1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ অপরাহ্ন

পারষ্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ সুখী পরিবারের ভিত্তি

  • সময় রবিবার, ১১ এপ্রিল, ২০২১
  • ১২৬৪ বার দেখা হয়েছে

একটি সুখী, প্রশান্তিময় পরিবার আমরা সবাই চাই। বাইরে যত কাজই করি, দিন শেষে আমাদের ঘরে ফিরতেই হয়। ঘরে ফিরে আমরা দেখতে চাই স্ত্রীর হাসিমুখ, স্বামীর মমতাময় আচরণ, মা-বাবার স্নেহের ছায়া, সন্তানের উচ্ছলতা- যেখানে সবাই মিলে প্রশান্তির অনুরণনে হয়ে যায় একাকার।

কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক পরিবারে যেন প্রত্যেকেই একা- সম্পর্কের সেই উষ্ণতা, সেই আবেগ কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সন্তানের সাথে মা-বাবার দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে, বন্ধ দরজার ওপাশে সে একা। স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি থেকেও, মনের দূরত্ব যোজন যোজন। এর একটি বড় কারণ হিসেবে যেটি খুঁজে পাওয়া গেছে, সেটি হলো আমরা অন্যের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে খুব বেশি কার্পণ্য করি। সবসময় শুধু পেতে চাই এবং প্রত্যাশা পূরণ না হলে আমাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। আর এ থেকেই শুরু হয় সম্পর্কের টানাপড়েন। অনেকের কাছে স্ত্রী দাসীর মতো, স্বামী প্রভু।

এজন্যে মূলত দায়ী আমাদের অবিদ্যা আর ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গৃহে আমরা নারীকে দাবিয়ে রাখতে চাই তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেই না। দেখা গেছে, একজন নারী যিনি কর্মক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার- বাড়িতে কোনো বিষয়ে তার কিছু বলার নেই। কোনো সিদ্ধান্ত বা মতামত দিতে দেয়া হয় না। একটা কথা প্রচলিত আছে- শাদির প্রথম রাতে বধিবে বেড়াল। অর্থাৎ বিয়ের প্রথম রাতেই শায়েস্তা কর, তাহলে আর কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।

এ সমস্যা শুধু নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন পরিবারগুলোতে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী স্বামী তার সমানযোগ্যতাসম্পন্ন স্ত্রীকে পেটাতে একটুও দ্বিধা করেন না। সন্তানদের সামনেই গায়ে হাত তুলছেন, বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলছেন। আর স্ত্রী তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী হবে- এটা ভেবে সব অত্যাচার নীরবে হজম করছেন। এই উদাহরণ দেয়ার জন্যে দূরে কোথাও যেতে হবে না। ঘরেই ঘরেই হর-হামেশা ঘটছে। আমাদের দেশে এখন অনেকেই নারী অধিকারের ব্যাপারে খুব সোচ্চার।

অধিকার আদায়ের নামে নারী আন্দোলন বিভিন্ন সেমিনার, সভা আলোচনা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে একটি সত্য ঘটনা- এক সেমিনারে একজন স্বনামধন্য বিশিষ্ট ব্যক্তি আলোচনা করছিলেন নারীদের অধিকার নিয়ে। অনেক ভালো ভালো, অনেক বড় বড় কথা তিনি বললেন। তার স্ত্রীও সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বাসায় ফেরার পর এক কথায় দুকথায় দুজনের মধ্যে তর্ক শুরু হলো, এরপর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। এক পর্যায়ে স্বামী ব্যক্তিটি স্ত্রীকে জোরে এক থাপ্পড় দিয়ে বসলেন। স্ত্রীও উত্তপ্ত। বললেন, এতক্ষণ নারী অধিকার নিয়ে এত বড় বড় কথা বললে আর এখন তুমি আমার গায়ে হাত তুলছো। স্বামী আরো জোরে চিৎকার দিয়ে বললেন, চুপ করো। এ অধিকার অন্য নারীদের জন্যে, তোমার জন্যে নয়। এই হচ্ছে বাস্তবতা।

আবার এমন আছে যে স্ত্রীরাও অনেক ক্ষেত্রেই স্বামীকে সম্মান করেন না আবার অনেকে ভয় করেন- কী জানি কী হয়। যদি আরো খারাপ ব্যবহার করেন, যদি ডিভোর্স দেন- এই আশঙ্কায় তারা সব সময় তটস্থ থাকেন, যার প্রকাশ ঘটে কখনো দুর্ব্যবহারে আর হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত হয়ে। অথচ ১৫০০ বছর আগে থেকেই নারীকে সব অধিকার দেয়া আছে, এটা আমরা দেখি না।

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- বিশ্বাসী নর-নারীর পুরস্কার সমান। নারী এবং পুরুষ পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পোশাক। আল্লাহ তায়ালা যেখানে সমান মর্যাদা দিয়েছেন সেখানে আমরা নারীকে দাবিয়ে রাখতে চাই।

নবীজী(স) বলেছেন, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। নারীর কত বড় সম্মান! নবীজী(স) কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো- আল্লাহ ও তাঁর রসুলের পর কে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয়? নবীজী(স) বললেন, তোমার মা। তারপর কে ? তোমার মা। তারপর কে ? তোমার মা। তারপর কে ? তোমার বাবা। তিনবার মা বলার পর তিনি বাবার কথা বলেছেন।

কত বেশি সম্মান দিয়েছেন আল্লাহ ও তাঁর রসুল। যদি সন্তানদের কথা বলি তবে দেখবো অনেক মা-বাবা আছেন যারা সন্তানদের সামনে ঝগড়া থেকে শুরু করে মারামারি পর্যন্ত করেন। সন্তান যখন মা-বাবাকে ঝগড়া করতে দেখে তখন তার মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। সে ভাবে, মা-বাবা যদি আলাদা হয়ে যায় আমার কী হবে ? মা-বাবার চিন্তার চেয়েও তার নিজের অনিশ্চয়তার তুফান তার মধ্যে বয়ে যেতে থাকে ।

৮/৯ বছরের সন্তান মা-বাবার সামনেই কাউন্সিলরদের কাছে সহযোগিতা চাইছে- আমার মা-বাবাকে ঠিক করে দিন না, আমার অনেক কষ্ট হয়! আপনারা যদি একজন আরেকজনকে শ্রদ্ধা করতে না পারেন, কখনো প্রত্যাশা করবেন না যে, সন্তান আপনাদেরকে শ্রদ্ধা করবে। তার ভেতরে দুঃখবোধ তৈরি হবে, হাহাকার তৈরি হবে। অনেক সময় দেখা যায় বাবা রাত করে বাড়ি ফেরে। মা যদি সন্তনকে বলেন, তোর বাবা এত রাত করে বাড়ি ফেরে, কোথায় যায়, কী করে।

আবার বাবাও যদি সন্তানকে তার মা কত খারাপ এটা বোঝানোর জন্যে অনেক কিছু বলে থাকেন। এই সন্তানও মা-বাবাকে সম্মান করতে শেখে না, শ্রদ্ধা করতে শেখে না। আবার অনেক মা সন্তানদের বলে থাকেন, দেখেছিস তোর দাদী আমার সাথে কী আচরণ করেছে ? আবার স্বামী হয়তো স্ত্রীকে বললেন, তোমাদের বাড়িতে কখনোই আমাকে ঠিকমতো আদর-যত্ন করে না, জামাইকে কেউ এভাবে খাওয়ায় ? এই যে পরস্পরের আত্মীয়ের নিন্দা- এটা খুব দুঃখজনক।

যে সন্তান এগুলো শুনে বড় হচ্ছে সে কখনো সুন্দর আচরণের অধিকারী হবে না। মা-বাবার মধ্যে কেউই এমন কোনো আচরণ করা উচিত নয় যেটা তাকে মা-বাবার প্রতি অশ্রদ্ধাশীল করে তোলে। ছোট কিংবা বড় প্রতিটি মানুষের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব রয়েছে। বয়সভেদে সবাইকেই সম্মান করা উচিত। সেটি সন্তানের বেলায়ও প্রযোজ্য। সন্তানের কোনো অন্যায় বা তার যেকোনো দোষত্রুটি অন্যের সামনে বলা উচিত নয়।

এটি তার আত্মসম্মানে বাধে এবং মা-বাবার প্রতি ক্ষোভ তৈরি হয়। এই ক্ষোভের বাহ্যিক প্রকাশ দেখা দেয় একটু বড় হওয়ার পর। কেউ হীনম্মন্যতায় ভোগে, কেউ জেদি হয়। সন্তানের বয়স যা-ই হোক না কেন তারও একটা আত্মসম্মানবোধ রয়েছে। সেই সম্মানটুকু তাকে দিতে হবে। অনেক পরিবারেই ছেলে এবং মেয়েকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয়।

পড়াশোনা চলাকালে যদি কোনো মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব আসে, মা-বাবা ব্যস্ত হয়ে উঠেন যেন লেখাপড়াটা তাকে করানোই হচ্ছিলো একটা বিয়ের জন্যে। কোনো ছেলের ক্ষেত্রে কিন্তু এভাবে চিন্তা করা হয় না। এ কারণে মেয়েদের মধ্যে হীনম্মন্যতা অনেক বেশি। আর একটি মেয়ে যখন হীনম্মন্যতায় বেড়ে উঠে সে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। মেয়ে যদি ঘরে উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা পায়, তাহলে সে স্বামীর ঘরেও সম্মান পাবে, সব জায়গাতেই সম্মান পাবে।

আর একটি বিষয় খুব গুরত্বপূর্ণ- যে ঘরে গৃহকর্মীর সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়, সে পরিবারে কখনো শান্তি থাকে না। যে মানুষটি আমাদের একটু আরামের জন্যে দিনরাত পরিশ্রম করছে, সকালে সবার আগে ঘুম থেকে উঠছে, সবার শেষে ঘুমাতে যাচ্ছে- তার সাথে মানবিক আচরণ করতে হবে। একজন মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে হবে। গৃহকর্মীর সাথে আপনি সম্বোধন করলে তারা সম্মানিত বোধ করেন এবং একটা সুন্দর সম্পর্কও তৈরি হয়।

পরিবারে সুসম্পর্ক তৈরির একটি বড় ক্ষেত্র হবে যদি মূলের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে, ভালবাসা থাকে, আকর্ষণ থাকে। আমাদের পরিবারে এই মূল হচ্ছেন আমাদের মা-বাবা। আমরা অনেক সময় পরিবার বলতে স্বামী-স্ত্রীকে বুঝি। অথচ স্বামী কারো ছেলে, স্ত্রীও কারো মেয়ে। অর্থাৎ পরিবারের মূল হচ্ছেন মা এবং বাবা।

আপনার লালন-পালনে তাদের ত্যাগ, তাদের ভূমিকা, তাদের শ্রমকে আপনি অনুভব করুন। তাদের কাছ থেকে কতটুকু নিচ্ছি এবং সে তুলনায় কতটুকু দিচ্ছি- তা অনুভব করতে চেষ্টা করুন। মা-বাবার প্রতি আমরা যদি টান অনুভব করি, মমতা অনুভব করি, তাদেরকে বুঝতে পারি, তাহলে সুসম্পর্কের ভিত্তি তৈরি হবে তখন অন্য সবার সাথেও সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হবে।

সকল সুসম্পর্কের পূর্বশর্ত মমতা, ভালবাসা । মমতাই মানবিক, তাই মমতার গুণাবলী যতক্ষণ পর্যন্ত বিকশিত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সুসম্পর্ক সৃষ্টি হতে পারে না। তাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন।

পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে হবে। আর এ সবকিছুর জন্যে প্রয়োজন একটি ভালো পরিবেশ, সৎসঙ্ঘে একাত্মতা। প্রয়োজন মেডিটেশন । মেডিটেশনে রাগ ক্ষোভ দূর হয়, ক্ষমা করা সহজ হয়। আন্তরিকতা ও সমমর্মিতা বাড়ে। একাত্মতা বাড়ে। ফলে পরস্পরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয় এবং একটি সুখী পরিবার গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All Rights Reserved © rmgbdnews24.com