এবং বন্যার কারণে যে শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ার কারণে অংশগ্রহণ করা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাদের প্রতিও আমাদের গভীর সমবেদনা রয়েছে। তাদের জন্যেও আমরা বিশেষ দোয়া করছি।
প্রিয় সুহৃদ! বন্যামুক্ত এলাকায় ঈদের ছুটির আমেজ এখনও রয়েছে। আপনারা যারা স্বজন-পরিজন-সুজনের সাথে ঈদ করেছেন, সবার সাথে মিশেছেন ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে, যারা কোরবানির গোশত বিতরণ করেছেন, অভাবী দরিদ্রদের অতিথির মর্যাদা দিয়েছেন, বন্যার্তদের মাঝে কোরবানির মাংসসহ খাবার বিতরণ করেছেন, পরিচিত অপরিচিত ছোট বড় নির্বিশেষে যারা সবাইকে আগে সালাম দিয়েছেন তারা নিঃসন্দেহে তাদের সোশাল মাসলকে মজবুত করেছেন।
আসলে তারা সামাজিক ফিটনেসের পথে এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছেন। তাদেরকে বিশেষভাবে অভিনন্দন।
আসলে ঈদ বলি নববর্ষ বলি প্রতিটি উৎসবেই যদি আমরা স্বজন-পরিজন-সুজনের সাথে মিলিত হই, আমরা আমাদের সামাজিক মমত্বকে যদি বাড়াতে পারি, সকল সামাজিক দূরত্ব ঘোচাতে পারি, তাহলে এই সামাজিক একাত্মতাই আমাদেরকে দেবে পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা। তরুণ প্রজন্ম এই সামাজিক মমত্ব থেকেই পাবে নতুন আলোর দিশা।
প্রিয় সুহৃদ! ছুটির আমেজ এই সপ্তাহেই শেষ হয়ে যাবে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়ই আবার জীবন গতিময় হয়ে উঠবে। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে আমরা ইনশাআল্লাহ গা ঝাড়া দিয়ে উঠব। কারণ ঝড় বন্যা প্লাবন মোকাবেলায় আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষ জাতি।
আমাদের এখন আসলে বেশি করে ভাবতে হবে কিশোর তরুণ প্রজন্ম নিয়ে। দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, কিশোর তরুণদের একটা অংশ বয়স্কদের মতোই নিদারুণভাবে অস্থির বিভ্রান্ত হতাশ আসক্ত।
আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাবলি দেখি তাহলে আমাদের এ ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগ দেয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।
আপনি দেখেন, গত বছর বরিশালে নেশা করতে গিয়ে ১৬ বছরের এক কিশোর মারা যায়। গত মে মাসে চার ছেলে বন্ধুর সাথে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে অতিরিক্ত মদ খেয়ে ১৯ বছরের এক তরুণী মারা যায়। তরুণীটির বাবা জানত, মেয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছে।
গত মাসে মুন্সিগঞ্জে বিয়ের অনুষ্ঠানে মদ খেয়ে গাড়ি চালানোর সময় ব্রিজ থেকে পড়ে ১০ম শ্রেণির দুই কিশোর মারা যায়। আর জুন মাসে বান্দরবানে প্রেমিকের সাথে বেড়াতে গিয়ে আরেক তরুণী অতিরিক্ত মদপানজনিত শ্বাসকষ্টে মারা যায়। এরকম ঘটনা এখন অহরহই সংবাদ মাধ্যমে আসছে।
আসলে আমাদের এখন কিশোর তরুণদের নিয়েই চিন্তা করতে হবে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে ৫-১৭ বছর বয়সী শিশু-কিশোরের সংখ্যা চার কোটি। আমাদের পরিবার প্রতিষ্ঠান সমাজ সবকিছুর দায়িত্ব আগামীতে তাদের কাঁধেই উঠবে।
এখন তারা যদি লক্ষ্যহীন আত্মকেন্দ্রিক বিষণ্ণ লাগামহীন হয়ে বেড়ে ওঠে তাহলে বলতেই হবে যে, আমরা টাইম বোমার ওপর বসে আছি।
আসলে শুধু আমাদের দেশে নয়, পাশের দেশেও মোটামুটি একই রকম অবস্থা। ২০১৬ সালে কলকাতার নামী স্কুলের এক ছাত্র জন্মদিনের পার্টি করতে গিয়ে মারা যায়। পরে জানা গেল, মদের ভাঙা বোতল শরীরে ঢুকে গিয়েছিল। অতিরিক্ত রক্তপাতে তার মৃত্যু হয়েছে।
এরপর তরুণ প্রজন্মের আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগমুখী আচরণ নিয়ে দেশ পত্রিকায় একটি প্রচ্ছদ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রচ্ছদ নিবন্ধের কিছু কিছু পয়েন্ট ছ’বছর পরেও প্রাসঙ্গিক।
নিবন্ধে বলা হয়, আমরা যারা ৯০ দশকের প্রথম ভাগে আমাদের কৈশোর কাটিয়েছি তারা প্রত্যক্ষভাবে জানি কীভাবে কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের সমাজে অল্পবয়সীদের জীবনযাত্রা কেমন ও কতটা পাল্টে গেছে।
আগে মাসে একটা চিকেন রোল পেলে আনন্দে আটখানা হয়ে যেত যে কিশোর তার এখন সপ্তাহে দুদিন দামী ব্র্যান্ডের পিৎজা না হলে মন ভরে না। বিকাল ছটা অবধি আড্ডা ফুটবল ক্রিকেটের বন্ধুত্ব চুকিয়ে যে কিশোর একসময় বাড়িতে ঢুকে পড়াশোনা করত এখন সেই কিশোরই মোবাইল আর ট্যাবের মধ্যে বন্ধু নিয়ে ঘোরে সারাক্ষণ।
নিবন্ধে বলা হয়, যৌথ পরিবারে বড় হওয়া আমাদের সময়কার কিশোর নিজের বলতে একটা টেবিল ও একটা কাঠের ড্রয়ার ছাড়া কিছু ভাবতে পারত না। সেখানে এখন তার আলাদা আলাদা ঘর একটা আবশ্যকীয় ব্যাপার।
বাড়িতে কেউ ঘুরতে এলে সেই ঘরের অধিকারে ভাগ বসাতে পারে বলে আত্মীয়-স্বজনরাও যেন ক্রমশ তাদের কাছে বিরক্তির কারণ। যেন রাগ, মা-বাবা আমার মোবাইল ধরতে পারবে না। আমার ঘরে ছড়িয়ে থাকা জিনিস গোছাতে পারবে না। আমার রাত জেগে থাকা নিয়ে কিছু বলতে পারবে না।
শুধু আমি আর আমার। এর বাইরে যেন কিছু নেই। কেউ নেই। ছোট থেকেই এত গোপনীয়তা কী করে জমা হয় এদের? সামান্য পান থেকে চুন খসলেই এত রাগ। এত অভিমান কেন?
এখন প্রশ্ন হলো কোথা থেকে এলো এই রাগ বিরক্তি আর ঔদ্ধত্য? বিভিন্ন সামাজিক কারণে ভেঙে পড়েছে যৌথ পরিবারের কাঠামো। বহু সন্তানের পরিবর্তে এক বা বড়জোর দুই সন্তানের ধারণা সমাজে প্রথিত হয়েছে।
নিবন্ধে বলা হয়, তারই ফলস্বরূপ আমাদের ব্যাপারটি সরে গিয়ে আমার ব্যাপারটি প্রাধান্য পেতে শুরু করেছে। ছোট থেকে বাবা-মায়েরাও সন্তানদের সুরক্ষিত ও সফল ভবিষ্যতের দিকে ঠেলতে গিয়ে এই আমি ব্যাপারটিকেই চাড়িয়ে দিচ্ছেন বেশি করে। সারাক্ষণ সফল হওয়ার স্ট্রেস নিতে নিতেই কি তাই একসময় ফেটে পড়ছে তারা?
নিবন্ধে বলা হয়, এক শ্রেণির হাতে আচমকা এসে পড়েছে বিপুল অর্থ। তার সঙ্গে খরচ করার জায়গাও বেড়েছে বেড়ে গেছে হু হু করে। আর এগুলো তাদেরকে মানবিক করার বদলে এদের কেবল বস্তুগত ও ভোগবাদী জীবনের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গৌরী সেনের কাজটা করে বাড়ির বড়রাই। সহজে সবকিছু পেয়ে যাওয়া কি এদের আরো বেপোরোয়া করে দিচ্ছে না? সন্তানকে সময় দিতে না পেরে কি তার পরিপূরক হিসেবে তাদের হাতে বাড়তি টাকা পয়সা দিয়ে মা-বাবারা কিছুটা হলেও নিজেদের দোষ স্খলন করেন?
বাবা-মায়েরা নিজেদের জীবন নিয়ে এতটা ব্যস্ত বলেই কি আর সন্তানদের জন্যে সময় দিতে পারেন না? কম বয়সীদের সামনে নতুন করে উদ্বুদ্ধ হওয়ার মতো আইকন না থাকাও এদের এমন বখে যাওয়ার এক কারণ।
এদের জীবনে আসলে ছোট পরিবার ব্যস্ত বাবা-মা নামে বন্ধু হলেও আসলে সবাই প্রতিযোগী এমন সব মানুষ দিয়ে ঘেরা। তাই কি এরা একাকিত্বে ভোগে? কষ্ট পায়? মন খারাপ ডুবিয়ে রাখতে চায় সুরা পাত্রের তরলে? রুঢ়তার পেছনে কি এরা লুকিয়ে ফেলতে চায় কষ্ট আর চোখের জল?
এ এক অদ্ভুত সময়! তমসা নিবিড় এক প্রজন্ম আত্মসুখে মশগুল বেপরোয়া এক প্রজন্ম, আমার সাফল্য ও আনন্দই পৃথিবীর শেষ কথা ভেবে নেয়া প্রজন্ম। সচেতন না হলে আমাদের জন্যে আরো ভয়ংকর দিন অপেক্ষা করছে। অভিভাবক হিসেবে আমাদের সুচেতনা ও সচেতনতার প্রয়োজন।
প্যারেন্টিং কোনো ক্যাবল টিভির মাসিক বিল মেটাবার মতো ব্যাপার নয়। এ হচ্ছে দেশপত্রিকার নিবন্ধ।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশেও অনেক মা-বাবার প্যারেন্টিং দেখে মনে হয় তারা অভিভাবক নন বরং সাপ্লায়ার। সন্তান রিকুইজেশন দেবে আর তারা সেটা পূরণ করবেন।
সৌদি প্রবাসী এক ভদ্রলোকের ঘটনা। তার স্ত্রী ও দুই সন্তান থাকে গ্রামে। স্কুল পড়ুয়া ছেলেটি মোটর সাইকেল কেনার জন্যে কান্নাকাটি শুরু করলে স্ত্রীর চাপে তিনি সেটি কেনার জন্যে টাকাও পাঠান।
কয়েকদিন পরে সেই মোটর সাইকেল নিয়ে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ছিনতাই করতে গিয়ে পুলিশের হাতে আটক হয় ছেলেটি। পুলিশ মোটর সাইকেল জব্দ করেছে। জামিন হলেও মামলা চলছে।
ছেলেটির মা বলেন, ছেলে যখন যা চেয়েছে সব কিনে দিয়েছি। কোনো বায়না বাকি রাখি নাই। কিন্তু সে যে এই কাজ করবে কল্পনাও করি নাই। অন্য খারাপ ছেলেদের পাল্লায় পড়ে সে নষ্ট হয়েছে।
আসলে দোষ কি অন্য ছেলেদের? সে যে বিপথে গেল এর দায় কি অন্য ছেলেদের? দোষটি এই ছেলেটির মা-বাবার। সন্তান যা চাইবে সেটিই কেন কিনে দেবেন? স্কুল পড়ুয়া একটি ছেলের মোটর সাইকেলের তো কোনো প্রয়োজন নেই।
আর সে যখন যা বায়না করছে সেটা মেনে নেয়ার ফলেই আজ তাকে কপাল চাপড়াতে হচ্ছে।
আমাদের অনেকেরই ধারণা যাদের অঢেল টাকা পয়সা তাদের সন্তানরা সাধারণত বেহিসাবি খরচে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
আসলে এ ধারণা ঠিক নয়। সমস্যাটা অর্থবিত্তের নয়। সমস্যাটা জীবনদৃষ্টির। সমস্যাটা সন্তান লালনের প্রক্রিয়ায়।
আমরা একটি উদাহরণ দিতে পারি। আমাদের দেশের শীর্ষ ব্যবসায়িক গ্রুপগুলোর একটি পিএইচপি গ্রুপ। এর প্রতিষ্ঠাতা সুফি মিজানুর রহমান। তিনি সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই অতিরিক্ত কোনো বিলাসবেসন করতে দেন নি।
সন্তানরা যখন ছোট ছিল তাদের হাতে কখনো টাকা দিতেন না। কাঁদলেও চাওয়ামাত্র কোনো জিনিস দিতেন না। প্রয়োজন বুঝে তারপরে।
ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় তার বড় ছেলে একদিন ১০ টাকা চাইল। মিজান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ১০ টাকা কেন লাগবে? ছেলে জানাল, টিফিনের সময় দুই ভাই কোকাকোলা কিনে খাবে। মিজান সাহেব তখন বললেন, কোকাকোলার দাম ছয় টাকা। তুমি ১০ টাকা চাচ্ছ কেন? ছেলে কোনো উত্তর দিতে পারল না।
তিনি বললেন, স্কুলে যাও। টাকা দেয়া হবে না। তবে আজকে স্কুলে টিফিনের সময় তোমাদের কাছে কোকাকোলা পৌঁছে যাবে।
ছোট্ট ঘটনা। ঘটনাটি যখন আমাদের দেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও গণীতজ্ঞ কায়কোবাদ স্যারের লেখা বইয়ে পড়ছিলাম, তখন খুব ভালো লাগছিল যে, ঘটনাটা ছোট হলেও আমাদের সমাজের সবার জন্যেই শিক্ষণীয়।
এর বিপরীতে আরেকটি ঘটনা আমরা উল্লেখ করতে পারি। এখন থেকে প্রায় ১০ বছর আগে ঢাকার মালিবাগে কিশোরী কন্যার হাতে সস্ত্রীক খুব হন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের একজন ইন্সপ্যাক্টর। কিশোরীর নাম ঐশী। ঐশীর এই ঘটনা সমাজকে নাড়া দিয়েছিল। প্যারেন্টিং নিয়ে সমাজের অবক্ষয় নিয়ে তখন প্রচুর লেখালেখি হয়েছে।
তারপর যা হয় আমরা সব ভুলে গেছি। এবং ফিরে গেছি যে যার পুরানো রুটিনে। ঐশীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার সময় রায়ের পর্যবেক্ষণে মহামান্য আদালত বলেন, ১৪ বছর বয়স থেকেই ঐশী রহমান সীসা এলকোহল গাঁজা ও ইয়াবা সেবন করতেন। এ কারণে তিনি ছিলেন আশাহীন ও সাহায্যহীন।
ঐশী রহমানের বাবা-মা দুজনেই ব্যস্ত থাকায় তিনি ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত। বাবা-মায়ের উচিৎ ছিল সন্তানকে সময় দেওয়া। বাবা-মা সময় না দেওয়ায় তিনি সচেতনতা এবং সুশাসন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
আসলে যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ১৪ বছর বয়সে একটি ছেলে বা মেয়ে মাদক কেনার পয়সা পায় কোথায়? মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা ‘মানস’ এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে মাদকাসক্তদের ৮০ শতাংশই কিশোর ও তরুণ।
মনের করার কোনো কারণ নেই, এই কিশোর তরুণ কেবল সমাজের ছিন্নমূল ও দারিদ্র্য পীড়িত অংশ থেকে এসছে। ঐশীর ঘটনাই এর প্রমাণ।
ঐশীর বাবা নাকি তাকে মাসে লক্ষাধিক টাকা হাত খরচ হিসেবে দিতেন। টাকা দিয়ে সন্তান মানুষ করা যায় না। তাকে যদি আদর স্নেহ মনোযোগ না দেন মূল্যবোধ ও শুদ্ধাচার না শেখান তাহলে সে আপনার দুশ্চিন্তার কারণ হবে।
আমরা সফল শিল্পপতি সুফি মিজানুর রহমানের কথা বলছিলাম। ছেলেমেয়েরা যখন স্কুলে পড়ত তিনি সন্তানদের বলতেন, স্টার হওয়ার দরকার নেই। ক্লাসের প্রথম ১০ জনের একজনও হওয়ার দরকার নেই। প্রথমে ভালো মানুষ হতে হবে। বাসায় অতিথি এলে তাদের খাওয়া-দাওয়া সেবাযত্ন ও দেখভালের দায়িত্ব দিতেন সন্তানদের ওপর।
এবং ছেলেমেয়েদের বলে দিতেন, মেহমানের জুতা যেন তারা পরিষ্কার করে দেয়। তখন মন খারাপ করলেও সন্তানরা এখন বুঝতে পারে। সন্তানদের শিখিয়েছেন ড্রাইভারসহ সবাইকে আপনি সম্বোধন করতে হবে। গাধা-বোকা এসব বলে সন্তানদের কখনো গালাগালি করেন নি।
এই প্রশিক্ষণের ফলাফল হলো, তার সাত ছেলে সবাই বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। এবং দেশে ফিরে বাবার সাথে শিল্প কারখানার উন্নয়নে পরিশ্রম করছেন। তারাও বাবার মতো বিনয়ী সদাচারী মানুষ হিসেবে পরিচিত হয়েছেন।
প্রিয় অভিভাবক! আপনি হচ্ছেন আপনার সন্তানের রোল মডেল। শিশুর হাতে যদি ভালো মানুষের বড় মানুষের জীবনী চিরায়ত গল্পের বই তুলে না দিয়ে দামী স্মার্টফোন আর ভিডিও গেমস তুলে দেন, সন্তানকে সময় না দিয়ে নিজে টিভি সিরিয়াল বা ইউটিউবে ডুবে থাকেন তাহলে কয়েক বছর পরে গিয়ে সন্তান কেন কথা শোনে না, পড়ালেখা না করে সারাক্ষণ স্মার্টফোনে কেন বুঁদ হয়ে থাকে এ জাতীয় আফসোস করে কোনো লাভ নেই।
শুধু জিপিএ ৫ আর কোচিংয়ের দিকে ছুটলে সন্তান ভালো মানুষ হবে না। তাকে শুদ্ধচারের শিক্ষা দিতে হবে। এবং শুদ্ধাচারের শিক্ষা পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এবং যে কারণে নবীজী (স) বলেছেন যে, সন্তানকে শুদ্ধাচার শিক্ষাদান হচ্ছে সন্তানের প্রতি পিতার সবচেয়ে বড় উপহার।
পরিস্থিতির অন্ধকার দিক আপনাদের সামনে তুলে ধরার কারণ একটাই। যাতে আমরা সচেতন হয়ে উঠতে পারি। এখনও সময় আছে তরুণ প্রজন্মকে কল্যাণের দিকে ফিরিয়ে আনার। সন্তানকে কল্যাণের দিকে ফিরিয়ে আনার।
এইজন্যে প্রথম করণীয়, তার হাতে শুদ্ধাচার বই তুলে দেয়া। শুদ্ধাচার বই ঘরে এমন জায়গায় রাখা যাতে হামাগুড়ি দিয়েও একটি শিশু এই বইটি ধরতে পারে নাড়াচাড়া করতে পারে। যখন সে পড়তে শিখবে তখন যেন সে এই বইটি বানান করে করে পড়ে।
একটা সময় আসবে। এই বইটিকে সে যদি ভালবেসে ফেলে তাহলে এই বইয়ের কথাগুলো সে তার জীবনে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করবে। এবং নিঃসন্দেহে সে ভালো মানুষ হবে।
আর অভিভাবক হিসেবে কয়েকটি বিষয়ে আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে। এক হচ্ছে, সন্তানকে একটি লক্ষ্য দিতে হবে। বড় হয়ে ভালো মানুষ হবার পাশাপাশি সে কী করবে এই ধারণা ছোটবেলা থেকেই তাকে দিতে হবে।
যখন তাকে ঘুম পাড়াবেন মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে চুলে বিলি দিতে দিতে বলবেন, তুমি বড় হলে ভালো মানুষ হবে। ভালো ইঞ্জিনিয়ার হবে। ভালো ডাক্তার হবে। বা ভালো প্রশাসক হবে। অর্থাৎ যা আপনি চান সেই বিষয়টি বার বার বার বার বার বার তাকে বলেন। সে যখন ঘুমোতে নেয় বিছানায় যখন সে শুয়ে থাকবে তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে এই কথাগুলো বলবেন।
আর বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানের চলাফেরা ও আচরণের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সময়মতো বাসায় ফিরছে কিনা! খাওয়া-দাওয়া ঠিকভাবে করছে কিনা সময়মতো ঘুমাচ্ছে কিনা বিশেষ খেয়াল করতে হবে। সন্তান কী করছে কোথায় যাচ্ছে কাদের সঙ্গে মিশছে এসব খবর রাখা খুবই জরুরি।
সন্তানকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত হাতখরচ দেয়ার ব্যাপারেও খুব সতর্ক থাকতে হবে। সে যেন ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের ভেতরে গুটিয়ে না থাকে সে ব্যাপারে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। তাকে মেহমান নয় পরিবারের সদস্য হিসেবে বড় করতে হবে। এবং পরিবারের ভালোমন্দ অভাব আনন্দ সবকিছুই যেন সে অংশীদার হয়।
আর সন্তান যখন বড় হবে তার সাথে সম্পর্কটা হবে বন্ধুত্বপূর্ণ। এবং তার আস্থার জায়গা হবেন আপনি। আপনাকে সে যদি বিশ্বাস করতে পারে আপনি যদি তার রোল মডেল হতে পারেন সে যদি আপনার মতো হতে চায় তাহলে সন্তান খুব সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে।
ঢাকা শহরে খেলার মাঠ যেহেতু এখন দিন দিন কমে যাচ্ছে তাই বিকল্প হিসেবে সন্তানকে যোগব্যায়ামে উদ্বুদ্ধ করুন। সন্তানকে সাথে নিয়ে যোগব্যায়াম করুন। এতে খেলাধুলা ও শরীর চর্চা না করার ফলে তার স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর যে প্রভাব পড়ছে সেই প্রভাব থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারবে।
যারা এপার্টমেন্টে থাকেন সেখানে কমন স্পেসে শিশুদের জন্যে ছবি আঁকা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান খেলাধুলার ব্যবস্থা করুন। যাতে এপার্টমেন্টের সব শিশুরা সেখানে জড়ো হতে পারে। এবং এ কাজে এমন কাউকে উদ্বুদ্ধ করুন যিনি সজ্জন ও নির্ভরযোগ্য।
আর প্রিয় অভিভাবক! সন্তানকে শুক্রবারে সবসময় সাদাকায়নে নিয়ে আসুন। জোর করে নয় উদ্বুদ্ধ করে সাদাকায়নে নিয়ে আসুন। সৎসঙ্ঘের সেবামূলক কার্যক্রমে সন্তান যাতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী হয় সেইজন্যে তাকে উদ্বুদ্ধ করুন।
তাহলে ছোটবেলা থেকেই সে সুস্থ প্রশান্ত আলোকিত জীবনের শিক্ষা পাবে। এবং গড়ে উঠবে পরিবার ও সমাজের দায়িত্ববান একজন সদস্য হিসেবে।
এখন আপনার চেয়ে আপনার সন্তানের বিপদই সবচেয়ে বেশি। তাই তাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিন। বিশেষ মনোযোগ ও মমতার ফলাফল আপনাকে উৎফুল্ল করবে।
বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রমে বন্যার্তদের যে-কোনো সহযোগিতায় আপনি এগিয়ে আসুন। আপনার এই সৎকর্মের পুরস্কার হিসেবে পরম প্রভু আপনার সন্তানের জীবনকে মঙ্গলময় করে দিতে পারেন।