দেশের আটটি বিভাগ থেকে বিভিন্ন কোম্পানির চিপস, চানাচুর, ভাজা মটর, ডাল ভাজা, নুডলস, বিস্কুট, লজেন্স, ললিপপ, মিল্ক চকোলেট, চাটনি এবং আইসক্রিম নিয়ে হয় এ গবেষণা। প্রতিটি ব্র্যান্ড থেকে নেওয়া হয়েছিল ১২টি করে নমুনা। পরীক্ষাটা করা হয়েছে ভারতের ফেয়ার ল্যাবস প্রাইভেট লিমিডেটে। ব্যবহার করা হয়েছে এওএসি মেথড। এতে দেখা হয়, প্যাকেটের লেবেলে উল্লেখ করা উপাদানগুলোর পরিমাণ ঠিক আছে কিনা বা মানদণ্ডের চেয়ে কমবেশি আছে কিনা।
নমুনাগুলো যাচাই করা হয় অস্ট্রেলিয়ার স্টার রেটিং স্কিম ও ব্রিটেনের ট্রাফিক লাইট পদ্ধতিতে। দেখা গেল দুই পদ্ধতিতেই নমুনার কোনও পণ্য স্বাস্থ্যসম্মত বলে দাবি করা যাচ্ছে না। অধিকাংশ পণ্যেই পুষ্টিগুণের ব্যাপারে ভুল তথ্য দিয়ে লেবেলিং করা হয়েছে।
‘সল্ট, সুগার অ্যান্ড ফ্যাট কন্টেন্ট ইন কমনলি কনজিউমড প্রসেডড প্যাকেজড ফুড অ্যান্ড দেয়ার কনফরমিটি উইথ লেবেল ইনফরমেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই গবেষণায় প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে ও হাসপাতালের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী। গবেষণাটি ২০১৯ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ২০২০ সালে। এরপর এর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয় বলে জানান তিনি।
গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, ইউকে স্বাস্থ্য বিভাগের রেটিং ট্রাফিক লাইট অনুসারে চিপসে চিনি রয়েছে সাত দশমিক দুই শতাংশ, লবণ দুই দশমিক এক শতাংশ, স্যাচুরেটেড ফ্যাট ১১ দশমিক ছয় শতাংশ ও ফ্যাট ২৪ দশমিক চার শতাংশ। চানাচুরে চিনি ১১ দশমিক আট শতাংশ, লবণ এক দশমিক সাত শতাংশ, স্যাচুরেটেড ফ্যাট ১৫ দশমিক আট শতাংশ ও ফ্যাট ৩৭ দশমিক চার শতাংশ। বিস্কুটে যথারীতি চিনি ১৯ দশমিক চার শতাংশ, লবণ এক দশমিক ছয় শতাংশ, ও ফ্যাট রয়েছে ১৮ দশমিক সাত শতাংশ।
আবার অস্ট্রেলিয়ার ফুড সেফটি অথরিটির গাইডলাইন অনুসারে চিপস পেয়েছে শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে দুই শতাংশ, চানাচুর শূন্য দশমিক পাঁচ থেকে এক দশমিক পাঁচ আর বিস্কিট শূন্য দশমিক পাঁচ থেকে দুই শতাংশ রেটিং।
হেলথ স্টার রেটিং চারের বেশি হলে সেটা স্বাস্থ্যকর আর এর কম হলে অস্বাস্থ্যকর।
‘আমাদের গবেষণায় যতগুলো প্রোডাক্ট নিয়েছি, তার কোনোটাতেই চারের ওপরে পাইনি।’ বলেন অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘ইউকে ট্রাফিক লাইট সিস্টেমে লবণ, চিনি, স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং মোট ফ্যাটের নিউট্রিশন ভ্যালু কত, সেটা পরিমাপ করে তার ওপর ভিত্তি করে বলা হয় হেলদি নাকি আনহেলদি। অস্ট্রেলিয়ার হেলথ স্টার রেটিংয়ে খাবারে থাকা উপাদানের ওপর নির্ভর করে একটা স্কোর তৈরি করা হয়। এই রেটিং চারের নিচে থাকলে সেটা অস্বাস্থ্যকর। কিন্তু আমরা চারের বেশি কোনও খাবারেই কিছু পাইনি। সবই আনহেলদি।’
অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ যে প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলো বেশি খায়, সেটা কতটুকু স্বাস্থ্যকর তা দেখতে চেয়েছি। কিন্তু ইউকে ট্রাফিক লাইট অনুযায়ী, বেশিরভাগই লাল হয়ে আছে। যেমন ১০০ গ্রাম চিপসে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ১১ দশমিক ছয় শতাংশ। এটা মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর। লজেন্সে লবণ, ফ্যাট হেলদি লেভেলে থাকলেও সেখানে চিনি অনেক বেশি— ৪৬ দশমিক ১৯। ললিপপেও চিনি ৩৫ দশমিক পাঁচ শতাংশ, স্যাচুরেটেড ফ্যাটও বেশি।’
তিনি আরও জানান, ‘প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্যাকেজিংয়ে খাবারের উপাদানের যেসব তথ্য থাকে, সেটার সঙ্গে গবেষণায় পাওয়া তথ্যও মেলেনি। যেমন প্যাকেটের গায়ে লবণের পরিমাণ যা লেখা তার মধ্যে ‘আন্ডার রিপোর্টেড’ ছিল ৬৬ দশমিক সাত শতাংশ। অর্থাৎ, হয়তো আমরা পেয়েছি ১২ গ্রাম, কিন্তু প্যাকেটে লেখা ছিল আট গ্রাম। এভাবে বেশিরভাগই ছিল অ্যান্ডার রিপোর্টেড। সঠিক লেবেল কোনোটাতেই পাইনি।’
এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের লাইন ডিরেক্টর ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন।
তিনি বলেন, ‘অসংক্রামক রোগের জন্যে কিছু কমন রিস্ক ফ্যাক্টর দায়ী। এর মধ্যে অস্বাস্থ্যকর খাবার অন্যতম। আর অস্বাস্থ্যকর মানেই এর মধ্যে লবণ, চিনি ও চর্বি বেশি বেশি থাকবেই। বিভিন্ন এনার্জি ড্রিংকও এসব রোগের জন্যে দায়ী।’
তিনি আরও বলেন, ‘সল্ট পলিসি আমরা শুরু করতে পারিনি। কিন্তু থাইল্যান্ড, শ্রীলংকায় রয়েছে। আমাদেরও নিজস্ব একটা লবণ নীতি থাকতে হবে। কতটুকু লবণ খাওয়া যাবে সেটা জানতে হবে। প্যাকেটেও সঠিক তথ্য থাকতে হবে।’
সূত্র: বাংলাট্রিবিউন (১৩ মার্চ, ২০২২)