1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
  2. [email protected] : adminbackup :
মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১০:৫৯ অপরাহ্ন

ভোকেশনালে পড়েও জেনারেল শাখায় ভালো করা সম্ভব

  • সময় মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০২৫
  • ৭৩ বার দেখা হয়েছে

ভোকেশনালে পড়েও জেনারেল শাখায় ভালো করা সম্ভব

শিহাব সজীব

ফলিত গণিত বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
২০১৯ সালের ১৯ মার্চ। একটা বিশেষ দিন। কিছুদিন আগে মোবাইল ফোনে খবর এসেছে ২০ তারিখে লামায় পৌঁছাতে হবে। আমার মেডিকেল চেক-আপ করা হবে। আর কোনো অসুবিধা না থাকলে ওখানকার স্কুলের কারিগরি শাখার নবম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাব। স্কুলের নামটা অবশ্য অজানা। মামা মাস তিনেক আগে বলেছিলেন ভালো একটা স্কুল পেয়েছেন আমার জন্যে।

হোস্টেলে বা বাড়ির বাইরে থেকে পড়াশোনার অভিজ্ঞতা তখনো হয় নি। অনেক আগ্রহ ছিল হোস্টেল জীবন কেমন তা জানার। স্কুলটাতে ভর্তি হওয়ার জন্যে তাই খানিকটা ব্যাকুলই ছিলাম। আমার ব্যাকুলতা আরো তীব্র হলো যখন শুনলাম স্কুলটা কক্সবাজারে। পাহাড়ও আছে। পাহাড় আর সমুদ্রের মাঝে একটা তিন-চারতলা স্কুলভবন, সাথে হোস্টেল। সামনে বড় খেলার মাঠ। বন্ধুরা মিলে সব ক্রিকেট খেলছি। আর আমি তাদের তারকা খেলোয়াড়। বিকেলে সাগরের পাশে পাহাড়ের পাদদেশে সাইকেল চালাচ্ছি। চারদিকে জঙ্গল, বানর আর পাখির ঝাঁক। হরেক রকম সাপ আর নানা বন্যপ্রাণী। ক্লাসের পড়ায় ওস্তাদ আমি। আর লাইব্রেরি এবং ল্যাবের সবচেয়ে সক্রিয় সদস্য। এমন একটা দৃশ্যপট গেঁথে গেল মনের গহীনে।

জীবনে প্রথম বাড়ির বাইরে পড়াশোনা, প্রথমবারের মতো লম্বা দূরত্ব অতিক্রম, প্রথম পাহাড় দেখা, প্রথম জঙ্গলে যাওয়া, প্রথম পাহাড়ি মানুষ দেখাসহ আগমনী যাত্রাটা প্রায় পুরোটাই নতুন অভিজ্ঞতায় ভরা।

পরে জানতে পারি এটা কক্সবাজার নয়! এটি বান্দরবানের লামার একটি জায়গা। যা-হোক পাহাড়ি পরিবেশ তো পাবই—এ আশাটুকু ছিল। আমিরাবাদ থেকে সিএনজি নিয়ে কোয়ান্টামমে আসার সময় খুব ভালো লাগছিল। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর কোয়ান্টামমে পৌঁছে একটা অসাধারণ আবেশ সৃষ্টি হয় মনে। যদিও আমার মা বেশি জার্নির কারণে খানিকটা অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। ঐ দিনই মেডিকেল চেক-আপ শেষে আমাদেরকে ভর্তি করানো হলো। আমরা যারা ভর্তি হয়েছিলাম, তাদেরকে বেশ কয়েকটা পাহাড় পার করে একটা জায়গায় নেয়া হলো। পরে জেনেছিলাম ওটাই আমাদের ক্যাম্পাস।

ক্যাম্পাসে রওনা হওয়ার আগে মায়ের কাছে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সব দিয়েছিলাম। ভেবেছি পরে দেখা হবে। তাই তেমন কোনো কথা হয় নি। বিদায় জানানোও হয় নি। তারপর দেখা হয়েছিল নয় মাস পর। বার্ষিক ছুটির সময়।

আমি ছোটবেলা থেকেই ভাবতাম, যখন বড় হবো তখন পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল সব জায়গায় ঘুরব। তাই এখানে এসে পাহাড়, জঙ্গল। আর আশ্চর্য শান্ত পরিবেশ আমার ভালো লাগে। আসলে আমি তো তখন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, কোয়ান্টাম কসমো স্কুল, কোয়ান্টাম মেথড এসব কিছুই জানতাম না। শুধু মা আর মামার কথায় চলে এসেছি।

এসে দেখি আমার সাথে অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেছে। আমি আমার অজান্তেই মনছবির প্রক্রিয়া ব্যবহার করে ফেলেছি। বাড়িতে থাকার সময় আমার পড়ালেখার যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল। তবে মা ছিলেন বদ্ধপরিকর। যে করেই হোক তিনি আমাদের পড়ালেখা করাবেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা মা তার দুই সন্তান অর্থাৎ আমাকে আর আমার ছোট ভাইকে পড়ালেখা করানোর জন্যে কী পরিমাণ কষ্ট করেছেন তা বলাই বাহুল্য।

মায়ের বিয়ের আগে থেকেই বাবা অসুস্থ। পারিবারিক ষড়যন্ত্রে দাদার প্রচুর জমিজমা হাতিয়ে নিয়ে বাবাকে ভুয়া চিকিৎসা করিয়ে অসুস্থ বানানো হয়েছিল। ছোটবেলায় দাদাকে হারিয়ে সংগ্রাম করে বড় হয়েছেন বাবা। লেখাপড়ায় ভালো হয়েও নানান বিপাকে পড়ে জীবনে তেমন কিছু করা হয়ে ওঠে নি তার। বিয়ের পর বাবার অসুস্থতা বাড়তে লাগল। কাজকর্ম করার সামর্থ্য কমতে কমতে নামল প্রায় শূন্যের কোঠায়। পরিবারকে বাঁচাতে মা একটা এনজিও-তে চাকরি নিয়ে স্বল্প মজুরিতে বেদম খাটতে লাগলেন।

সংসার সামলাতে গত ১৮ বছর সংগ্রাম করেই চলেছেন তিনি। এনজিও-র এক প্রজেক্ট শেষ, তো অন্য কোনো প্রজেক্টে ঢোকার চেষ্টা। আমার মনে আছে, খুব ছোটবেলায় আমি তখন মোটামুটি কথা বলতে পারি, আমাকে হয় ঘুম পাড়িয়ে অথবা চাচাতো ভাইবোনদের সাথে খেলার তালে রেখে মা কাজে চলে যেতেন। মায়ের একবার স্ট্রোক হয়েছিল। তারপর থেকেই মাঝে মাঝে মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যান। তবুও কাজ চালিয়ে গেছেন। তবে মাকে একাই সবকিছু সামলাতে হয়েছে। এখন আপাতত কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। বর্তমানে যে জমি আছে তা দিয়ে মোটামুটি খাবারের মতো চাল পাওয়া যায়। আর কিছু বিক্রি করা হয়।

আর বাবা একটা মক্তবে পড়াচ্ছেন কয়েক বছর ধরে। বাবার আয়ের টাকা মোটামুটিভাবে তার ওষুধের খরচেই চলে যায়। মা আমাদের দুই ভাইকে ভালো পড়ালেখা করার মানসে স্থানীয় একটা বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। উপরের ক্লাসে ওঠার সাথে সাথে খরচও বাড়তে লাগল সমান হারে।

প্রাইমারিতে সরকারি স্কুলে থাকায় তেমন অসুবিধে হয় নি। যখন আমি নবম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম, ছোট ভাই তখন পঞ্চম শ্রেণিতে। কয়েকদিন পর তারও খরচ যোগ হবে সাথে আমার খরচ তো আছেই। সব মিলে দিন মোটামুটি কেটে যাচ্ছিল। আমাদের আত্মীয়রা সাহায্য করতেন। আমি বুঝতে পারছিলাম আমাকে যুদ্ধে নামতে হবে শীঘ্রই।

তাহলে মাঠে নামার সুযোগ পাচ্ছি! এতদিন তো মা সব ধকল সামলেছেন। বাবার অবদানও অবশ্য কম নয়। বাড়িতে থাকার সময় আমার কয়েকটা বিষয় নিয়ে চাওয়া এত প্রবল ছিল যে, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যে করেই হোক তা আমি পূরণ করব। আর অপেক্ষা করছিলাম সুযোগের।

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সুযোগ পেলে যোগব্যায়াম আর ধ্যান শিখব। অবশ্য সে সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতাম না। টিভিতে দেখে আর বইতে পড়ে আগ্রহবোধ করতাম। সব চাওয়া আগলে রেখেছিলাম, বড় হয়ে সামর্থ্য হলে পূরণ করব বলে। কসমো স্কুলে এসে এত দ্রুত সেই সুযোগ পেয়ে যাব আশা করি নি। এখানে এসে আরো জানলাম মনছবি সম্পর্কে। এখানকার বেশিরভাগ ব্যাপারই ভালো লাগতে শুরু করল।

সময়ের সাথে সাথে কোয়ান্টাম সম্পর্কে জানতে থাকলাম, শিখতে লাগলাম। আমি বাড়িতে ঘরকুনো ছিলাম। এখনো কিছুটা সে-রকমই আছি। তারপরও কীভাবে যেন অনেক জনের সাথে পরিচয় হয়ে গেছে!

দুই বছর মেয়াদি কারিগরি এসএসসি কোর্স শেষ করি কোয়ান্টাম কসমো স্কুল থেকে। আমরাই প্রথম ব্যাচ ছিলাম। বিজ্ঞান ভালো লাগে, তাই এসএসসি শেষে ভর্তি হয়েছি এখানেই কসমো কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে। এইচএসসি পরীক্ষায়ও এ প্লাস পেয়েছি।

অনেকে মনে করে, ভোকেশনাল বা কারিগরি থেকে পড়লে নাকি জেনারেল লাইনে ভালো করা যায় না। কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করি নি। কেন পারব না? আমার কীসের অভাব! যদিও পথটা সহজ না। কিন্তু কঠিন কাজই তো আমাদের করতে হবে। পরম করুণাময়ের রহমতে বর্তমানে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত গণিতে পড়ছি। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ বেছে নেয়ার সুযোগ ছিল কিন্তু আমি গণিত নিয়েই উচ্চতর পড়াশোনা করতে চাই। কারণ গণিত আমার খুব ভালো লাগে।

আসলে কোয়ান্টাম কসমো স্কুল সিলেবাসভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুধু নয়, পূর্ণাঙ্গ জীবনমুখী শিক্ষালাভের আদর্শ স্থান। কারণ এখানে এসে আমি নিজের মেধা সম্পর্কে আরো স্পষ্ট ধারণা পেয়েছি।

জীবনটা গড়ার এক অপূর্ব সুযোগ পেয়েছি এখানে। যারা এতে অবদান রাখছেন, কৃতজ্ঞতা জানিয়ে খাটো করতে চাই না তাদেরকে। তবে আশ্বস্ত করতে পারি, অনন্য মানুষে উত্তরণের পথে এখানে পাওয়া শিক্ষাগুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি।

[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All Rights Reserved © rmgbdnews24.com