পূর্বাভাস জ্ঞান সহজাতভাবেই সে অর্জন করে।
আবার কোনো কোনো মানুষের মধ্যেও এটা কাজ করতে পারে। যেমন, হযরত বদিউজ্জামান নূরসী, তুরস্কের একজন কামেল বুজুর্গ ছিলেন। বৃষ্টি হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা আগে তার হাঁটু ব্যথা হতো। তেমনি আরেকজন ছিলেন, আমাদের দেশের হাফেজ মাওলানা হাবীবুর রহমান। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ হলে তার মাথাব্যথা হতো। তখন তো নিম্নচাপের খবর এত তৎক্ষণাৎ পাওয়া যেত না। তো দেখতাম ওনার মাথাব্যথার খবর পাওয়ার তিন থেকে চার দিন পর শুনি বঙ্গোপসাগরেও নিম্নচাপ হয়েছে। সময় মিলিয়ে দেখতাম, একই সময়। এরপর আমি জোক করে বলতাম, আপনার মাথাব্যথা হলেই আমাকে ফোন করে দেবেন। আমি ফরকাস্ট করে দেবো। এমনকি তার মাথাব্যথার তীব্রতার সাথে বিপদসংকেতও ওঠানামা করতো। দুয়েকবার অন্যরকম হলেও অধিকাংশ সময়ই এটা ঠিক হতো।
তিন নম্বর পয়েন্ট হচ্ছে, আল্লাহ জানেন জরায়ুতে কী আছে। আল্লাহ কিন্তু বলেন নি যে, আর কেউ জানবে না জরায়ুতে কী আছে। আর জরায়ুতে কী আছে না আছে, এটা গায়েবের কোনো বিষয় না। কারণ সন্তান ছেলে বা মেয়ে কীভাবে হয়?
এ নিয়ে রসুলুল্লাহ (স) এর একটি বিখ্যাত হাদিস আছে, if male dominates, it would become a boy, if female dominates it becomes a girl. যদি পুরুষ প্রাধান্য করে, তাহলে ছেলে। যদি নারী প্রাধান্য করে তাহলে মেয়ে। এটা কিন্তু সংসারে নারী-পুরুষ কর্তৃত্বের ব্যাপার না। এটা হলো সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে, তার বৈজ্ঞানিক কার্যকারণ।
যেমন, বাচ্চার লিঙ্গ কী হবে, সে সম্পর্কে এখনকার বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা কী? মেলে সেক্সের ক্রোমোজম এক্স-ওয়াই আর ফিমেলে সেক্সের ক্রোমোজম এক্স এক্স। ওয়াই ক্রোমোজম যদি ওভমকে ফার্টিলাইজ করতে পারে, তাহলে ছেলে। আর যদি এক্স ক্রোমোজম আসে, তাহলে মেয়ে। অর্থাৎ ১৪০০ বছর আগে তিনি বলেছেন এ কথা।
তো জরায়ুতে কী আছে বলতে শুধু ছেলে হবে না মেয়ে হবে, সেটা বোঝানো হয় নি। আরো অনেক কিছু বোঝানো হয়েছে। সে ভূমিষ্ঠ হবে কি না, হলে জ্যান্ত হবে না মৃত, পূর্ণাঙ্গ হবে না অপূর্ণাঙ্গ, গুণ কী হবে, দোষ কী হবে, তার মানসিকতা কী হবে, বিশ্বাসী হবে কি না, মা-বাবার জন্যে আর্শীবাদ হবে কি না, দুনিয়া আখেরাতে তার অবস্থান কী হবে- এসব বিষয় কোনো বিজ্ঞানীর পক্ষে বলা সম্ভব নয়। বিজ্ঞানী শুধু বলতে পারেন, যতটুকু দৃশ্যমান জগতে চলে এসেছে। যখন জরায়ুতে ভ্রুণ বিকশিত হতে শুরু করেছে। তখন আর এটা গায়েবের অন্তর্ভুক্ত নয়।
চার নম্বর পয়েন্ট হচ্ছে, কেউ জানে না আগামীকাল তার জন্যে কী অপেক্ষা করছে। এটার অনুবাদ কেউ কেউ করেছেন, আগামীকাল সে কী অর্জন করবে। এখন প্রশ্ন হলো, যার মাসের বেতন নির্ধারিত, একদিক থেকে সে বলতে পারে যে, তার অর্জন সে জানে। কিন্তু কেউ বলতে পারে না যে, আগামীকাল এটা ছিনতাই হয়ে যাবে কি না বা এমন কোনো অসুস্থতায় সে আক্রান্ত হবে কি না যার ফলে তার সমস্ত অর্জন খরচ হয়ে যাবে। সেটা তো কেউ বলতে পারে না। আসলে অর্জনের ব্যাপারটাও কিন্তু কেউ বলতে পারে না। যেমন, কেউ ডজন ডজন বই পড়েও কোনো জ্ঞান অর্জন করেন নি, এমন হতে পারে। আবার কেউ একটি লাইন পড়েই অনুভব করতে পারেন যে, জ্ঞানের দিগন্ত খুলে গেল তার সামনে।
পাঁচ নম্বর পয়েন্ট হচ্ছে, কেউ জানে না, তার মৃত্যু কোথায় হবে। এটা নিয়ে অবশ্য কারো বিরোধ নেই।
আসলে কোরআনের কোনো বিষয় নিয়ে যখনই এ ধরনের প্রশ্ন আসবে, তখন জানবেন, আপনি বিষয়বস্তুর গভীরে ঢুকতে পারেন নি।
যখন গভীরে ঢুকবেন, দেখবেন, আপনার আর কোনো প্রশ্ন নেই। এটাই হচ্ছে কোরআনের সবচেয়ে বড় গুণ।