আবদুল কালাম খুব দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন। বাবা ছিলেন মাঝি এবং স্থানীয় মসজিদের ইমাম। পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতে আবদুল কালাম পত্রিকা হকারি করেছেন। ছোটবেলা থেকেই শেখার প্রতি তার ছিল বেজায় আগ্রহ।
পদার্থবিদ্যায় গ্রাজুয়েশনের পর এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্যে ১৯৫৫ সালে স্কলারশীপ নিয়ে মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভর্তি হন। সেখানে সিনিয়র ক্লাস প্রজেক্টে কাজ করার সময় ফ্যাকাল্টির ডিন তার কাজের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। হুমকি দিলেন পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে প্রজেক্ট শেষ না করতে পারলে তার বৃত্তি ক্যান্সেল!
আবদুল কালাম নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রজেক্ট শেষ করলেন। মুগ্ধ হলেন ডিন স্যার। আসলে ছাত্রের কাজে তিনি সন্তুষ্টই ছিলেন। তবে তিনি দেখতে চাচ্ছিলেন চাপের মধ্যে কঠিন টার্গেট সে পূরণ করতে পারে কিনা!
আবদুল কালামের স্বপ্ন ছিল একজন ফাইটার পাইলট হবেন। ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের পরীক্ষায় অংশও নিয়েছিলেন। তাতে তার অবস্থান হয় ৯ম। কিন্তু সেবার সুযোগ পায় প্রথম ৮ জন!
এত কাছাকাছি গিয়েও স্বপ্ন ছুঁতে না পারায় প্রচণ্ড মন খারাপ হয় তার। এক শিক্ষকের সাথে শেয়ার করেন ব্যাপারটা। শিক্ষক তাকে বললেন, তুমি ব্যর্থ হয়েছ, কারণ হয়তো এর চেয়েও বড় কোনো সাফল্য তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে!
শিক্ষকের কথায় আবদুল কালাম উজ্জীবিত হলেন। পাইলট হওয়ার স্বপ্নটাকে বদলে দিলেন মহাকাশবিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্নে। কঠোর পরিশ্রমে পূরণ করেন সেই স্বপ্ন। Defence Research and Development Organisation (DRDO) এবং Indian Space Research Organisation (ISRO)’র মতো সংস্থাগুলোর বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
বিমান চালাতে পারেন নি তাতে কী! বিমান এমনকি রকেট উড়িয়েছেন তিনি। ভারতের মিলিটারি মিসাইল উন্নয়ন এবং পোখরান-২ নিউক্লিয়ার টেস্টে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। সেদিন যদি পাইলট নিয়োগ পরীক্ষায় সফল হতেন তাহলে নিশ্চয়ই এত কিছু তিনি হতে পারতেন না!
রোজার মাসে রাষ্ট্রপতি তার বাসভবনে ইফতার পার্টির আয়োজন করবে এটা ভারতের একটি পুরনো রেওয়াজ। প্রথমবারের মতো এই প্রথা ভাঙেন আবদুল কালাম।
রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হওয়ার পর রমজান মাসে প্রেসিডেন্ট তার সচিব মি. নায়ারের কাছে ইফতার পার্টিবাবদ খরচ কত তা জানতে চাইলেন। মি. নায়ার জানালেন, ২২ লাখ রুপি। ড. কালাম তাকে নির্দেশ দিলেন, কয়েকটি নির্দিষ্ট এতিমখানায় এই অর্থে খাদ্য, পোশাক ও কম্বল কিনে দান করতে হবে। কোন কোন এতিমখানায় দান করা হবে তা বাছাইয়ের জন্যে একটি টিম গঠন করা হয়।
এতিমখানা বাছাইয়ের পর ড. কালাম মি. নায়ারকে তার কক্ষে ডেকে এক লাখ রুপির একটি চেক দিলেন। বললেন, তিনি তার ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে এই অর্থ দান করছেন। কিন্তু এই তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। মি. নায়ার বললেন, “স্যার, আমি এক্ষুণী বাইরে যাব এবং সবাইকে বলব। কারণ, মানুষের জানা উচিত এখানে এমন একজন মানুষ রয়েছেন, যিনি রাষ্ট্রীয় যে অর্থ তার খরচ করা উচিত শুধু সেটাই দান করেননি, নিজের অর্থও দান করে দিয়েছেন!”
বিদেশে সফরকালে রাষ্ট্রপতিরা দামী দামী উপহার পেয়ে থাকেন। প্রেসিডেন্ট আবদুল কালামও পেয়েছেন। এ-ধরণের উপহার গ্রহণ না করা সৌজন্যের খেলাপ। তাই আবদুল কালাম বিনা বাক্যব্যয়ে এসব উপঢৌকন নিতেন। তবে রাষ্ট্রপতি ভবনে তার নির্দেশ ছিল তিনি সফর থেকে ফেরার পর সাথে আনা সব উপহারসামগ্রী ক্যাটালগ করে আর্কাইভে জমা করতে হবে। সেই উপহারসামগ্রীর দিকে তাকে কখনো ফিরে তাকাতেও দেখা যায়নি।
ড. কালাম রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করেছিলেন দুই স্যুটকেস নিয়ে; ভবন ত্যাগের সময়ও তার হাতে ছিল দুই স্যুটকেস! কোনো উপহারসামগ্রী, এমনকি একটি পেনসিলও নিয়ে যেতে দেখা যায়নি তাকে।
ড. কালাম একবার তার কিছু আত্মীয়কে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানান। তারা রাষ্ট্রপতি ভবনে এলে তাদের নগর ঘুরিয়ে দেখাতে তিনি একটি বাস ভাড়া করেন।
তিনি বাস ভাড়াবাবদ অর্থই শুধু পরিশোধ করেন নি, তাদের থাকা-খাওয়ার খরচবাবদ আসা দুই লাখ রুপি বিল তিনি পরিশোধ করেন ব্যক্তিগত উৎস থেকে। ভারতের ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি নেই।
আবদুল কালামের রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ শেষের দিকে। সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী তার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। ব্যক্তিগত সচিব মি. নায়ার গিয়েছিলেন একা। কারণ তার স্ত্রীর পা ভেঙে গিয়েছিল। শুনে ড. কালাম মর্মাহত হলেন। পরদিন মি. নায়ার সবিস্ময়ে দেখলেন প্রেসিডেন্ট তার বাসভবনে!
রাষ্ট্রপতি মিসেস নায়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। কিছুক্ষণ আলাপ করে চলে গেলেন।
ভাবুন, কতটা নিরহংকারী হলে একজন প্রেসিডেন্ট তার পিএস-এর অসুস্থ স্ত্রীকে নিজে দেখতে যান!