আজ থেকে দু’হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে বাংলায় তৈরি নানারকম কাপড় রোম, মিশর, জাভা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রপ্তানি হতো। ১৪শ শতকের মাঝামাঝি বাংলায় আসেন মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা। সোনারগাঁয়ে যে উৎকৃষ্ট মসলিন তৈরি হতো, তা দেখে চমৎকৃত ইবনে বতুতা মন্তব্য করেন, ‘এমন উঁচু মানের বস্ত্র সারা পৃথিবীতে হয়তো আর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়।’
১৮ শতকের প্রথম দশকে (১৭০০-১৭১০) বাংলায় প্রায় ১৫০ রকম কাপড় তৈরি হতো। ১৮০০ সালেও ঢাকার বাজারে ইংরেজ কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট জন টেলর একশ-র বেশি নামের কাপড় দেখেছেন। (পৃথিবীর তাঁতঘর : বাংলার বস্ত্রশিল্প ও বাণিজ্য, সুশীল চৌধুরী। আনন্দ পাবলিশার্স।)
১৮ শতকের গোড়ায় ইংরেজ ও ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এশিয়া থেকে মোট যত মালামাল নিয়ে গিয়েছিল, তার ৪০ শতাংশ ছিল বাংলা থেকে আনা কাপড় ও কাঁচা সিল্ক। আরেকটি হিসাব অনুসারে, ১৭২৮ থেকে ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ভারত থেকে রপ্তানি হওয়া মোট বস্ত্রের ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ ছিল বাংলার বস্ত্র। (ভারত থেকে ম্যানচেস্টার, প্রথম বিশ্বায়িত পণ্য : সুতিবস্ত্র, সুমিতা দাস। কলকাতা : পিপলস বুক সোসাইটি, ২০২০। পৃষ্ঠা ৫৪-৫৫)
প্রাচীন ভারতের প্রতিটি বিখ্যাত জ্ঞানকেন্দ্রে আচার্য ও পণ্ডিতদের একটি বড় অংশ ছিলেন বাঙালি। সে-সময়ের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানপীঠ নালন্দা মহাবিহারের আচার্য হিসেবে তিন জন বাঙালি পণ্ডিতের নাম পাওয়া যায়। মহাচার্য শীলভদ্র, শান্তিরক্ষিত ও চন্দ্রগোমিন। শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর আচার্য হিসেবে বিক্রমশীলা মহাবিহার ও সোমপুর মহাবিহারের দায়িত্ব পালন করেন।
প্রাচীন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ পাঁচটি জ্ঞানতীর্থের দুটি ছিল বাংলায়। ৯ম শতাব্দীতে নির্মিত সোমপুর মহাবিহার ও ১২শ শতাব্দীতে নির্মিত জগদ্দল মহাবিহার। পাল রাজাদের তৈরি দুটো মহাবিহারই বর্তমান নওগাঁ জেলায় অবস্থিত। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য, চীন, তিব্বত, মায়ানমার, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকে বৌদ্ধ শিক্ষার্থীরা এখানে আসতেন জ্ঞান অর্জন করতে।
বাংলার নদীমাতৃক ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে জাহাজের ব্যবহার ছিল প্রাচীনকাল থেকেই। মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় পরিব্রাজক সিজার ফ্রেডেরিক নথিভুক্ত করেছেন—১৫ শতকে চট্টগ্রাম বন্দর ছিল বড় জাহাজ নির্মাণের একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র।
মুঘল আমলে জাহাজ নির্মাণ ব্যাপক পরিসর লাভ করে। ১৭ শতকে তুরস্কের সুলতানের জন্যে যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ করা হয়েছিল চট্টগ্রামে। কাঠের যুদ্ধ জাহাজের পরিবর্তে লৌহনির্মিত যুদ্ধ জাহাজ তৈরি করা শুরু হয় ১৯ শতকের শেষভাগে। ১৯ শতক পর্যন্ত চট্টগ্রাম ১০০০ টন ধারণক্ষমতার জাহাজ নির্মাণে সক্ষম ছিল। (জাহাজ নির্মাণ শিল্প, সিরাজুল ইসলাম; বাংলাপিডিয়া, এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ)
বাঙালি যে এককালে সমুদ্রবাণিজ্যে পারদর্শী ছিল, তার প্রমাণ লিপিবদ্ধ রয়েছে চণ্ডিমঙ্গল ও মনসামঙ্গলের মতো সাহিত্যকর্মে। দূরদেশে ধনপতি, শ্রীমন্ত, চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যকীর্তির বিবরণ আছে এসব কাব্যে। ১৮ শতকেও ব্রিটিশদের চেয়ে বেশি দক্ষ ছিল বাংলা ও বোম্বের জাহাজ নির্মাতারা।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ সালে আলেকজান্ডারের ভারতবর্ষ আক্রমণের সময় প্রাচীন ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজ্য ছিল স্বাধীন গঙ্গারিডি (অধুনা বাংলাদেশ)। বাংলার প্রাচীনতম নগরকেন্দ্র পুন্ড্রবর্ধন। ২৪০০ বছরের পুরনো এই নগরী ৪র্থ শতাব্দী থেকে ১১শ শতাব্দী পর্যন্ত সুপরিচিত ছিল ভারতবর্ষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে।
আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান ছিল বাঙালি। ভারতবর্ষের সর্বত্র বিতাড়িত হয়ে বৌদ্ধধর্ম শেষ আশ্রয় লাভ করে বাংলায়। সুদীর্ঘকাল বৌদ্ধজগতে গুরুস্থানীয় ছিল বাঙালি। বাংলার একাধিক পণ্ডিত দুর্গম হিমালয় পাড়ি দিয়ে তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের সংস্কার করেন।
আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিসে এরিস্টটল ও প্লেটো যখন নিজেদের উদ্ভাবিত গণতন্ত্রে অভিজাত ও দাস শ্রেণির মধ্যে বিভাজনের কথা বলেছেন, তখন এই বাংলায় মহামতি বুদ্ধ প্রচার করেছেন সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের বাণী। তিনি বলেছেন, জন্মসূত্রে কেউ ব্রাহ্মণ বা অচ্ছুত হয় না, কর্ম দ্বারাই সে ব্রাহ্মণ বা অচ্ছুতে রূপান্তরিত হয়।
দ্রাবিড় সভ্যতা আমাদের দিয়েছে যোগধ্যান। মহামতি বুদ্ধ শিখিয়ে গেছেন বিপাসন ধ্যান পদ্ধতি। এই ধ্যান চীনে ‘চেন’ এবং জাপানে ‘জেন’ নামে প্রচলিত হলো, যা আসলে বাংলা ‘ধ্যান’ শব্দেরই ভাষাগত রূপান্তর।
বাঙালির বাহুবল সত্যিই একদিন গর্বের বিষয় ছিল। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যত প্রতিরোধ হয়েছে তার সিংহভাগই ঘটে বাংলা অঞ্চলে। ২০০ বছর ধরে এদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ একের পর এক বিদ্রোহ ও আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮৩৩); রংপুর, বাকেরগঞ্জ, সিলেট, পাবনা ও শেরপুরের কৃষক বিদ্রোহ (১৭৬৫-১৮৩০); পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশবিরোধী গেরিলা যুদ্ধ (১৭৭৬-১৭৮৭); নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-১৮৬২); সিলেটে নানকার বিদ্রোহ (১৯৩৭-১৯৫০); সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন (১৮৯৩-১৯৪৫); তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-১৯৪৭); ভাষা আন্দোলন (১৯৫২) ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
যুগে যুগে ক্ষমতাধর শোষকেরা যখন কোনো জাতিকে পদানত করতে চেয়েছে, সবার আগে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে তার নাম, পরিচয়, সংস্কৃতি। একইভাবে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কেড়ে নিতে চাইল বাংলার মানুষের মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার।
‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’—১৯৪৮ সালে এ ঘোষণায় ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার দাবিতে রক্ত ঝরল। শহিদ হলো অনেক তরুণপ্রাণ। বাংলার মানুষ ছিনিয়ে নিল মাতৃভাষার অধিকার।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল বাংলাদেশ। পৃথিবীর ইতিহাসে এত অল্প সময়ে সশস্ত্র হানাদারদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার নজির কোনো জাতির নেই। যেখানেই স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে, বিজয় অর্জনে লেগেছে বহু বছর। ১৯৭১-এর দুঃসহ সেই সময়ে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের স্পন্দন এক হয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতা অর্জনে। বিশ্ব অবাক তাকিয়ে দেখেছে বাঙালির ঐক্য, বীরত্ব এবং প্রায় শূন্য হাতে একটি দেশ গড়ার স্বপ্ন।
বাংলার কৃষকরা ১৬০০ থেকে ১৬৫০ সালের মধ্যে রেশম চাষ শেখে। মুঘল আমলে বাংলা ছিল মসলিন, সিল্ক এবং মুক্তা বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। ঢাকার সিল্ক মধ্য এশিয়ায় ‘ঢাকা’ নামে পরিচিত ছিল। রাজধানী ঢাকার ১০ লক্ষ জনগণের মধ্যে ৮০ হাজার ছিলেন কাপড় বুননের দক্ষ কারিগর এবং সিল্ক, সুতিবস্ত্র, ইস্পাত, লবণ উৎপাদন ও রপ্তানিকারী।
খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে বাংলা থেকে সূক্ষ্ম মসলিন ইউরোপে রপ্তানি হতো বলে জানা যায়। কাপড়, মুক্তা, কৃষিপণ্য ও নানাপ্রকার গাছগাছড়া বণিকরা জাহাজে করে দক্ষিণ ভারত, শ্রীলংকা, মায়ানমার, চীন, মালয় দ্বীপপুঞ্জ, সুমাত্রা, জাভা ও রোম, গ্রিসে যেত। দুর্গম হিমালয়ের পথ দিয়েও নেপাল, ভুটান ও তিব্বতের সাথে বাংলার বাণিজ্য চলত খ্রিষ্টপূর্ব ২য় শতক কিংবা তারও আগে থেকে।
পশ্চিমারা দাবি করে, গণতন্ত্রের সূচনা প্রাচীন গ্রিসে খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে। অথচ ইতিহাস বলে, তারও একশ বছর আগে গণতন্ত্রের শেকড় প্রোথিত ছিল এই বাংলায়। খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে এই অঞ্চলে ছোট ছোট গণরাজ্য ছিল। প্রতিটি রাজ্যে একটি পরিষদ থাকত, যারা রাজা নির্বাচন করতেন।
গণতন্ত্রের এই চর্চা দেখা যায় রাজা গোপালের সময়েও। বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্ক লোকান্তরিত হওয়ার পর এদেশে শুরু হয় মাৎস্যন্যায় যুগ বা অরাজকতার সময়কাল। এরপর ৭৫০ সালের দিকে কিছু নেতৃস্থানীয় মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ হলেন। তাদের বলা হতো প্রকৃতিপুঞ্জ। এখনকার ভাষায় সুশীল সমাজ। এই প্রকৃতিপুঞ্জ ক্ষত্রিয় গোপালকে রাজা মনোনীত করলেন। তবে তারা শর্ত দিলেন—সুশাসন দিতে না পারলে তোমার রাজত্ব থাকবে না।
১৪০৫ সালে বাংলার স্বাধীন সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ দিল্লির প্রভাব ঠেকাতে সুসম্পর্ক গড়ে তুললেন চীন ও পারস্যের সাথে। চীনের সাথে করলেন রাজনৈতিক কূটনীতি। আমাদের রাজদূতরা চীনে যেত, চীনের দূতরা এদেশে আসত। ইউরোপে তখনো রাষ্ট্রদূত বিনিময় প্রথার প্রচলনই হয় নি।
সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ পারস্যের সাথে সূত্রপাত করলেন সাংস্কৃতিক কূটনীতি। পারস্যের প্রথিতযশা কবি হাফিজকে বাংলায় আসার আমন্ত্রণ জানালেন। আরবের সাথে গড়ে তুললেন ধর্মীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক। বাংলার অর্থে মক্কা-মদিনার দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্যে নির্মাণ করে দিলেন দুটি মাদ্রাসা, যা পরিচিত ছিল ‘গিয়াসিয়া মাদ্রাসা’ নামে। ৩০ হাজার স্বর্ণমুদ্রাও আরবে পাঠিয়ে দিলেন দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণের জন্যে।