প্রায় ৭৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সুবাদে নতুন অর্থবছরের জন্যে ছয় কোটি ৪০ লাখ ডলারের পরচুলার নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র চার মাসেই বাংলাদেশ থেকে দুই কোটি ৬৪ লাখ ডলার বা ২২৭ কোটি টাকার পরচুলা রপ্তানি হয়, যা আবার আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণের (১১৬ শতাংশ) বেশি। বাংলাদেশের রপ্তানির ধারা বিবেচনায় এটিকে অন্তত সম্ভাবনাময় একটি রপ্তানি পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা যেতেই পারে।
কিন্তু ২০২০ সালের ৫০ হাজার কোটি টাকার (৫৭৭ কোটি ডলার) পরচুলার বিশ্ববাজারের তথ্য বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশ মাত্র ১ শতাংশ নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছে। ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব হেয়ার রিস্টোরেশন সার্জারি (ISHRS) আগামী পাঁচ বছরের পরচুলার বিশ্ববাজারের যে পূর্বাভাস, তাতে ২০২৬ সালে এই বাজার বিস্তৃতি এক হাজার ৩২৮ কোটি ডলার বা এক লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে পরচুলায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি এই বিশাল বাজারে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার হাতছানি দিচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। যথাযথ উদ্যোগ নিলে পরচুলা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বিলিয়ন ডলারের পণ্য হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশে সব মিলিয়ে ছোট-বড় প্রায় দেড় শ পরচুলা তৈরির কারখানা রয়েছে। তবে বাংলাদেশে পরচুলা রপ্তানি মূলত ইপিজেডকেন্দ্রিক। গত অর্থবছরে মোট পরচুলা রপ্তানির পাঁচ কোটি ৭১ লাখ ডলারের মধ্যে চার কোটি ১১ লাখ ডলারের রপ্তানি হয়েছে নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেড, মোংলা ও ঈশ্বরদী ইপিজেডের ছয়টি কারখানা থেকে, যা মোট পরচুলা রপ্তানির ৭২ শতাংশ। এর মধ্যে উত্তরা ইপিজেডের এভারগ্রিন প্রডাক্টস ফ্যাক্টরি, মাস্টার পার্পাল (বিডি) লিমিটেড, ডং জিং ইন্ডাস্ট্রিয়াল (বিডি) কোম্পানি লিমিটেড, মোংলা ইপিজেডে ওয়াইসিএল ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ঈশ্বরদী ইপিজেডের স্টেলা হেয়ার প্রডাক্টস ও এমজিএল কম্পানি বিডি লিমিটেড। একই ইপিজেডে ওস্কার বাংলা কম্পানি উৎপাদনে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
এসব কারখানায় জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন থেকে সিনথেটিক ফাইবার ও হিউম্যান হেয়ার দিয়ে তৈরি হয়ে ব্রেইড, হ্যালোইন, ক্লাউন, পনি ব্রেইড, রেগুলার উইগ রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ৩৪টি দেশে। তবে পরচুলার ক্রেতা মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে পরচুলা রপ্তানির প্রায় ৯১ শতাংশই রপ্তানি হয়েছে এই দুই দেশে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পরচুলার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গেছে তিন কোটি পাঁচ লাখ ডলার এবং চীনে গেছে দুই কোটি ১২ লাখ ডলারের পণ্য।
পরচুলাকে বিলিয়ন ডলারের পণ্যে উন্নীত করতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারে—এমন উদ্যোগও আছে বাংলাদেশে। এ ক্ষেত্রে প্রথম নামটিই হতে পারে এভারগ্রিন প্রডাক্টস ফ্যাক্টরি (বিডি) লিমিটেড। নীলফামারী জেলার উত্তরা ইপিজেডে অবস্থিত হংকংভিত্তিক এই গ্রুপটি পরচুলা রপ্তানিতে বিশ্বে সপ্তম এবং পরচুলা পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে চতুর্থ বলে জানালেন এভারগ্রিন প্রডাক্টস গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী ফেলিক্স চ্যাং।
এই গ্রুপের সবচেয়ে বড় কারখানাটি উত্তরা ইপিজেডে অবস্থিত। ২০১০ সালে মাত্র পাঁচটি প্লট নিয়ে কারখানা স্থাপন করা হয়। কিন্তু চাহিদার সঙ্গে সম্প্রসারণ করে বর্তমানে এই ইপিজেডেই ১৭টি প্লট নিয়ে এভারগ্রিন প্রডাক্টস ফ্যাক্টরি বিশাল কারখানা গড়ে তুলেছে। এতে বিনিয়োগ হয়েছে পাঁচ কোটি ৪৩ লাখ মার্কিন ডলার। বর্তমানে ইপিজেডের ছয়টি পরচুলা কারখানায় কর্মরত মোট ১৪ হাজার ৫১৪ জন বাংলাদেশির মধ্যে ১১ হাজার ১৬৯ জনই এভারগ্রিনের কারখানায় কর্মরত। অক্টোবর পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের চার মাসে দুই কোটি ৬৪ লাখ ডলারের পরচুলা রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে এক কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮৬ কোটি টাকার বেশি রপ্তানি হয়েছে শুধু এভারগ্রিনের কারখানা থেকে।
ইপিজেড ছাড়াও বাংলাদেশে এভারগ্রিনের আরো ১৫টি ছোট-বড় পরচুলা কারখানা রয়েছে, যেখানে প্রায় আরো ২০ হাজার শ্রমিক কর্মরত। আগামী দিনে চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে অবস্থিত বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলেও বিনিয়োগ করবেন বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান।
ফেলিক্স চ্যাংও বিশ্বাস করেন, যথাযথ উদ্যোগ নিলে শিগগিরই পরচুলা বাংলাদেশের বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে পরচুলা রপ্তানি পাঁচ থেকে আট গুণ বাড়বে। কালের কণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘পরচুলা তৈরির মেশিনারিজ তৈরি পোশাকের সঙ্গে অনেক মিল থাকলেও এটি পোশাকশিল্পের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি শ্রমঘন। আর বাংলাদেশ এই মুহূর্তে পরচুলাশিল্পে বিনিয়োগের জন্যে আদর্শ স্থান।’ এ কারণে ২০০৯ সালে ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশকেই পরচুলার কারখানা গড়ার উপযুক্ত ভেবে বিনিয়োগ করেছিল।
বেপজার মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) নাজমা বিনতে আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরচুলা দেশের ইপিজেডে উৎপাদিত বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। তৈরি পোশাক, পাট, চামড়ার বাইরে পরচুলা বাংলাদেশের রপ্তানিশিল্পে অন্যতম সম্ভাবনাময় পণ্য হয়ে উঠতে পারে। কারণ দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও ইউরোপে পরচুলার বিশাল বাজার রয়েছে। বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে রংবেরঙের পরচুলা পরা দৈনন্দিন ফ্যাশনের পর্যায়ে চলে গেছে।’
সূত্র: কালের কণ্ঠ (২৮ নভেম্বর, ২০২১)