আসলে একাত্তর সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সময় মানুষ যে কত ত্যাগ করতে পারে, কত নিঃস্বার্থভাবে ত্যাগ করতে পারে, বহু দৃশ্য দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। বহু দৃশ্য আমি দেখেছি যে, মানুষ কত ত্যাগী হতে পারে! সাধারণ মানুষ কত ত্যাগ করতে পারে!
যারা যুদ্ধ করেছেন, তারা নিঃসন্দেহে ত্যাগী। কিন্তু তাদের জন্যে যারা ত্যাগ করেছেন, তাদের ত্যাগ ও ত্যাগের মূল্য কোনো অংশে কম নয়। এবং এই সম্মিলিত ত্যাগই আমাদেরকে এত অল্প সময়ে স্বাধীন করেছে।
আসলে বড় কল্যাণের জন্যে, বড় উপকারের জন্যে প্রয়োজন হচ্ছে এই ত্যাগ। এই ত্যাগ ছাড়া জুলুমের অবসান হয় না, এই ত্যাগ ছাড়া বঞ্চনার অবসান হয় না, এই ত্যাগ ছাড়া মুক্তি অর্জন করা যায় না।
হিন্দু পুরাণে দুটি গ্রুপের কথা বলা হয়েছে যারা সবসময় পরস্পরে যুদ্ধ লিপ্ত ছিল।
একদলদের অসুর বলা হতো, আরেকদলকে বলা হতো দেবতা। তো অসুরদের প্রবল প্রতাপশালী রাজা বৃত্রাসুর ব্রহ্মার বর লাভ করলেন। যে-কোনো মানুষের বা দেবতাদের কোনো প্রচলিত অস্ত্রে চেনা অস্ত্রে তার মৃত্যু হবে না।
যখন এই বর লাভ করলেন, বৃত্রাসুর তান্ডব চালিয়ে গেলেন এবং দেবতাদের স্বর্গ থেকেই বের করে দিলেন। স্বর্গের অধিশ্বর হয়ে গেলেন বৃত্রাসুর। তখন দেবরাজ ইন্দ্র অন্যান্য দেবতাদের নিয়ে বিষ্ণুর কাছে হাজির হলেন।
বিষ্ণু তখন ইন্দ্রকে বললেন, এই মহাসংকটের সময়ে একমাত্র ত্যাগই পারে এর যোগ্য প্রতিকার করতে। কোনো নিঃস্বার্থ ত্যাগীর ত্যাগেই আছে এর যোগ্য প্রতিকার এবং জগতের মুক্তি।
তারপরে তিনি তাদেরকে তিরস্কার করে বললেন, কিন্তু তোমাদের চরিত্রে দেবতার অহমিকা থাকলেও ত্যাগের কোনো চিহ্ন নাই। ত্যাগের সেই ক্ষমতা বা মহিমাও নেই।
অতএব তোমরা নৈমিষারণ্যে দধীচি মুনির কাছে যাও। তিনি ত্যাগী এবং সর্বোপরি জগতের মঙ্গল কামনায় তার জীবন নিয়োজিত।
দেবতারা যখন দধীচি মুনির কাছে গেলেন, তখন দধীচি মুনি বুঝলেন যে কী উদ্দেশ্যে এসছেন দেবতারা। তিনি নিজেই হেসে বললেন, আমি জানি আপনারা কেন এসছেন! আমার এই নশ্বর দেহ তো একদিন নষ্ট হবেই। আমার সামান্য নশ্বর দেহের এই অস্থি দিয়ে যদি জগতের কল্যাণ হয়, অস্থি মানে হাড়, এই দেহের হাড় দিয়ে যদি জগতের কল্যাণ হয়, আমি অবশ্যই দেহ ত্যাগ করব।
যারা সিদ্ধ সাধক, অলী-বুজুর্গ, মুনি-ঋষি তারা ইচ্ছা মৃত্যুবরণ করতে পারেন। যখন তারা চান তারা মারা যেতে পারেন। মৃত্যুটা তাদের কাছে ইচ্ছাধীন হয়ে যায়। দধীচি মুনি যোগবলে দেহত্যাগ করলেন। তার শরীরের হাড় দিয়ে নতুন অস্ত্র তৈরি করা হলো বজ্রাস্ত্র।
এবং সেই অস্ত্র দিয়ে দেবতারা বৃত্রাসুরকে বধ করলেন। এবং দধীচি মুনি তার এই ত্যাগের জন্যে অমর হয়ে গেলেন।
তো আসলে মঙ্গলের জন্যে কল্যাণের জন্যে উপকারের জন্যে মুক্তির জন্যে জুলুম শোষণের অবসানের জন্যে এই ত্যাগটা হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে মানুষ বা যে জাতি এজন্যে ত্যাগ করতে পারে সে মুক্ত হয়, যেভাবে আমরা মুক্ত হয়েছিলাম।
আপনি দেখেন, এইজন্যেই মহামানবরা মুনি-ঋষিরা নবী-রসুলরা তারা সবসময়ই ত্যাগ করেছেন, কষ্ট স্বীকার করেছেন সাধারণ মানুষের জন্যে। আপনি দেখেন, যীশুখ্রিষ্ট! যীশু সবসময়ই তার জীবদ্দশায় ধর্মান্ধ মুর্খদের গালি নিন্দা সমালোচনা সহ্য করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন।
কিন্তু সত্যের আলো প্রচারের জন্যে নিরলস পরিশ্রম করেছেন, যে কারণে পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে যীশু তার জ্ঞান তার আলো তার মহিমা তার মানবপ্রেমের যে বাণী সেই বাণী ছড়িয়ে পড়েছিল।
আপনি দেখেন, নবীজীর জীবন – তিনিও কী করেছেন? মানুষের মুক্তির জন্যে, মানুষের কল্যাণের জন্যে তার ইহকালীন এবং পরকালীন পরিত্রাণের জন্যে এমন কোনো কষ্ট নাই এমন কোনো ত্যাগ নাই, তিনি স্বীকার করেন নি।
তিনি কষ্ট করেছেন, তিনি ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং সেই কারণেই তখনকার অবহেলিত বঞ্চিত মানুষরাই পৃথিবীকে জ্ঞানে বিজ্ঞানে সভ্যতায় আলোকিত করতে পেরেছিল।
আপনি দেখেন মহামতি বুদ্ধ! মহামতি বুদ্ধ বিলাস ব্যসন ত্যাগ করে, রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে এক বস্ত্রে আশ্রয় গ্রহণ করলেন এক বস্ত্রে।
আসলে বিলাসী মানুষের পক্ষে বিলাস ত্যাগ করা, যিনি চাওয়ার আগে সবকিছু পান তিনি এক বস্ত্রে ত্যাগ করলেন। এই বস্ত্র ভিজে গেলে কোন বস্ত্র পরবেন, কী খাবেন, কোথায় খাবেন, কে খাওয়াবে- কোনো চিন্তা নাই। এক বস্ত্রে গৃহত্যাগ করলেন।
এবং তিনি বোধি লাভ করলেন মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে, শতাব্দীর পর শতাব্দী তার জ্ঞান, তার শিক্ষা মানুষকে দুঃখ থেকে মুক্তি দিতে থাকল।
এবং দুঃখমুক্তির যে সূত্র তিনি বলেছিলেন ২৭০০ বছর আগে, সেই সূত্র এখনো এখনো বলবৎ। যে দুঃখের কারণ কি? দুঃখের কারণ হচ্ছে, আসক্তি। সেটা অর্থের আসক্তি হোক, মদের আসক্তি হোক, মাদকের আসক্তি হোক, জুয়ার আসক্তি হোক, অন্যায়ের আসক্তি হোক। এবং এই আসক্তি থেকে মুক্তির জন্যে তিনি জ্ঞানের আলোয় মানুষকে আলোকিত করেছিলেন।
আপনি দেখেন, এখন থেকে শতবর্ষ আগে, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, নরেন্দ্র নামে এক তরুণ তার কাছে গেল। এবং তিনি যখন ধর্মের স্বাদ পেলেন, সমর্পণের স্বাদ পেলেন, তা ছিল তার কাছে এক অপার আনন্দ।
এবং নরেন্দ্র তখন বললেন যে আমি এই অপার আনন্দের মধ্যে এই ধর্মের মধ্যে এই সমর্পণের মধ্যে ডুবে থাকতে রামকৃষ্ণ পরমাহংসদেব ধিক্কার দিয়ে বললেন যে, তোকে তো আমি একটা বড় বটবৃক্ষ ভেবেছিলাম। হাজার মানুষের আশ্রয় হবি তুই। আর তুই নিজেই নিজের মধ্যেই ডুবে থাকবি? হবে না!
মানুষের দুঃখ দূর করার প্রয়াস চালানো ছাড়া তোর নিস্তার নাই, পরিত্রাণ নাই। গুরুর কাছ থেকে দেশ ও মানুষকে নিয়ে ভাববার দীক্ষা পেয়ে তিনি হয়ে গেলেন স্বামী বিবেকানন্দ। রামকৃষ্ণ মিশন স্থাপন করলেন। এবং তার সেই মিশন এখনো মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে।
তো আসলে এই যে ত্যাগ, তিনি ইবাদতে ধর্মের উপাসনা আরাধনার যে আনন্দ সমর্পণের যে আনন্দ পেয়েছিলেন, সেই আনন্দে ডুবে থাকতে চেয়েছিলেন একা।
পরমহংসদেব তার গুরু বললেন, যে না, মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হও। তাহলেই তুমি পরিত্রাণ পাবে, তোমাকে ‘বটবৃক্ষ’ হতে হবে। ‘শামুক’ নয়। একা একা উপাসনা আরাধনা নয়। মানুষের সেবা করার মধ্য দিয়ে মানুষকে জাগিয়ে তুলতে হবে তার ভেতরের শক্তিকে।
আসলে মানুষের পরিত্রাণের জন্যে অনেক বড় যোগ্যতার প্রয়োজন নাই। অনেক কিছুর প্রয়োজন নাই। প্রয়োজন হচ্ছে শুধু একটা অন্তর। এই অন্তর যদি থাকে, সবকিছু জড়ো হয়ে যায় তার কাছে।
আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় জাতীয় অধ্যাপক শিশুবন্ধু অধ্যাপক এম আর খান এই কোয়ান্টামমে দুবার এসছিলেন। তিনি আমাদের কোয়ান্টাম মাস্টারও। এবং তিনি আমাদের উপদেষ্টা ছিলেন।
তো তিনি যখন প্রথম ডাক্তার হলেন, তিনি সাতক্ষীরায় চলে গেলেন যে, না আমি কী করব? গ্রামের রোগীদের সেবা করব।
এবং একদিনের ঘটনা, তিনি বলেছেন, যে আট মাইল দূরে সাইকেল চালিয়ে এক রোগীকে দেখতে গেলেন। দীর্ঘসময় রোগীর পাশে তাকে থাকতে হলো। ফেরার সময় রোগী দুই টাকা ফি দিতে চাইল।
রোগীর অবস্থা দেখে তিনি দুই টাকাও নিলেন না। আসলে এই যে মমতা, এই মমতাই তাকে ‘শিশুবন্ধু’ করেছিল। দাদীর চিকিৎসা করেছেন তিনি, মায়ের চিকিৎসা করেছেন, তারপরে মেয়ের চিকিৎসা। অর্থাৎ তিন প্রজন্মর, তিন প্রজন্ম কেন! আমার মনে হয় যে, চার প্রজন্মের চিকিৎসক ছিলেন তিনি। কারণ আগেকার প্রজন্ম তো খুব ঘন ঘন প্রজন্ম ছিল। এখনকার প্রজন্ম নাই, একটু দেরি দেরি প্রজন্ম হয় হ্যাঁ?
তো আসলে তিনি কিংবদন্তী চিকিৎসক হয়ে গেলেন।
তো আসলে আমরা কোয়ান্টামে সেটাই করেছি। আমরা শুধু নিজে আলোকিত হওয়া না, শুধু গুটি কয়েকজন আলোকিত হওয়া না, এই আলোকে আমরা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছি।
তো পরম করুণাময় আমাদের কবুল করুন, আমরা যাতে শুদ্ধাচারী হতে পারি এবং ত্যাগী হতে পারি।
দেশের জন্যে মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে ত্যাগ করেছেন, সেই প্রজন্মে তাদের সহায়তাকারীরা সহযোগীরা যেভাবে ত্যাগ করেছেন, আমরাও দেশের জন্যে সেইভাবেই ত্যাগ করতে চাই।
যাতে আমাদের পরের প্রজন্ম সফল প্রজন্ম হিসেবে পৃথিবীতে তার পরিচয় সৃষ্টি করতে পারে।
[কোয়ান্টামম সাদাকায়ন, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২০]