1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:০৬ অপরাহ্ন

পান্তা-ইলিশ নয়, পান্তাপিয়া দিয়েই আসুন আমরা আয়োজন করি আমাদের বৈশাখী

  • সময় বুধবার, ৬ এপ্রিল, ২০২২
  • ১০৮৪ বার দেখা হয়েছে
 -দেখতে দেখতে ঘনিয়ে এল ১৪২৮ বঙ্গাব্দের বিদায় ক্ষণ। আর ক’দিনের মধ্যেই আমরা স্বাগত জানাব নতুন বছর ১৪২৯ বঙ্গাব্দকে। নতুন বছরের এই ক্ষণে সবাইকে জানাচ্ছি আন্তরিক অভিবাদন।
অস্বীকার করে লাভ নেই যে, আমাদের লাইফ স্টাইলের সাথে বাংলার চেয়ে ইংরেজি বছরটাই জুড়ে আছে অনেক বেশি। ২৫ শে বৈশাখ, ১১ ই জ্যৈষ্ঠ, ২২ শে শ্রাবণ বা ১ লা বৈশাখ – এরকম গুটিকয় বাংলা তারিখকেই সম্ভবত সারা বছরে আমরা মনে করি। (অবশ্য ব্যতিক্রম কেউও থাকতে পারেন, তবে সেটা ব্যতিক্রমই)।
যাই হোক, বর্ষবরণের এই দিনটি সারা দেশের মানুষের মতো আমরাও পালন করি আনন্দ, উদ্দীপনা, আশা আর বিশ্বাসের অনুভূতি নিয়ে। তবে অবিদ্যা আর সংস্কারের জাল ছিন্ন করার যে অগ্রণী ভূমিকা কোয়ান্টাম সবসময় পালন করেছে, তার অংশ হিসেবে বছর চারেক ধরে এর সাথে যুক্ত হয়েছে আরেকটি চর্চা।
কিন্তু আমরা সৌভাগ্যবান যে এমন এক সৎসঙ্ঘে আমরা সম্পৃক্ত যেখানে প্রতিবাদ নয়, প্রতিকারের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই দেখা হয় প্রতিটি অসঙ্গতিকে। আর এরই এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত পান্তাপিয়া- পান্তা-ইলিশের বদলে যে মেন্যুটি দিয়ে এবার আমরা উদযাপন করতে চাই আমাদের বৈশাখী আয়োজনকে।
বলবেন, এ পান্তাপিয়াটা আবার কি?
ব্যকরণমতে (আদৌ যদি ব্যকরণের মধ্যে পড়ে) পান্তাপিয়া হচ্ছে পান্তা আর তেলাপিয়ার সন্ধিশব্দ। আর রেসিপিমতে পান্তাভাত আর আস্ত তেলাপিয়া ফ্রাই, সাথে কড়া করে ভাজা আলুকুচি, কাঁচা পেঁয়াজ আর টালা শুকনো মরিচ – ব্যস এই হচ্ছে পান্তাপিয়া।
বলবেন কেন এ পান্তাপিয়া?
এর মধ্যে নিশ্চয়ই পত্রিকায় দেখেছেন ঢাকার কোনো এক বাজারে ১ হালি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৩২ হাজার টাকায়। একেকটি ইলিশ ৮ হাজার টাকা! চিন্তা করতে পারেন! ঢাকায় এমন অনেক মানুষ আছে যার সারামাসের আয়ও ৮ হাজার টাকা নয়। অথচ সেটা দিয়েই তাকে খেতে হয়, পরতে হয়, বাসাভাড়া দিতে হয়, বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয় তার পরিজনের কাছে।
এখন কথা হলো, যে বাজারে একটা ইলিশ বিক্রি হয় ৮ হাজার টাকায়, যা কেনার সামর্থ্য শুধু একজন সুদখোর, ঘুষখোর বা হারামখোর ছাড়া আর অন্য কারো থাকা সম্ভব নয়, সেই একই বাজারে এককেজি তেলাপিয়া এখনো পাওয়া যায় মাত্র দেড়শ টাকায়। ৮ হাজার টাকা দিয়ে ইলিশ কিনে একজন ঘুষখোর যদি বুক চিতিয়ে বাড়ি যেতে পারে, তাহলে একজন সৎ উপার্জনকারী কেন তার ঘাম ঝরানো দেড়শ টাকায় তেলাপিয়া কিনে হীনম্মন্যতায় ভুগবেন? তার সৎ উপার্জন দিয়ে তিনি তেলাপিয়া কেনারই সামর্থ্য রাখেন, কাজেই তেলাপিয়া দিয়েই হোক না তার পান্তা খাওয়ার আয়োজন। পান্তাভাত আর তেলাপিয়ার এক অভিনব আয়োজন পান্তাপিয়া।
পান্তা-ইলিশ নয়, পান্তাপিয়া দিয়েই আসুন আমরা আয়োজন করি আমাদের বৈশাখী মেনু। শামিল হই আমরা দুনীর্তি, অসততা আর অনৈতিকতার বিরুদ্ধে আমাদের অভিনব প্রতিকারে।
আপনাদের সুবিধার্থে পান্তাপিয়ার রেসিপিটা এখানে দেয়া হলো :
‘পান্তাপিয়া’
উপাদান:
পান্তাভাত
তেলাপিয়া মাছ ভাজা (পেঁয়াজ বেরেস্তা থাকতে পারে)
পোড়া আলু ভাজা [কুচি কুচি করে কাটা আলু, তেল, পেঁয়াজ (সাথে হালকা মশলা থাকতে পারে) মরিচ দিয়ে ভাজা]
শুকনো মরিচ টালা বা তেলে ভাজা / কাঁচামরিচ
কাঁচা পেঁয়াজ টুকরো শুনতে বা বলতে কিন্তু পান্তা-ইলিশের চেয়ে বেশি ভালো লাগছে ’পান্তাপিয়া’কে। (চর্মচক্ষে স্বাদ আস্বাদনের অপেক্ষায় থাকলাম)।
নতুন বছরে আমরা যেন আরো সৎ, আরো ভালো, আরো কল্যাণকর চিন্তায় ও কাজে নিয়োজিত হতে পারি, সে প্রার্থনা করি!
বৈশাখী উৎসব এমন একটা উৎসব, যা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষ (ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি-উপজাতি, আদিবাসী) সকলেই একই দিনে পালন করে থাকে। উৎসব হবে সবার জন্যে বলতে যা বুঝায় তা হলো বৈশাখী উৎসব। এর আনন্দ সকলেই সমান ভাবে উদযাপন করা উচিত। উৎসব হওয়া উচিত দেশীয় সম্পদ, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির আলোকে। বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে যে হাই-ব্রিড প্রজাতির তেলাপিয়া পাওয়া যায় তা কিন্তু স্বদেশী নয় বিদেশী কিন্তু ইলিশ মাছ একমাত্র বাংলাদেশেই পাওয়া যায় পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। কোনো কিছুর দাম বাড়া-কমা নির্ভর করে চাহিদার উপর, আজ ইলিশ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে আগামীতে তেলাপিয়াও বিক্রি হবে চড়া দামে এটা কিন্তু নিশ্চিত।
প্রত্যেকের নিজস্ব মতামত দেওয়ার অধিকার আছে, তবে শালীনতা যেন সীমালঙ্ঘন না করে সে দিকটা নজরে রাখা উচিত। তর্ক করে অনেক কিছুই লিখতে পারতাম কিন্তু লিখছি না। শুধুমাত্র একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই?
কোনো বিষয়টা মূখ্য হওয়া উচিত?
১। পান্তা ইলিশ খেয়ে বৈশাখী উৎসব পালন করা।
২। পান্তাপিয়া খেয়ে বৈশাখী উৎসব পালন করা।
৩। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে সমান ভাবে বৈশাখী উৎসব পালন করা।
“পান্তা-ইলিশ” কিংবা “পান্তাপিয়া” যা-ই হোক না কেন হাজার বছর ধরে লালন করা “মাছে-ভাতে বাঙালি” এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই। যে যার যার সামর্থ্য অনুসারে নিজের খাবার নির্বাচন করুক, তবে তা যেন “পান্তা-আলুর দম”(দু’টোই শর্করা কি না) কিংবা “পান্তা-মরিচ” না হয়। যাঁরা নিরামিষাশী, তাঁরা “পান্তা-পাঁচন” খেতে পারেন। এক বেলায় হাজার টাকার “পান্তা-ইলিশ” না খেয়ে দুই-দশজনকে নিয়ে “পান্তা-পাঁচন” খাওয়া কি অনেক আনন্দের নয়?
পান্থাপিয়া নয় “ শুধুমাত্র পান্থা-মরিচই “ করা হোক পয়লা বৈশাখের মেনু। যা সকল বাঙ্গালীর জন্য গ্রহনযোগ্য এবং সাধ্য ও সামর্থের মাঝে আছে। তবেই উৎসব সবার জন্য সার্থক হবে, নতুবা উৎসব শুধুমাত্র কর্পোরেট সমাজের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে। দেশের সাধারণ মানুষের জন্য হবে না।
আর পান্তা খেয়ে নববর্ষ পালন করতে হবে এমন ইতিহাস আছে বলে জানা নেই, যেহেতু সম্রাট আকবরের সময় বাংলা সন গণনা চালু হয়েছিল, তখনকার রাজ রাজাড়াদের খাবার ছিল বিরিয়ানি, কাবাব, কোর্মা ইত্যাদি। যেহেতু আমরা সারা বছর বাংলা তারিখের খবর রাখি না । গ্রামের লোকজন এখনো বাংলা মাসের হিসেবে অনেক কিছু করে থাকেন (যেমন বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা), পান্তাটাও তাদের খাবার। শহরেরে শিক্ষিত মানুষ একদিনের জন্য গ্রামের মানুষের খাবার খেয়ে গ্রাম বাংলার স্বাদ নিতে চায় – এভাবেই মনে হয় পান্তার প্রচলন।
পান্তার সাথে যেকোনো তরকারী, ডাল, আলু ভর্তা, শুটকি ভর্তা, এমনকি রাত্রের অবশিষ্ট তরকারি, মাংস ইত্যাদি মিশিয়ে খেলে ভালো লাগে (আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা) তাই মাছ ফ্রাই খেতে হবে এমন কি? কাচা মরিচ ডলেও দু এক প্লেট খাওয়া যায়। মনে হয় ভাতটা পান্তা বলেই এরকম বিশেষ স্বাদ।
আমরা দেখি, আমাদের ফল যেমন- আম, জাম, কাঠাল, লিচু, তরমুজ ইত্যাদির মৌসুম হলো গ্রীষ্মকাল, বিশেষ করে জৈষ্ঠ্য মাস। আমাদের ফুল যেমন- রজনীগন্ধা, গোলাপ, গন্ধরাজ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকা ইত্যাদির মৌসুম হলো নভেম্বর থেকে মার্চ মাস। যা বাংলা সনের পৌষ থেকে চৈত্র মাস। একই ভাবে আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশেরও একটা মৌসুম আছে। আর তা হলো আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস। এটা ইংরেজি মাসের জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে। আসলে এটাই হলো ইলিশ খাওয়ার সেরা সময়। এ সময়ের মাছগুলো বেশ সুস্বাদুও হয়। আর আমাদের বৈশাখ যখন শুরু হয় তখনতো ইংরেজি মাস এপ্রিল। এটি কি আদৌ ইলিশের মৌসুম?
গত বছর, মানে ২০১৬ সালে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের সর্বস্তরেই পান্তা-ইলিশের বিরুদ্ধে জোর প্রচারণা দেখা গেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও ঘোষণা দিলেন, নববর্ষ উদযাপনের দিন খাদ্য তালিকায় ইলিশের কোনো পদ তিনি রাখবেন না।
উল্লেখযোগ্য হলো, জনমানসে এই ইতিবাচকতার অনুরণন লাগল প্রকৃতিতেও। মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের গবেষণায় দেখা গেল, বাংলাদেশের সীমানার ভেতর ধরা পড়া ইলিশের আকৃতি ও ওজন বাড়ছে। ২০১৩ সালে যেখানে একটি ইলিশের গড় ওজন ছিল ৫১০ গ্রাম। ২০১৫ সালে সে ইলিশের ওজন হলো ৬২৮ গ্রাম।
আসলে পৃথিবীর যে ১২টি দেশে এখন ইলিশ হয়,তার ৭০ শতাংশই হয় বাংলাদেশে। এর কারণ হলো আমাদের বঙ্গোপসাগর। এর পলিবিধৌত মহীসোপানকে বলা হয় ইলিশের শ্রেষ্ঠ চারণভূমি। এত অনুকুল আবাস, ইলিশের জন্যে এত ভালো খাদ্যের সংস্থান নাকি পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
ওয়ার্ল্ড ফিশের গবেষণাতেই উঠে এল ‘অন্য সব দেশে যখন ইলিশের উৎপাদন কমছে, তখন বাংলাদেশে এ উৎপাদন বাড়ছে’। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে,২০১৫ এর তুলনায় ২০১৬ তে এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ পাওয়া গেছে ২০ শতাংশ বেশি!
এখন দরকার একটু সচেতনতা। পাঠক হয়তো জানেন, একটি মা ইলিশ একবারে ১০ থেকে ৩০ লক্ষ পরিমাণ ডিম পাড়ে! ভাবতে পারেন? আপনার খাবার টেবিলে ইলিশের ডিম ভাজার যে পদটা আছে, রান্না না হলে ওটা থেকে ৩০ লক্ষ না হলেও নিদেনপক্ষে ১০ লক্ষ ইলিশ হতো!
শুধু আপনাদের বলছি কেন? আমরাও তো ইলিশের ডিম খেয়েছি! তখন বুঝি নি। এখন বুঝি। কাজেই এখন খেলে এটা অন্যায় হবে। স্ববিরোধিতা হবে!
যাই হোক, শেষ করি, বিশেষজ্ঞদের কথা দিয়ে। তারা বলছেন, বৈশাখের সাথে ইলিশ খাওয়ার কোনো সম্পর্ক কোনোকালেই ছিল না। এই বানোয়াট সংস্কৃতি চালু করে ৯০ দশকে আমাদের দেশেরই মুষ্টিমেয় কিছু ব্যবসায়িক গোষ্ঠী। উদ্দেশ্য, ইলিশকে দুষ্প্রাপ্য করে ‘দুর্মূল্য’ করা। পরিণামে লাভবান হবে ওরাই।
বলা বাহুল্য, তারা সফল হয়েছিল। একজোড়া ইলিশের দাম নাকি লক্ষ টাকা – বাজারের এমন খবরও শোনা গেছে একসময়। তবে আশার কথা হলো, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভ্রান্ত রীতি পুরোপুরি বন্ধ হলে বছরে চার লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি ইলিশ পাবে বাংলাদেশের মানুষ! রূপালি অর্থনীতির সম্ভাবনা বাড়বে। সমৃদ্ধ হবে ইলিশ-নির্ভর দেশীয় জিডিপি।

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All Rights Reserved © rmgbdnews24.com