পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আমি দ্বিতীয়। মা-বাবা দুই জনই কৃষিকাজ করেন। বান্দরবানের রেইচাথলি পাড়ায় আমার বাড়ি। কোয়ান্টামে আসার আগে সেখানেই আমি বেড়ে উঠি। ছোটবেলা থেকে অনেক ইচ্ছে ছিল পড়ালেখা করব। তাই হাল ছাড়ি নি। এসএসসি পর্যন্ত খুব পরিশ্রম করে আমার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়েছিল।
প্রাইমারিতে তো এত খরচ ছিল না। এলাকার হাই স্কুলটা বেসরকারি হলেও এমপিও তালিকাভুক্ত ছিল। সেখানকার প্রধান শিক্ষক আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। সেই স্কুলে আমরা দুই ভাইবোন পড়াশোনা করতাম। আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে তখন আমার বোন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত। হেডমাস্টার আমাদের প্রতি সদয় ছিলেন। আমাদের দুজন থেকে যে-কোনো একজনের বেতন তিনি ফ্রি করে দিয়েছিলেন। অন্যরা যখন প্রাইভেট পড়ত তখন আমি নিজ থেকে পড়ার চেষ্টা করতাম।
স্যারেরাও জানতেন বই কেনার সামর্থ্য আমার নেই। লাইব্রেরিতে রেফারেন্সের জন্যে প্রকাশকেরা স্যারদেরকে কিছু বই ফ্রি-তে দিত। তখন স্যারদের কাছে কোনো বই এলে আমাকে পড়ার জন্যে দিতেন। এভাবেই এসএসসি শেষ করলাম।
ভাবতেই পারতাম না যে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। বরং ভুল ধারণা ছিল। ভাবতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে অনেক খরচ লাগবে, যা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি খুব পরিশ্রম করি বা সাপোর্ট থাকে তাহলে সৌভাগ্যক্রমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেতে পারব। যেহেতু আমরা পাহাড়িরা চট্টগ্রামে বেশি থাকি। বান্দরবানের পাশের শহর হওয়ায় এখানে খরচ কম লাগে।
গ্রামে মানুষের জীবনধারা থেকে বেরিয়ে পৃথিবীটাকে অন্যভাবে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। আরো ইচ্ছে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব তারপর সমাজে মানুষের কাছে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দেবো। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেই তো আর হয় না! আর্থিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ভেবে নিয়েছিলাম হয়তো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হবে না। এসএসসি পরীক্ষার পর এত কিছু চিন্তা করতাম—কী যে হবে আমার! তখন মাসখানেক পর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে কোয়ান্টাম কসমো কলেজে চলে গেলাম।
আমার ধারণা পাল্টে গেল যখন কসমো কলেজে ভর্তি হই। এর আগে আবাসিক স্কুলে যাওয়া হয় নি। ওখানে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম, যে সুযোগ আগে কখনো হয় নি। যেমন এতগুলো মানুষ একসাথে থাকা, খাওয়া ইত্যাদি।
আচার-আচরণের দিক দিয়ে কোয়ান্টাম অনেক কিছু শিখিয়েছে। যেমন—সেখানকার শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেন। এগুলো দেখার পর আমার মনে হয়, যে শিক্ষার্থী এখনো নিজের ও অন্যকে নিয়ে ভালো ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে না সে-ও পরিবর্তন হয়ে যাবে সেখানে গেলে। এছাড়াও মানুষকে কীভাবে মূল্য দিতে হয় তা শিখেছি। সেখানে যে যেই অবস্থানে থাকুক না কেন সবাই সবাইকে সম্মান করে। সেই শিক্ষকদের আমার অন্তর থেকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাই।
কোভিড ১৯-এর জন্যে অ্যাডমিশনের সময় বাড়িতে এসে পাড়ায় থাকতে হয়েছিল। এসময় পাড়ার অন্য ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই বাইরে আড্ডা দিত। আমার মন টানত কিন্তু যেতাম না। ওদের আর্থিক অবস্থা আমাদের থেকে অনেক ভালো। আমি যেহেতু কলেজে গিয়ে বুঝতে পারলাম যে, আমাকে একটি ভালো অবস্থানে যেতে হবে বা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে তাই সময় নষ্ট করলাম না। পরিশ্রম বাড়িয়ে দিলাম। বাসায় বসে একা একা পড়তাম। কোনো জায়গায় ফ্রি-তে প্রাইভেট পড়ার সুযোগ পেলে গিয়ে পড়তাম। অনেকে আমাকে নিয়ে মজা করত। কারণ আমি পড়তে পড়তে মুখের ওপর বই রেখে কখন যে ঘুমিয়ে যেতাম টের পেতাম না।
প্রত্যেক শিক্ষার্থীর লক্ষ্য থাকা দরকার। কারণ মাতৃগর্ভে একটি ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হওয়ার জন্যে পিতার দেহ থেকে যে ৪০/ ৫০ কোটি শুক্রাণু যাত্রা শুরু করে, তার একটি মাত্র শুক্রাণু গন্তব্যে যেতে পারে। জীবনের প্রথম সংগ্রামে জয়ী হয়েই একজন মানুষ পৃথিবীতে আসে। তাই আমি মনে করি, সে আগামীতেও প্রথম হবে যদি বিশ্বাস করতে পারে। একথাগুলো আমি কোয়ান্টাম মেথড কোর্সে শুনেছি।
নিয়মিত মেডিটেশন আর মনছবি আমার লক্ষ্য নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে। মনছবি ঠিক করলাম, আমি বাংলাদেশের প্রাচ্য অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। নিয়মিত মেডিটেশনে মনছবি দেখতাম এবং শিক্ষকদের সহায়তায় আজ আমি আমার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি।
আপাতত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হিসেবে নিজ এলাকায় কিছু গঠনমূলক কাজ করতে চাই। আমি দেখেছি পাড়ার শিক্ষার্থীরা অষ্টম বা এসএসসি পর্যন্ত পড়ার পর আর পড়ে না। তাই তারা যেন উচ্চশিক্ষা নিয়ে পড়ালেখা করে সে বিষয়ে সচেতনতামূলক কাজ আমি শুরু করেছি।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]