লিবারেশন অব মক্কা।
পৃথিবীতে যুগে যুগে যুদ্ধ হয়েছে এবং নানান ধরনের রণকৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে।
এবং রণকৌশলের ওপরে সবচেয়ে প্রাচীন বই পাওয়া যায় সেটা চাইনিজ বই, চীনাদের।
এবং তারপরেও এখনকার সমরবিদরাও নানান ধরনের রণকৌশল ব্যবহার করেছেন।
বিজয়ীর সবসময় লক্ষ্য থাকে প্রচণ্ড শক্তিতে অকস্মাৎ আক্রমণে। অপ্রস্তুত অবস্থায় অকস্মাৎ আক্রমণে শত্রুপক্ষকে একদম পর্যুদস্ত করে, নাস্তানাবুদ করে ধ্বংস করে দেয়া।
বিজয়ীর লক্ষ্য সবসময়ই থাকে শত্রুপক্ষের সম্পূর্ণ বিনাশ।
কীভাবে করতে হবে?
প্রচণ্ড শক্তিতে অকস্মাৎ। শত্রু প্রস্তুতি নেয়ার আগে অকস্মাৎ আক্রমণ করো এবং ধ্বংস করো। তারপরে সেখানে নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করো।
ধরেন সর্বশেষ আমরা যেটা দেখি– বুশ, ইরাকে তার ওয়ার্ডিংই ছিল শক এবং আতঙ্কিত করো।
এবং নবীজী (স) যত যুদ্ধনায়ক এসছেন, সমরনীতি যত হয়েছে, উনি একটা অভূতপূর্ব রণকৌশল প্রয়োগ করেছিলেন। যেটাকে আমরা আমাদের সিরাতে বলেছি যে, অহিংস রণকৌশল, অহিংস!
অহিংস রণকৌশল কী? সেটা হচ্ছে প্রস্তুতি নাও, অকস্মাৎ উপস্থিত হও। নেগোসিয়েট করো, আলাপ আলোচনা করো এবং তাকে পক্ষে নিয়ে আসো।
ধ্বংস নয়, বিনাশ নয়। তাকে বিপ্লবের শক্তিতে রূপান্তরিত করো। তার বিনাশ নয়, ধ্বংস নয়, কিচ্ছু নয়। তাকে মিত্র বানাও। শত্রুকে মিত্র বানাও।
অকস্মাৎ কেন যাবে? প্রস্তুতিটা কেন থাকবে দৃশ্যমান? যে যাতে সে যুদ্ধ না করে। এবং প্রাচীন ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় যে, নবীজী (স) একটা এম্পায়ার, সাম্রাজ্য গঠন করলেন থ্রো নেগোসিয়েশন। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে।
তার পুরো জীবনে ৮০টারও বেশি অভিযান তিনি চালিয়েছেন।
পৃথিবীর কোনো সমরনায়ক এতগুলো অভিযান তার জীবনে চালাতে পারেন নাই। ৮০টা অভিযান চালিয়েছেন ছোট-বড় মিলিয়ে এবং তাতে লিবারেশন অব মক্কা, মক্কা মুক্ত করা পর্যন্ত দুই পক্ষে নিহতের সংখ্যা পাঁচশরও কম।
কিন্তু একটা এম্পায়ার বিল্ড করলেন পুরো আরব জুড়ে। তার এই অহিংস রণকৌশল! এটা অদ্ভুত, অপূর্ব!
এবং এই রণকৌশল এর আগে কেউ প্রয়োগ করেন নি এবং এরপরেও কেউ প্রয়োগ করে নি।
অন্য কোনো পদ্ধতিতে, অন্য কোনো প্রক্রিয়াতে কেউ প্রয়োগ করেন নি।
তো এখন লিবারেশন অব মক্কাকে যদি কেউ মক্কা বিজয় বলেন, বিজয় বলতে পারেন।
আবার সমাজ বিপ্লবীর দৃষ্টিকোণ থেকে, আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে পারি, যিনি একটা সোশ্যাল রেভলুউশন করলেন, সমাজবিপ্লব করলেন অহিংস পদ্ধতিতে।
যত সামাজিক বিপ্লব হয়েছে ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু করে রুশ বিপ্লব পর্যন্ত, প্রত্যেকটা বিপ্লব তার প্রতিপক্ষকে বিনাশ করে দিয়েছে।
কিন্তু নবীজী তার সমাজ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আগের যে শক্তি, আগের যে শত্রু, শত্রুদের বিনাশ করেন নাই, শত্রুদের মিত্রে পরিণত করেছেন।
ইতিহাসের এই ব্যাখ্যাটা, এই বিষয়টা আমরা অধিকাংশই জানি না। কারণ আমরা ঐভাবে ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করি নাই।
ধরেন, আমরা যদি দেখি যে, লিবারেশন অব মক্কা শুরু হলো কখন থেকে?
আসলে একটা ছোট দলও যে বড় শক্তিকে আলোচনার টেবিলে বসে কীভাবে কাবু করে ফেলে হুদায়বিয়া হচ্ছে তার উদাহরণ।
মক্কা তখনও অবিসংবাদিত আরবের নেতা।
কারণ সমস্ত আরবভূমিতে কোরাইশদের মনে করা হতো ঈশ্বরের বরপুত্র।
কারণ আবরাহা কাবাঘর ধ্বংস করতে ব্যর্থ হওয়ায় সমস্ত আরববাসী ধরে নিল যে ঈশ্বরের আশীর্বাদ রয়েছে এই কোরাইশদের ওপরে।
এবং কোরাইশদেরকে মেনে নিতে হবে দুটো কারণে। এক- ধর্মীয়, দুই হচ্ছে উদীয়মান-বিকাশমান একটা অর্থনৈতিক কেন্দ্র।
কোরাইশদের টাকা আছে, ধর্মীয় শক্তি রয়েছে এবং সেই সাথে ঈশ্বরের আশীর্বাদ আছে।
অতএব কোরাইশরা অপরাজয় শক্তি হিসেবেই ছিল।
তো নবীজী (স) কেন হুদায়বিয়ার সন্ধি করলেন। এবং হুদায়বিয়ার সন্ধির মধ্য দিয়ে নবীজীর (স) অর্জন কী হলো?
আপাতদৃষ্টিতে সবটাই হচ্ছে নেগেটিভ।
ওমরাহ করতে যাচ্ছিলেন। ওমরাহ করতে পারলেন না। না করে ফিরে আসতে হলো।
অর্থাৎ যে মাটিতে, যে ভূমিতে আরবের যে-কোনো মানুষ যেতে সেই সময়ও তিনি যেতে পারলেন না, ফিরে আসতে হলো তাকে।
ফিরে আসলেন কী নিয়ে? আনন্দ নিয়ে। কেন?
শান্তিচুক্তি হলো ১০ বছরের জন্যে। এই শান্তিচুক্তির ফলে তিনি নির্বিঘ্নে নিরুপদ্রুবে অত্যাচারিত না হয়ে তিনি শান্তির বাণী, প্রচার করতে পারবেন। চলে এলেন তিনি।
এবং কোরাইশরা শান্তিচুক্তির করার পরে উপলব্ধি করল যে, আসলে চুক্তির কোনো পয়েন্টই তাদের পক্ষে না। সবই তাদের পক্ষে ছিল দৃশ্যমানভাবে, তারাই চাপিয়ে দিয়েছে কিন্তু প্রত্যেকটা পয়েন্ট তাদের বিপক্ষে চলে গেছে।
কী অপমানকর ব্যাপার যে, নবীজীর কে অনুসরণ করে কেউ মক্কা থেকে এলে তাকে মক্কায় ফিরিয়ে দিতে হবে।
আর মদিনা থেকে কেউ যদি যায় তাহলে মক্কাবাসীরা তাকে ফিরিয়ে দেবে না। আপাতদৃষ্টিতে খুব অপমানকর।
কিন্তু নবীজী তো জানতেন যে মদিনা থেকে কে যাবে? কেউ তো যাবে না। যাওয়ার কেউ নাই। আর যদি যায় কেউ, ঐরকম কারো না থাকাই না থাকাই ভালো।
তো কোরাইশরা বুঝল!
সমস্যা কী হলো? এখন মক্কা থেকে যে-ই যায় বা অন্যান্য যে যায় তাকে তো নবীজী আর গ্রহণ করতে পারেন না। গ্রহণ করতে পারেন না তো এরা কী করবে? এরা তো মক্কায়ও ফিরে যেতে পারে না।
তারা গেরিলা বাহিনী গঠন করল। আমাদের মদিনাতেও যখন কোনো জায়গা নাই, মক্কাতেও জায়গা নাই ঠিক আছে, আমরা তৃতীয় জায়গা!
এবং আস্তে আস্তে ঐখানে লোকজন বাড়তে লাগল। এবং তাদের কারণে কোরাইশদের বাণিজ্য সিরিয়ার গামী বাণিজ্যযাত্রা বিঘ্নিত হয়ে গেল।
তখন কোরাইশরা নিজেরা প্রস্তাব করল যে, যারা মুসলমান হয়েছে তাদেরকে আপনি নিয়ে নেন। আপনার জায়গায় আশ্রয় দেন। পথ মুক্ত হোক।
অর্থাৎ ধৈর্য সবর অহিংসনীতি যে কীভাবে কার্যকরী হয়, কীভাবে পক্ষে চলে আসে এটা হচ্ছে সেটার প্রমাণ।
কিন্তু কোরাইশরা যখন বুঝল যে আসলে বিষয়টা তাদের জন্যে যেটা মনে করা হয়েছিল যে তারা বিজয়ী হয়েছে হুদায়বিয়ায়, সেটা নয়, তখন তারা এই চুক্তি কীভাবে লঙ্ঘন করা যায়… সব জায়গায়ই তো উগ্রবাদী থাকে, এক্সট্রিমিস্ট থাকে, চরমপন্থী থাকে, হঠকারী লোক থাকে।
অতি বিপ্লবী যে-রকম থাকে আবার সে-রকম অতি নিষ্ঠুর লোকজন থাকে। এবং এরা সমাজের ক্ষতি করে সবচেয়ে বেশি। শান্তির ক্ষতি করে সবচেয়ে বেশি।
তো এবং এই এক্সট্রিমিস্টদের প্ররোচণায় বনু বকর গোত্র খুজাহ গোত্রের একটা গ্রুপকে তারা মেরে ফেলল, হত্যা করল।
এমনকি খুজাহ গোত্রের এরা মক্কাতে কাবার ঘরের সীমানার মধ্যে এসেও তারা রেহাই পেল না।
এবং কোরাইশদের একটি দল এই বনু বকর গোত্রকে অস্ত্র এবং অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করল।
যখন নবীজির কাছে এটা গেল, খুজাহ গোত্র ছিল নবীজীর মিত্র গোত্র।
আর বনু বকর ছিল কোরাইশদের মিত্র গোত্র।
তো নবীজী কোরাইশদের কাছে দূত পাঠালেন। তিনটি প্রস্তাব পাঠালেন।
যে এক. খুজাহদের যারা মারা গেছে তাদের রক্তপণ দিতে হবে। অর্থাৎ মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ তখনকার নিয়ম অনুসারে।
দুই. অথবা বনু বকর গোত্রের সাথে কোরাইশদের যে মৈত্রী চুক্তি, এটা বাতিল করতে হবে।
অথবা তিন নাম্বার হচ্ছে যে, হুদায়বিয়ার যুদ্ধবিরতি চুক্তি এটা বাতিল ঘোষণা করতে হবে।
এই তিনটা একটা অপশন।
তখন মুতাতে রোমানদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধ। সে যুদ্ধে নবীজীর তিনজন খুব বড় কমান্ডার শহিদ হন।
এবং তার মধ্যে জায়েদ বিন হারিসা এবং জাফর ছিলেন। এবং এরা সবাই নবীজীর খুব প্রিয়ভাজন ছিলেন।
এবং সেই যুদ্ধেও মানে সেটাও খুব মারাত্মক ব্যাপার। সেখানেও খালিদ বিন ওয়ালিদ প্রথম তার যে সেনাপতিত্বের কারিশমা কারিশমা দেখানোর সুযোগ পান। ধরেন তিন হাজার সৈন্য এবং আরেকদিকে বিপরীত দিকে এক লক্ষ রোমান সৈন্য, লক্ষাধিক রোমান সৈন্য।
তো যখন তিনজন সেনাপতি মারা গেলেন, তখন নবীজীর নির্দেশ ছিল যে এরপরে তোমরা সেনাপতি মনোনীত করবে।
তো খালিদ বিন ওয়ালিদ সেনাপতিত্ব নিলেন এবং খুব ট্যাক্টিকেল রিট্রিট করলেন। তিনি যখন দেখলেন এই তিন হাজার সৈন্য নিয়ে লাখ সৈন্যের সাথে যুদ্ধ করা যাবে না, তখন তিনি কৌশলগত পশ্চাদপসরণ করলেন এবং খুব সাকসেসফুলি পুরো বাহিনীকে নেতৃত্ব দিলেন। তিনজন সেনানায়ক মারা গেছেন কিন্তু মুসলমানদের পক্ষে শহিদ হওয়ার সংখ্যা হচ্ছে ১৩ জন। ের মধ্যে সেনানায়কই তিনজন।
কারণ রোমানদের কৌশল ছিল সেনাপতিকে আগে হত্যা করা। যে সেনাপতিকে হত্যা করলে অন্যরা বিশৃঙ্খল হবে। বিশৃঙ্খল হলে রণে ভঙ্গ দিয়ে তারা চলে আসবে।
কিন্তু খালিদ বিন ওয়ালিদ সেনাপতিত্ব গ্রহণ করলেন এবং কৌশলের সাথে পশ্চাদপসরণ করলেন। সমস্ত বাহিনীকে অক্ষত নিয়ে চলে এলেন।
এবং এটাকে কোরাইশরা ধরে নিল যে এটা মুসলমানরা শেষ হয়ে গেছে। অতএব এখন আমরা আমাদের মতো আচরণ আবার করতে পারি।
তো তখন উত্তেজনার বশে কোরাইশদের পক্ষে কুর্তা ইবনে ওমর ঘোষণা করলেন যে, আমরা তৃতীয় শর্তটি আমরা মেনে নিলাম।
মানে হুদায়বিয়ার চুক্তি শেষ।
তো নবীজীর দূত যখন মক্কা থেকে ফিরে এলো, তখন কোরাইশরা ফিল করল যে, না কাজটা ঠিক হয় নি। আবু সুফিয়ানকে প্রেরণ করল তারা।
নবীজী তখন অলরেডি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।
আবু সুফিয়ানের দূতিয়ালি আর কোনো কাজে এলো না। আবু সুফিয়ান ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এলেন।
এবং কোরাইশদের যে অন্যায়, এই অন্যায়ের প্রতিকারের জন্যে নবীজী (স) তখন মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন যে কোরাইশরা কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই মক্কা পৌঁছাতে হবে।
যুদ্ধ প্রস্তুতি নিলেন, নির্দেশ দিলেন, কিন্তু লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি নীরবতা অবলম্বন করলেন।
এবং এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রত্যেক সেনানায়কই যুদ্ধের লক্ষ্য সম্পর্কে সবসময়ই নীরবতা অবলম্বন করেন।
এবং যিনি যত নীরবতা অবলম্বন করতে পারেন, যত গোপন রাখতে পারেন তার পরিকল্পনা, তিনি তত সাকসেসফুল হন।
এবং এই যুদ্ধ প্রস্তুতির মধ্যে আসলে নবীজীর (স) ইএসপি পাওয়ার/অতীন্দ্রিয় শক্তি প্রবল ছিল। এবং তার যে-রকম গোয়েন্দা বাহিনী কাজ করত, তেমনি তার এই অতীন্দ্রিয় শক্তিও অনেক কিছু বুঝতে তাকে সবসময়ই সাহায্য করেছে।
এবং মোটামুটি গোপনীয়তা অবলম্বন করতে পারলেন। এবং আগে যখন যুদ্ধ প্রস্তুতি হতো প্রত্যেককে মদিনায় সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিতেন, মিত্রদের।
কিন্তু এই প্রথমবার কিছুই বললেন না যে তোমরা প্রস্তুত হয়ে থাক। কখন কোথায় দেখা করতে হবে আসতে হবে এটা তোমাদেরকে জানানো হবে।
নবীজী (স) অষ্টম হিজরির ১০ই রমজান মদিনা থেকে যাত্রা করলেন।
৭০০ মোহাজের আর ৪০০০ আনসার নিয়ে মূল বাহিনী।
আসলে সকল মোহাজের এবং আনসার এই অভিযাত্রায় অংশ নেন। পথে বনু সুলাইয়াম, বনু মুজায়না এবং আরো আরো গোত্র থেকে মোট এক হাজার অশ্বারোহীসহ ১০ হাজার সৈন্য অংশ নেন।
এবং আরবের ইতিহাসে এবং মুসলমানদের ক্ষেত্রে এটা একটা বিশাল ব্যাপার। এর আগে রোমানদের বিরুদ্ধে যে অভিযাত্রা হয়ে ছিল–মুতা অভিযান, তিন হাজার সৈন্য অংশ নেন। আর এবার ১০ হাজার।
এবং নবীজীর সাথে উম্মুল মোমেনিন উম্মে সালামা এবং মায়মুনা এরা ছিলেন।
এবং উম্মে সালামা অসাধারণ মহিলা। এই যে নারী অধিকার নারী অধিকারের নারী এক্টিভিস্ট ছিলেন তিনি।
এবং নবীজীর ঘরে যাওয়ার পরে তিনি মদিনার মহিলাদেরকে একত্র করলেন যে, তোমাদেরও কিছু করার আছে।
এবং একদিন নবীজীকে বললেন, কোরআনে খালি পুরুষদের কথা আছে, মহিলাদের কথা নাই!
তো এরপরে কয়েকদিন পরে শুনছেন যে, যখন ওখানে গেলেন মসজিদের মধ্যে তখন নবীজী তেলাওয়াত করছেন মহিলাদের অধিকার সংক্রান্ত, কাজ সংক্রান্ত, গুরুত্ব সংক্রান্ত আয়াত।
তো আসলে উনি যে শুধু স্ত্রী ছিলেন তা না, নবীজীর পরামর্শকও ছিলেন। এবং নবীজী বিভিন্ন সময় তার পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। এবং যেটার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ আমরা দেখি হুদায়বিয়ার সময়।
তো উনি ছিলেন, মায়মুনা ছিলেন এবং মেয়ে ফাতিমা।
তো যাত্রার শুরুতেই নবীজীর প্রার্থনা ছিল–হে আল্লাহ! কোরাইশ ভূখণ্ডে তাদের অজ্ঞাতসারেই উপস্থিত হয়ে আমরা যেন তাদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিতে পারি!
কেন? তাহলেই তিনি তারা যদি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়, তাহলে হচ্ছে বাধা দিতে পারবে না এবং কোনো রক্তপাত ছাড়াই মক্কাকে পৌত্তলিকতা থেকে মুক্ত করা যাবে। কাবাঘরকে মুক্ত করা যাবে।
রোজার সময় মদিনা থেকে যাত্রা করে কয়েক কিলোমিটার দূরে আসফানে পৌঁছেই তিনি বললেন যে, একটা মগে করে পানি নিয়ে আসো।
মগে করে পানি নিয়ে আসা হলো। তিনি উটের পিঠে বসে আছেন। মগটাকে উঁচু করলেন যাতে আশেপাশের লোকজন দেখতে পায়। তারপর তিনি পানি পান করলেন।
কেন? যে যুদ্ধযাত্রায় রোজা রেখে যেন তাঁর অনুসারীরা পানির পিপাসায় না ভোগে।
তিনি নিজে পানি পান করে তাদের পথ উন্মুক্ত করে দিলেন।
নবীজীর নেতৃত্বে বাহিনী এগিয়ে যাচ্ছে। এবং আজজুফায় যখন পৌছলেন তখন তার চাচা আল আব্বাস যিনি সবসময়ই তার গুণগ্রাহী ছিলেন এবং তার প্রোটেক্টর ছিলেন, তিনি তখন সপরিবারে যাচ্ছেন মদিনায় ধর্মগ্রহণ করার জন্যে।
তো পথে যখন দেখা হলো সেখানেই তিনি নবীজীর ধর্মগ্রহণ করলেন এবং আবার কাফেলার সাথে মক্কার দিকে যাত্রা শুরু করলেন।
এবং দেখেন আমরা বলছিলাম যে নবীজী কী পরিমাণ সৃষ্টির জন্যে করুণা ছিলেন!
এত গুরুত্বপূর্ণ অভিযান! হঠাৎ নবীজী দেখেন যে, পথের পাশে একটা কুকুর সদ্যপ্রসব করা বাচ্চাগুলো নিয়ে বসে আছে।
এই যে একটা কুকুরছানা, ধরুন, ঐদিকে পড়লে তো কুকুর দেখা যেত দৌড়ে চলে গেল! কিন্তু বাচ্চাগুলো তো আর দৌড়াতে পারত না। বাচ্চাগুলো তো পিষ্ট হয়ে মারা যেত। এজন্যেই তিনি রাহমতুল্লিল আলামিন!
নবীজী দেখার সাথে সাথে এক সাহাবী–জোয়ায়েল তাকে নামিয়ে দিলেন ওখানে যে, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাক। পাহারা দাও। বাহিনী যাতে এদিক এই ঘেঁষে চলে যায়।
কারণ উনি বুঝতে পারছেন যে বিশাল বাহিনী এখন তো মানে ১০ হাজার সৈন্যের বাহিনী।
তো বাহিনীর গন্তব্য সম্পর্কে চুপ।
কিন্তু এত বড় বাহিনী, এটা তো আর অজানা থাকে না। মরুভূমিতে কিন্তু কথা উটের আগে দৌড়ায়। কথা থাকে না!
হাওয়াজিন, যারা মধ্য আরব এবং পূর্ব আরবের বিশাল এলাকা জুড়ে যাদের বাস, তো তারা আশঙ্কা করল যে, এত বড় বাহিনী যখন আসছে নিশ্চয়ই তায়েফ আক্রমণ হবে।
এবং উনি যে পথে যাত্রা করেছেন এটা শুধু মক্কা না, মক্কাতেও যাওয়া যায়। তায়েফেও যাওয়া যায়।
উনি তায়েফের পথ ধরে এগুচ্ছেন।
এবং নবীজীর (স) বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্যে তারাও বিশাল সৈন্য সমাবেশ করল তায়েফের কাছে- ২০ হাজার।
তো নবীজী (স) তায়েফের দিকে যেতে যেতে ডানদিক ঘুরে গেলেন।
অর্থাৎ মক্কা পার হয়ে গিয়ে ডানদিকে ঘুরে তায়েফ থেকে যে পথ মক্কার দিকে গিয়েছে সে পথে চলে গেলেন।
তো টেকনিকটা বুঝতে পারছেন? যে উনি শুধু নবী ছিলেন না, শুধু রাজা ছিলেন না, উনি শুধু বিচারক ছিলেন না, উনি সেনানায়ক ছিলেন। যিনি পৃথিবীর ইতিহাসে একটা রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেখানে দুই পক্ষের মৃতের সংখ্যা পাঁচশ জন।
যেখানে খন্দকে প্রায় ১০ হাজার কোরাইশ এবং তার মিত্ররা এবং নবীজীর তিন হাজার। এবং খন্দকে মৃতের সংখ্যা- দুই পক্ষে ২০ জন।
কেন? নবীজী সবসময় রক্তপাতকে এভয়েড করেছেন।
মক্কার দিকে ঘুরে গেলেন ডানে এবং চার কিলোমিটার দূরে আল-জাহরানে আল জাহরানে ফাতেমা উপত্যকায় থামলেন এবং শিবির গাড়ার নির্দেশ দিলেন।
তখন সন্ধ্যা নেমে আসছে।
সাধারণত ক্যাম্প ফায়ার করা হয় একেকটা তাঁবুতে একটা করে।
উনি ১০ হাজার সৈন্যের প্রত্যেককে নির্দেশ দিলেন যে, প্রত্যেকে আলাদা আলাদা আগুন জ্বালাবে।
অর্থাৎ একটা তাঁবুতে যদি ১০ জন থাকে, তাহলে কত? এক হাজার আগুন জ্বালার কথা। কিন্তু আগুন জ্বললো ১০ হাজার। তার মানে হচ্ছে ১০ হাজার তাঁবু। যাতে শত্রু পক্ষ বোঝে ১০ হাজার তাঁবু মানে বিশাল বাহিনী। যে পাঁচ জন করেও যদি তাঁবুতে থাকে তাহলে ৫০ হাজার সৈন্য।
এবং পুরো উপত্যকা আগুনে আগুন হয়ে গেল। এবং যে আগুন মক্কা থেকে দেখা যায়।
এবং মক্কার লোকেরা টের পেল এই প্রথম যে, অবস্থা তো খারাপ। আর গুজব তো আছেই। গুজবের তো হাত পা নাই। গুজব তো সবসময় ছড়ায়।
আর কিছু লোকজন তো থাকে তাদের কোনো যে স্বার্থ থাকে তাও না, খবর সংগ্রহ করে, খবর বিতরণ করে তারা আনন্দ পায়।
তো নানা ধরনের গুজবে কোরাইশরা বিভ্রান্ত। কিন্তু তারা বুঝল যে, নবীজীর বাহিনী মক্কার উপকণ্ঠে চলে এসেছে।
উৎকণ্ঠা আতঙ্কে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এবং কোরাইশ নেতৃবৃন্দের কাছে কোনো সুস্পষ্ট তথ্য নাই কত জন আসছে, কী আশয়, কী বিষয়!
তখন তারা কী করা যায় খোঁজখবর নেয়ার জন্যে আবু সুফিয়ান আরও দুজনকে হাকিম ইবনে হিজাম এবং বুদায়েল ইবনে ওরাকাকে পাঠাল।
তারা ওখানকার কাছে আরক উপত্যকায় পৌঁছে দিগন্ত বিস্তৃত যে আলো, সেই আলো দেখছিল।
‘আরক’ উপত্যকা যেখান থেকে সবকিছু দেখা যায় সেখানে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে কথা বলছেন।
এদিকে রসুলুল্লাহ (স) তার চাচা আল আব্বাসকে পাঠালেন অথবা আল আব্বাস তার অনুমতি নিয়েই গেলেন মক্কায় খোঁজখবর নেয়ার জন্যে এবং আত্মসমর্পণ করার জন্যে তাদেরকে মানসিকভাবে চাপ প্রয়োগ করা উদ্বুদ্ধ করা শান্তিপূর্ণভাবে।
কারণ রসুলুল্লাহ (স) সবসময়েই রক্তপাতের বিরুদ্ধে ছিলেন। এবং কখনো রক্তপাতকে তিনি উৎসাহিত করেন নি।
তো আল আব্বাস রসুলুল্লাহ (স) সাদা খচ্চরে চড়ে এসেছিলেন, সেই খচ্চর নিয়েই রওনা দিলেন।
তো যখন আল আরাক উপত্যকায় তিনি পৌঁছলেন, অন্ধকারের মধ্যে আবু সুফিয়ানের গলা শুনতে পেলেন, কণ্ঠস্বর চিনে ফেললেন।
এবং দুই উৎকণ্ঠিত মানুষ– একজন আবু সুফিয়ান আর আল আব্বাস উনি ব্যাংকার ছিলেন, পুঁজি লগ্নীকারক ছিলেন। আর মক্কার অভিজাতদের একজন।
মানে দুজনের কারো উৎকণ্ঠাই কম নয় যে যদি যুদ্ধ হয় তাহলে বিজয়ী বাহিনী যখন যুদ্ধ করে রক্তক্ষয় করে ভেতরে ঢুকবে তখন রক্তক্ষয়ের পরিমাণ আরো বাড়বে।
তো আবু সুফিয়ানের আওয়াজ শুনে যখন নিশ্চিত হলেন যে আবু সুফিয়ান, এগিয়ে গেলেন এবং তাকে বোঝালেন, আলাপ করলেন, চলো শিবিরে।
তো আবু সুফিয়ান এবং তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে আল আব্বাস মুসলিম শিবিরে চলে এলেন। তো পথে আসতে আসতে, যেহেতু নবীজীর (স) খচ্চর, যারা সেন্ট্রি ছিল প্রহরী ছিল স্বাভাবিকভাবেই ছেড়ে দিল।
তো আল আব্বাস সব বিবরণ দিতে লাগলেন যে, বাহিনী কত শক্ত, কত বড়, কত কিছু এই সমস্ত! এবং আসন্ন পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই আবু সুফিয়ানের শঙ্কা আরো বেড়ে গেল।
অর্থাৎ আবু সুফিয়ানকে সাইকোলজিক্যালি নার্ভাস করে দেওয়া হলো।
আসলে এতদিনের বিরোধিতা! বিরোধীদের নেতা। নার্ভাস হলেও অত মানে নার্ভ কিছু না থাকলে তো লিডার হওয়া যায় না। কারণ লিডাররা এই সমস্ত সিচুয়েশন ফেস করেই অভ্যস্ত।
আবু সুফিয়ানকে নিয়ে আল আব্বাস সরাসরি নবীজীর (স) সামনে উপস্থিত হলেন।
এবং আবু সুফিয়ানকে দেখে নবীজী সরাসরি কিছু প্রশ্ন করলেন যে, আবু সুফিয়ান, তুমি কি এখনো বুঝতে পারছ না যে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই?
আবু সুফিয়ান বললেন, আমি নিশ্চিত। কারণ অন্য কোনো উপাস্য থাকলে আজ অবশ্যই আমার উপকারে আসত।
নবীজী : আমি আল্লাহর রসুল এই ব্যপারে এখনো কি তোমার মনে সন্দেহ আছে?
আবু সুফিয়ান : এই ব্যাপারে এখনো আমার কিছু সন্দেহ অবশ্যই আছে।
কারণ আসলে কাছের মানুষ তো, কাছের মানুষ বিশ্বাস করে সবচেয়ে দেরিতে।
যে এতদিন আমার সাথে ছিল এখন নবী হয়ে গেল কীভাবে? এটা একটা কথা হলো। একসাথে খাওয়াদাওয়া করেছি, ঘোরাফেরা করেছি। এ আবার কামেলিয়াত হাছিল করল কীভাবে?
মানে ঐ যে বলে না যে, পীর চিনে না গাঁয়ে, আর পুত চিনে না মায়ে।
আমরা মনে করি, মা ছেলেকে খুব ভালো বোঝে। কিন্তু মা ছেলেকে বোঝে মায়ের মতো করে, ছেলের মতো করে না।
তো যখন সে বলল যে, এই ব্যাপারে এখনো আমার কিছু সন্দেহ অবশ্যই আছে। তখন নবীজী (স) আর কথা বাড়ালেন না।
আব্বাসকে বললেন যে, আবু সুফিয়ানকে সাথে রাখো। সাথে রাখো মানেটা কী? এরেস্টেড।
ভদ্রভাবে এরেস্টেড।
কিন্তু আবু সুফিয়ানের অপর যে দুই সঙ্গী হাকিম ইবনে হিজাম এবং আপনার বুদায়েল দুজন সাথে সাথে ইসলাম গ্রহণ করে ফেলল। তারা বুদ্ধিমান ছিল যে, খামোখা দরকার কী ঝামেলার!
এবং এই বুদায়েল খোজা গোত্রের। বুদায়েলকে নবীজী (স) হুদায়বিয়া থেকে কোরাইশদের কাছে পাঠিয়েছিলেন তার দূত হিসেবে।
আবু সুফিয়ান রাত কাটান। তখন জানুয়ারি মাস। শীত তো বোঝেন তখনকার। সেই শীতের মধ্যে ফজরের সময় আবু সুফিয়ান দেখে যে মুসলমানেরা সব ওজু করছে ঠান্ডা পানি দিয়ে।
আবু সুফিয়ানের তো মাথা খারাপ হয়ে গেল। কারণ সে তো আর এই দৃশ্য দেখে নি।
আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলেন যে, এগুলো কী হচ্ছে? এবং ভয়ে কাঁপতে শুরু করল যে এই শীতের রাতে এরা হাত পা ধুচ্ছে ঠান্ডা পানি দিয়ে। মানে শীতে তার কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল।
তো আব্বাস বললেন যে, ওজু করছে নামাজের প্রস্তুতির জন্যে। এবং যখন নামাজ শুরু হলো, রসুলুল্লাহ (স) ইমামতি করছেন। পেছনে সবাই। নামাজের তো যে নিয়ম আবু সুফিয়ান তো নামাজও দেখে নি এরা আগে।
নবীজী (স) রুকুতে যাচ্ছেন, সব রুকুতে যাচ্ছে। নবীজী (স) সেজদায় যাচ্ছেন, সব সেজদায় যাচ্ছে। তখন আবু সুফিয়ান আব্বাসকে জিজ্ঞেস করল যে, মুসলমানেরা তাদের নবীকে এভাবে অনুসরণ করে? তিনি যা করছেন, তারাও তাই করবে?
আব্বাস বললেন যে, দেখো, নবী যদি বলেন যে, তোমরা এখন থেকে কিছু খাবে না, তাহলে সাথে সাথে ওরা খাওয়া বন্ধ করে দেবে।
তো আবু সুফিয়ান খুব বিস্ময়ের সাথে বলল যে, আমি কোনো রাজা বা সম্রাটের প্রতিও এমন আনুগত্য কখনো দেখি নাই।
আব্বাস আবার সংশোধন করে দিলেন যে, মুহাম্মদ রাজা নন, নবী।
এবং আবু সুফিয়ানের চিন্তার মোড় ঘুরে গেল অনুসারীদের ভালবাসা এবং আনুগত্যের নমুনা দেখে। তাছাড়া তিনি কার্যত তখন বন্দি। তার জীবন নির্ভর করছে নবীজীর (স) আঙুলি ইশারার ওপর।
এবং আবু সুফিয়ান খুব ঝানু ব্যবসায়ী ছিল এবং হিসাবী ব্যবসায়ী ছিল।
বদরের সংঘর্ষে আবু সুফিয়ানের এক ছেলে বন্দি হয়েছিল। তো আবু সুফিয়ান কিন্তু তাকে মুক্ত করেন নি। বলে, বন্দি হয়েছে তার জন্যে আমি আবার ১০ স্বর্ণমুদ্রা মুক্তিপণ দেবো? না, হবে না। ও এমনি ছাড়া পেয়ে যাবে। সে কিন্তু দেয় নাই।
ব্যবসায়ীরা অদ্ভুত চরিত্রের!
অবশ্য যারা পেশাজীবী তাদের চরিত্র অনেক সময় অদ্ভুত হয়।
অর্থাৎ যে যে প্রফেশনে থাকে, সে প্রফেশনটা তার জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর অর্থ যাদের দেবতা, অর্থের কাছে সন্তান বা অন্য কোনোকিছুই কিছু না।
তো আবু সুফিয়ান স্বাভাবিকভাবেই হিসাবনিকাশ করলেন এবং বুঝলেন যে, ধরেন যে-কোনো বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্যে দুটো শক্তি দরকার। একটা হচ্ছে সামরিক সামর্থ্য অথবা নৈতিক সামর্থ্য।
যে-রকম আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক সামর্থ্য ছিল না তখন। মুক্তিযুদ্ধে কিন্তু নৈতিক সামর্থ্য ছিল, নৈতিক শক্তি ছিল। যে কারণে তারা যুদ্ধ করতে পেরেছে।
আবু সুফিয়ান হিসাব করল যে, এই সামর্থ্য নাই। আর এরা যদি যুদ্ধ করতে করতে মক্কায় প্রবেশ করে, তার এতদিনের সাজানো বাড়িঘর সব বিনাশ হয়ে যাবে।
তো তার চেয়ে শান্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করে যদি সবকিছু রক্ষা করা যায় যে সবাই রক্ষা পাবে এবং কোরাইশদের নেতৃত্বও আমার হাতেই থেকে যাবে। হিসাবি মানুষ তো!
তো ফজরের নামাজ শেষ হলে আল আব্বাসের সাথে এসে আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করল। এবং নবুয়তের আগপর্যন্ত আবু সুফিয়ান নবীজী (স) ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ছিলেন। খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। অতএব তার মনস্তত্ত্ব নবীজী (স) খুব ভালোই জানেন কী হবে!
তিনি বুঝলেন, তাকে যদি বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয় তাহলে আত্মসমর্পণের কাজটা সে ঠিকভাবে করবে। অর্থাৎ আত্মসমর্পণ করার জন্যে, মক্কাবাসীদের বোঝানোর জন্যে যা যা করার করবে।
এবং চলে গেলেন।
দেখেন আসলে মনস্তত্ত্ব কি! তাকে প্রথমেই বললেন যে, কেউ আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে, সে নিরাপদ। যেহেতু সে ইসলাম গ্রহণ করেছে। আবু সুফিয়ানের মানে কি হলো? স্ট্যাটাসটা সৃষ্টি হলো।
আর আবু সুফিয়ান চাচ্ছিলেন সকল কোরাইশের নিরাপত্তা। তিনি বললেন প্রশ্ন করলেন, আমার ঘরে কয়জন ঢুকতে পারবে? তখন নবীজী (স) বললেন, যারা আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করবে, তারা নিরাপদ।
আবার আবু সুফিয়ানের প্রশ্ন : যে আল্লাহর ঘরে কতজন ঢুকতে পারবে?
তখন নবীজী (স) বললেন, যে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকবে, সে নিরাপদ। অর্থাৎ কেউ যদি অস্ত্র হাতে না বের হয়, ঘরে থাকে তাহলে সে নিরাপদ।
আবু সুফিয়ান বুঝল যে, হ্যাঁ, ঠিক আছে। এটা ঠিক আছে। এবং এখন যে আমি দ্রুত মক্কায় ফিরে যেতে চাই। মক্কায় ফিরে গিয়ে সে এটা বলবে ঘোষণা দেবে। কিন্তু নবীজী (স) তো বোঝেন।
নবীজী (স) বললেন যে, না। যেতে যেতে যদি আবু সুফিয়ানের মত আবার চেঞ্জ হয়ে যায় তাহলে তো মুশকিল। মানে নবীজী (স) দেখেন একজন মানুষ অর্থাৎ নিশ্চিত বিজয়, তারপরও শুধু রক্তপাত এড়ানোর জন্যে কত সতর্কতা!
তিনি আল আব্বাসকে বললেন যে, আবু সুফিয়ানকে নিয়ে উপত্যকার নিচে অবস্থান করেন। আমি না বলা পর্যন্ত আবু সুফিয়ান আপনার সাথে থাকবে। তো ব্যস, তিনি অবস্থান করছেন। এখন সব প্রস্তুত হচ্ছে।
তো উদ্দেশ্য হচ্ছে যে পুরো বাহিনী শক্তি সামর্থ্য সম্পর্কে যাতে আবু সুফিয়ান নিশ্চিত হয় যে, না এই বাহিনীকে মোকাবেলা করার মতন শক্তি কোরাইশদের নাই। তা না হলে যে-কোনো সময় মত চেঞ্জ হয়ে যেতে পারে।
আবু সুফিয়ান উপত্যকার পাদদেশে আল আব্বাসের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন। আর একের পর এক যাত্রা শুরু হয়েছে সকালবেলা। সব যাচ্ছে.. যাচ্ছে.. যাচ্ছে। মানে আবু সুফিয়ানকে আল আব্বাস গোত্রের নাম বলছেন, সংখ্যা বলছেন।
লাস্ট হচ্ছে নবীজীর (স) যে বাহিনীর সাথে আপনার ৭০০ এবং ৪০০০ আনসার এবং মোহাজের। যারা প্রত্যেকে শিরস্ত্রাণ এবং পূর্ণ সামরিক সাজে সজ্জিত। শুধু চোখ ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। সবুজ পোশাক। গ্রীন ডিভিশন।
তো আবু সুফিয়ান জিজ্ঞেস করছেন যে, এরা কারা? বললেন, এরা হচ্ছে মোহাজের এবং আনসার। এবং এদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহর রসুল।
এই বাহিনী দেখে আবু সুফিয়ানের চোখ ছানাবড়া। বলল যে, উনি তো ঝড়ের মতো মক্কা উড়িয়ে নিয়ে যাবে। এবং আব্বাসকে তিনি বললেন যে, তোমার ভাতিজা তো বিশাল বাহিনীতো যোগাড় করেছে। অনেক বড় রাজা হয়ে গেছে সে বিশাল বাহিনী জড়ো করেছে।
তো আব্বাস আবার মনে করিয়ে দিলেন–রাজা নন, নবী। হ্যাঁ হ্যাঁ নবী, বলেই সে ঘোড়া ছুটাল মক্কায়। মক্কায় তো উৎকণ্ঠা। নানান রকম গুজব সব লোকজন রাস্তায়। কী হবে, না হবে!
তো আবু সুফিয়ান যখন ছুটে গেল, চারদিক থেকে সবাই জড়ো হলো। এবং জড়ো হতেই চিৎকার করে বলল যে, ঐ একই কথা। যে তোমরা শোনো, মুহাম্মদ বিশাল বাহিনী এগিয়ে আসছে। তোমরা কোনোভাবে এর মোকাবেলা করতে পারবে না। তাদের কেউ কোনো বাধা দেবে না।
অতএব মনোযোগ দিয়ে শোনো–যে আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে, সে এবং এ শোনার সাথে সাথে তার স্ত্রী যে হিন্দা একবারে ছুটে এলো গোঁফ-দাড়ি ধরে চিৎকার করে বলল যে, কোরাইশরা তোমাদের এই মক্কার নেতা এটাকে হত্যা করো।
এখন চিন্তা করেন, আবু সুফিয়ানের কী অবস্থা? সে বলছে শোনো আর তার বউ তাকে ধরে বলছে যে, হত্যা করো বেইমান। তো আবু সুফিয়ানতো হিসাব করে ফেলেছে যে এই সময় তার কোনোকিছুই হওয়া যাবে না। সে মক্কার ত্রাণকর্তা হতে চায় এবং সে কোনোভাবেই নিবৃত্ত হওয়ার মানুষ না।
হিন্দাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে যে, হে কোরাইশরা! এই মহিলার কথায় বিভ্রান্ত হবে না। যে বাহিনী আসছে তা মোকাবেলা করার সামর্থ্য তোমাদের কারো নাই। খড়কুটার মতো উড়ে যাবে। অতএব আবারও বলছি, যে আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ।
চিৎকার করে উঠল মানুষজন যে, তোমার ঘরে আমরা কয়জন ঢুকব? তারপরে যে আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ। তারপরে ফাইনালি যে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে, সে নিরাপদ। পাবলিকের কাছেতো ক্লিয়ার হয়ে গেল যে কী করতে হবে!
এতক্ষণে সাধারণ বুঝল যে, কী করতে হবে। যে যার মতন ঘরে দৌড় দিল এবং ঘরের খিল বন্ধ করে দিল। মানে এই যে কৌশল। এই যে আবু সুফিয়ান মানে একটা লোককে কনভিন্স করা। তা না হলে কি হতো? রক্তপাত হতো। ২০০/৩০০/৪০০/৫০০ মানুষ মারা যেত।
তো এদিকে মার আল জাহরান থেকে বিশাল বাহিনী মক্কার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যখন জুতুবায় তারা পৌঁছল, নবীজী (স) তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
কারণ জুতুবা হচ্ছে একমাত্র এলাকা যেখানে মক্কা থেকে বাহিনী এসে তাদের প্রতিরোধ করতে পারে। যুদ্ধ তো সব জায়গায় করা যায় না। বিস্তৃর্ণ ময়দান। কারণ সামনাসামনি লড়াইয়ের এটা হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। একদম ফাঁকা। কেউ নাই।
এবার নবীজী (স) তার বাহিনীকে চারটা কলামে ভাগ করে ফেললেন এবং চার জনকে কমান্ডার করলেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ। তার ডিভিশন দক্ষিণ দিক থেকে। জোবায়ের ইবনে আল আওয়াম সেকেন্ড কমান্ড। তারা উত্তর দিক থেকে এবং এরা আল হাজুম একটা এলাকা সেখানে গিয়ে প্রথম পতাকা উত্তোলন করবে।
এবং জোবায়েরের প্রতি অর্ডার হলো যে, পতাকা উত্তোলন করে ওখানে অপেক্ষা করবে নবীর জন্যে। এবং তৃতীয় কলামের কমান্ডার হচ্ছে সাদ ইবনে ওবায়দা। এরা পূবদিক থেকে। আর চতুর্থ কলামের কমান্ডার হচ্ছেন আবু ওবায়দা। এরা পশ্চিম দিক থেকে।
এবং এই পশ্চিম দিক থেকে যে ডিভিশন, এর সাথে রসুলুল্লাহ (স) স্বয়ং থাকবেন। এবং লক্ষ্যটা খুব পরিষ্কার চারদিক থেকে প্রবেশ করে মক্কার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া। এবং কমান্ডারদের কঠিন নির্দেশ দেয়া হলো যে, কোনো রক্তপাত না।
তবে সব জায়গাতে কিছু মানে মাথা গরম লোকতো থাকে।
সাদ বিন ওবায়দা যিনি আনসারদের কমান্ডার এবং খাজরাজদের লিডার ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে ওবায়ের মৃত্যুর পরে। তিনি উত্তেজনার বশে বলেই ফেললেন যে, আজ চূড়ান্ত যুদ্ধের দিন মক্কা পর্যুদস্ত হবে।
চিন্তা করেন একটা বাহিনী কিন্তু যাত্রা করেছে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই সময় কমান্ডার চেঞ্জ করা কঠিন ব্যাপার। তো এই কথাটা যখন নবীজীর (স) কানে গেল, মুহূর্তে তিনি খবর পাঠালেন সাদ বিন ওবায়দার জায়গায় তার ছেলেকে কমান্ডার নিযুক্ত করে। তো তার পুত্র কায়েস ইবনে সাদ তাকে কমান্ডার নিযুক্ত করলেন, বাবাকে সরিয়ে দিলেন।
অর্থাৎ একজন মানুষ শান্তির জন্যে কতটা সচেতন থাকলে এটা সম্ভব। অন্য কমান্ডার হলে কী হতো? আচ্ছা দু-চারটা না হয়তো অতিরিক্ত মারবে। কী হবে তাতে? তো যুদ্ধের সময় বিজিতের অবস্থা তা-ই হয়। বিজিতের কোনো স্যা থাকে না।
তো তারা মক্কায় প্রবেশ করলেন। শুধু সেখানে আপনার আবু জেহেলের ছেলে ইকরিমা ইবনে আবু জেহেল, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া এবং সোহায়েল ইবনে আমর–এরা কিছু অনুসারীদের নিয়ে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল এবং পড়তো পড় খালিদের বাহিনীর সামনে। ওখানে দু-জন শহিদ হলেন।
আর পাল্টা আক্রমণ যখন খালিদ করলেন, তখন ১৩ জন কোরাইশদের পক্ষে মারা গেলেন। এই অবস্থা দেখে অনুসারীদের ফেলে সোহায়েল ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। আর ইকরিমা এবং সাফওয়ান দুই জন পালিয়ে গেলেন।
এবং এর মধ্যে নবীজী (স) জুতুবায় কিছুক্ষণ অবস্থান করে ভিন্ন পথে মালা এলাকায় গেলেন। এবং এই মালা এলাকা হচ্ছে নবীজীর (স) সমস্ত দুঃখের স্মৃতির জায়গাটা।
এই এলাকায় প্রথম যে শহিদ হয়েছিলেন সুমাইয়া এবং ইয়াসির। চরম নির্যাতন এখানে করা হয়েছে। বেলালের আর্তচিৎকার ছিল এই এলাকায় এবং তিন বছরের যে অবরুদ্ধ জীবন শিব আবু তালিব এই এলাকায়। এবং এদিকে দেখতে দেখতে এবং নিশ্চয়ই আসলে দোয়া করতে করতে সবার জন্যে হিন পাহাড়ের বিপরীতে আলহাজুম এলাকায় তিনি গেলেন।
এবং সেখানে পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক জোবায়ের অপেক্ষা করছিলেন পতাকা নিয়ে। নবীজী (স) পতাকা গাড়ার নির্দেশ দিলেন। এবং তাঁবু গাড়ার নির্দেশ দিলেন আলহাজুন। এবং মক্কাতে যে ১৯ দিন ছিলেন, তিনি এই তাঁবুতেই ছিলেন। তিনি মক্কায় তার যে ঘর ছিল যে ঘর থেকে সে ঘরে যান নি। তাবুতেই ছিলেন। সাথে তিন জন–স্ত্রী উম্মে সালামা, মায়মুনা এবং কন্যা ফাতেমা।
এবং এই আল হাজুনে তিনি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন। কারণ এখানেই বিবি খাদিরজা শায়িত ছিলেন। সেখানে তাকে দাফন করা হয়। এবং সেখানে দীর্ঘক্ষণ তিনি সেখানে কাটালেন।
তো আসলে স্বাভাবিকভাবেই বিজয়ের সময় কিন্তু বিজয়ীর কিছুই মনে থাকে না। কিন্তু সে-সময়ও তিনি কী করতে পারেন নি?
তার যে স্ত্রী খাদিজা, তার যে সঙ্গ যখন তিনি নিজেও দ্বিধান্বিত ছিলেন যখন হেরা গুহাতে ওহি এলো, ভীত আতঙ্কিত ছিলেন যে কোনোকিছুর আছর হলো কিনা তার ওপরে, সে-সময় এই নারী বলেছিলেন, আমি বিশ্বাস করছি আপনি আল্লাহর রসুল। অর্থাৎ কতটা ভরসারস্থল ছিলেন তিনি। সেখানে দীর্ঘসময় কাটালেন এবং স্বাভাবিকভাবে অনেক কিছুই মনে হয়েছে তখন তার।
সেই নারীর ত্যাগ, সেই নারীর অবদান এবং অনেক কিছু। তারপরে ফিলে এলেন তাঁবুর কাছে এবং মক্কার দিকে তাকাচ্ছেন কাবা সব দেখা যাচ্ছে। তার অনুসারীরা সব তখন সমস্থ মক্কার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে।
এবং যখন রাস্তায় কোনো মারামারি চিল্লাচিল্লির শব্দ নাই, স্বাভাবিকভাবেই মানে মোহাজের যারা ছিল, তাদের পরিবার পরিজন যারা ছিল, তারা আগে বেরিয়ে আসল। আচ্ছা কী হচ্ছে দেখি! এবং তাদের পরিবার পরিজনের পেছনে যারা গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিন্তু প্রকাশ্যে বলে নাই তারাও আল্লাহু আকবার বলে মানে আল্লাহ মহান বলে বেরিয়ে এলো।
এবং তারপরে আস্তে আস্তে যখন দেখল যে, রাস্তাঘাট নিরাপদ তখন যারা পৌত্তলিক ছিল, তারা বেরিয়ে এলো যে আচ্ছা কী হচ্ছে দেখি। এবং মক্কার রাস্তায় আস্তে আস্তে লোক লোকালয় মানে আস্তে আস্তে লোকজন বাড়তে লাগল। কাবার চারপাশে ভিড় জমে উঠল।
এবং নবীজী (স) যখন দেখছেন স্বাভাবিকভাবেই কৃতজ্ঞতায় তার চোখ ছলছল করে উঠল। তিনি উটের পিঠে উঠলেন। এবং নবীজী (স) যে ক্রীতদাসকে মুক্ত করেছিলেন, তার ছেলে ওসামাকে ওঠালেন পেছনে।
এবং যখন তিনি উটের পিঠে উঠে উট চলা শুরু করল, তার চোখ তখন অশ্রুসিক্ত, মাথা অবনত। কেন? রক্তপাত ছাড়া মক্কায় প্রবেশ করে মক্কা মুক্ত করার যে দোয়া তিনি করেছিলেন আল্লাহ তা কবুল করেছেন।
এবং পুরনো সত্যকে তিনি নতুন করে উপলব্ধি করলেন যে, আল্লাহই হচ্ছে চূড়ান্ত শক্তি এবং আল্লাহই হচ্ছে চূড়ান্ত সত্য। তার ওপরে কোনো সত্য নাই এবং তার ওপরে কোনো শক্তি নাই। এবং কোনো বিজয়ী বা কোনো ত্রাণকর্তা, কোনো পরিত্রাতা যখন এই মাথা নত করে বিজিত শহরে কখনো প্রবেশ করে নি। এবং তিনি রাজা ছিলেন না, সেনাপতি ছিলেন না, সেনানায়ক ছিলেন না, তিনি নবী ছিলেন। এইজন্যেই সম্ভব হয়েছে।
এবং কাবা প্রাঙ্গনসহ সর্বত্র তখন আল্লাহ মহান ধ্বনি। এবং আস গোত্রের আনসার মুহাম্মদ ইবনে মাসালামা নবীজীর (স) উটের রশি ধরলেন। নবীজী (স) উটের পিঠে বসেই তাওয়াফ করলেন এবং তারপরে উট থেকে নেমে মাকামে ইব্রাহিমে দুই রাকাত নামাজ পড়লেন।
তারপর ওসমান ইবনে তালহা তাকে কাবার চাবি আনতে বললেন। কাবার চাবি আনলে তিনি দরজা খুলে দিলেন। তারপরে বাইরে এসে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নাই।
একইভাবে গর্ব অহংকার প্রতিশোধ বা অগ্রাধিকারের সবধরনের চর্চা তিনি বিলুপ্ত করলেন। কোরাইশদের যে বংশের অহংকার সে অহংকারকে ধূলিসাৎ করে বললেন যে, আল্লাহ এগুলোকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। জাহেলিয়াতকে ধূলিসাৎ করেছেন এবং সব মানুষ সমান। সবাই আদমের সন্তান। এবং আদম মাটি থেকে তৈরি।
এবং সূরা হুজরাতের সেই ১৩ নম্বর আয়াত তিনি পাঠ করলেন।
‘হে মানুষ! তোমাদেরকে আমি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং বিভিন্ন সমাজ ও জাতিতে ভাগ করেছি, যেন তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পারো। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে বেশি আল্লাহ-সচেতন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব জানেন এবং সব বিষয়ে সচেতন।’
অর্থাৎ ওনার শিক্ষার চূড়ান্ত সত্য হলো- সব মানুষ সমান। মানুষের মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব শুধু তার গুণের। বংশের নয়, রক্তের নয়, অর্থের নয়, কোনোকিছুর নয়।
এবং এরপরে তিনি মক্কাবাসীদের দিকে তাকিয়ে বললেন যে, হে কোরাইশরা! তোমরা আজ আমার কাছ থেকে কী ব্যবহার প্রত্যাশা করো? কী আচরণ প্রত্যাশা করো?
সব চুপ। কী বলবে? মাথা নিচু। কিন্তু একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো বেশ কিছুক্ষণ পরে সোহায়েল ইবনে আমর। কবি ছিলেন, বাগ্মী ছিলেন, বক্তা ছিলেন। তিনি যে আপনি আমাদের মহানুভব ভাই এবং ভ্রাতুষ্পুত্র। আপনার কাছ থেকে আমরা শুধু ভালো আচরণই প্রত্যাশা করি।
তো নবীজী বললেন যে, ঠিক আছে। আজ তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দেয়া হলো। এবং সাধারণ ক্ষমা। আসলে এটা খুব কঠিন কাজ। যারা কাবা প্রাঙ্গনেই এমন কোনো অত্যাচার নাই তার ওপরে করে নি। প্রহার থেকে শুরু করে, থুথু দেয়া, উটের নাড়িভূঁড়ি সেজদারত অবস্থায় মাথার ওপর ফেলা থেকে শুরু করে, গালিগালাজ থেকে শুরু করে।
সামনে তাদের দেখছেন ক্ষমা করা বলা যত সহজ, যার জীবনে এধরনের ঘটনা রয়েছে তার পক্ষে ক্ষমা করা খুব কঠিন কাজ। যে কারণে আমি সবসময় বলি যে, মুহাম্মদ (স)-এর তুলনা একমাত্র মুহাম্মদ (স)-ই। তার কোনো তুলনা নাই।
পরিবারের কী হলো? আবু জেহেল, আবু লাহাব, উমাইয়া–এদের পরিবারের কী হলো?
ধরুন, যে কোনো বিপ্লব সমাজ বিপ্লব যেখানে হয়েছে যখন সমাজ বিপ্লব সফল হয়েছে, তার আগের সমাজের কর্তৃত্বশীল যারা ছিল তারা সমূলে বিনাশ হয়েছে। এটাই হচ্ছে সমাজ বিপ্লব বলেন, সামরিক বিপ্লব বলেন, যে-কোনো বিপ্লবের এটা হচ্ছে ধারা।
কিন্তু কারণ তাদেরকে মনে করা হয় যে, এরা বিপ্লবের শত্রু। এরা আগের ঘারানার। কিন্তু নবীজীর (স) সাফল্য কোথায়? তার এই অহিংস রণকৌশল, অহিংস রণনীতি, যা পৃথিবীতে একবার-ই প্রয়োগ হয়েছে, দ্বিতীয়বার আর কেউ প্রয়োগ করে নি। কারণ এটা খুব কঠিন কাজ। তিনি সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন। এবং সবাইকে মিত্রে পরিণত করলেন।
আপনি দেখেন দ্বিতীয় দিন থেকে শুরু হলো। সাফা পাহাড়ে নবীজী (স) বসলেন। দলে দলে সব আসছে বায়াত হওয়ার জন্যে। মহিলারা আসছে বায়াত হওয়ার জন্যে। আসলে কী মানুষ ছিলেন তিনি!
এক বৃদ্ধা আসছে। খুব সাধারণ মহিলা। সে তো শুনেছে যে নতুন রাজা এসেছে। রাজার সাথে দেখা করে মানে তাকে আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। তো সে কাছে এসে ভয়ে থর থর করে কাঁপছে।
নবীজী (স) তাকে বললেন যে, মা তুমি কাঁপছ কেন? তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তো তোমার মতোই এক নারীর গর্ভে লালিত হয়েছি। বসো। মানে কত মমতা!
আবু বকর তার বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে এসছেন। বাবা চোখেও দেখেন না এই অবস্থা। আবু বকরের বাবা বুঝতে পারছেন। তিনি আবু বকরের ওপরে বিরক্ত হলেন, আবু বকর তুমি ওনাকে নিয়ে এসেছ কেন? আমার উচিৎ তার কাছে যাওয়া।
আবু বকর বললেন যে, না, তার উচিৎ আমার বাবার উচিৎ হচ্ছে নবীর কাছে আসা। নবীজী (স) তাকে পাশে বসালেন। নিজের চাদর দিয়ে তার মুখ মুছিয়ে দিলেন। তারপরে বললেন যে, ধর্মগ্রহণ করার জন্যে। অর্থাৎ মানুষের প্রতি এই যে সম্মান, এই যে মর্যাদা।
আমরা যদি মানুষকে সম্মান করতে না পারি আরেকজন মানুষকে, তাহলে আমরা আমাদের নবীর উম্মত নই। এই সম্মান করাটা হচ্ছে সম্মানের শিক্ষাতো তিনি দিয়েছেন। তিনি বিজয়ী। পরাজিত শহরে প্রবেশ করেছেন। বিজিত শহরে প্রবেশ করেছেন।
তার একটা আঙুলের ইশারায় প্রত্যেকের জীবন নির্ভর করছে। সেখানে তিনি তাকে বসিয়ে তার কি করছেন? নিজের চাদর দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিচ্ছেন। বয়স্ক মানুষ তো। রোদের মধ্যে আসছে। ঘেমে গেছে।
হিন্দা চলে আসেছে। কারণ হিন্দাতো আসলেতো মানে তার বাবা বুদ্ধিমান আরকি। বুদ্ধিমান বাবার মেয়ে তো! তারপরে আবার এরকম এরকম মানে কৃপণ ধুরন্দর স্বামীর স্ত্রী। তো চলে আসছে চাদর জড়িয়ে যাতে চেহারা দেখতে না পারে।
তো যখন মানে তিনি বায়াত হচ্ছেন, প্রশ্ন… তার কণ্ঠস্বর শুনে নবীজী (স) চিনে ফেলেছেন। কারণ কণ্ঠস্বর শুনে চিনে ফেলেছেন। নবীজী (স) কি করলেন? ক্ষমা করে দিলেন। মানে প্রিয় চাচার হত্যাকারী শুধু না, হত্যার পরে কি করা হয়েছিল? কলিজা চিবিয়েছিল। তাকে ক্ষমা করে দিলেন।
তো সাফা পাহাড়ে একের পর এক ক্ষমার ইতিহাস সৃষ্টি হতে শুরু করে। এবং যারাই ক্ষমার জন্যে এসেছে জান-ই দুশমন। নবীজী প্রত্যেককে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
যারা নবীজীর (স) বিরোধী ছিলেন ১১টা পরিবার, যারা লিডিং পরিবার বিরোধিতায় প্রত্যেক পরিবার নবীজীর (স) সমাজবিপ্লবের অংশ হয়ে গেলেন।
আবু জাহেলের ছেলে ইকরিমা। ইকরিমার স্ত্রী এসে বায়াত হলেন। ইসলাম গ্রহণ করলেন। এরপর ইকরিমার জন্যে ক্ষমা চাইলেন। এবং তার নিরাপত্তার আবেদন জানালেন।
নবীজী (স) মঞ্জুর করে দিলেন। ইকরিমা এবং সাফওয়ান এই দু-জন যখন দেখল যে, আর পারছে না। পালিয়ে গিয়েছে ঘোড়া নিয়ে। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে লোহিত সাগরে গিয়ে সমুদ্রের ঐ পাড়ে চলে যাবে।
তো ইকরিমার স্ত্রী একজন দাসকে নিয়ে ছুটল স্বামীর পেছনে যে তাকে ধরা যায় কিনা! এবং জাহাজে ওঠার আগেই ইকরিমার স্ত্রী গিয়ে ইকরিমাকে ধরে ফেলল। এবং ধরে ফেলে বলল যে, তুমি চলো। তোমাকে নবীজী (স) ক্ষমা করেছেন এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা করেছেন।
ইকরিমা স্ত্রীর সাথে মক্কায় ফিরে এলেন। নবীজী (স) বসা ছিলেন। তাকে দেখে আনন্দের আতিশায্যে তার দিকে এত দ্রুত উঠে এগিয়ে গেলেন যে, গায়ের যে চাদর ছিল, চাদরও পড়ে গেল।
এবং দুহাত বাড়িয়ে তাকে বুকে ধরলেন এবং বললেন যে, ইকরিমা, আজকে তোমার কোনো চাওয়াই অপূর্ণ থাকবে না। ইকরিমা ইসলাম গ্রহণ করলেন। বায়াত হলেন এবং দোয়া চাইলেন আল্লাহ যেন আমাকে ক্ষমা করে দেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন, যে এখন থেকে ইসলামের জন্যে আগে যা বিরোধিতা করেছেন এবার দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে কাজ করবেন।
এবং সে-সময় নবীজী (স) সাহাবীদেরকে বললেন যে, ইকরিমা ইসলাম গ্রহণ করেছে। অতএব তোমরা কেউ তার বাবার নিন্দা করবে না। এবং তিনি বললেন যে, মৃতের নিন্দা শুধু জীবিতকেই কষ্ট দেয়। মৃতের যা হওয়ার তো হয়ে গেছে। কিন্তু তার নিন্দা জীবিতদের কষ্ট দেয়।
এবং এই ইকরিমা নবীজীর (স) এই সমমর্মিতায় হতবাক হয়ে গেলেন! কারণ এটাতো কোনো কোনো বিজিত বিজয়ীর কাছ থেকে এটা কখনো প্রত্যাশা করে? হতবাক হয়ে গেলেন। এন্ড ইকরিমা ওয়াজ এ চেইঞ্জড ম্যান।
এরপরে রিদ্দার যুদ্ধ যেটাকে আমরা বলি যে, ভণ্ডনবীদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ সে যুদ্ধে ইকরিমা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এবং ইয়ারমুকের প্রান্তরে, রোমানদের সাথে যে যুদ্ধ হলো, সে যুদ্ধে তিন সৈনিকের যে ঘটনা যে, যে পানি আহত মৃত্যুপথ যাত্রী তিন সৈনিক সে অবস্থায় বলছে যে–পানি।
পানি নিয়ে এসেছে একজন। পানি এর মধ্যে আরেকজন পানি বলে আর্তনাদ করছে। প্রথম জন বলছে যে, ওর পানির প্রয়োজন বেশি। ওকে আগে দাও। দ্বিতীয় জনকে যখন পানি দিতে যাবে, তৃতীয় জন আর্তনাদ করে উঠেছে পানি। ওর প্রয়োজন বেশি তাকে দাও এবং তৃতীয় জনের সময় আবার প্রথম জন আর্তনাদ করে উঠল পানি।
কিন্তু তার কাছ পর্যন্ত আসতে আসতে শেষ তার প্রাণ বেরিয়ে গেল। এবং তিনজনই শেষ! এবং এই তিনজনের একজন হচ্ছেন এই ইকরিমা। একটা দুর্ধর্ষ মানুষ কত চেঞ্জ হয়ে যেতে পারে।
আসলে নবীদের, মহামানবদের জীবন তারা পরশ পাথর। তাদের স্পর্শে যারাই গিয়েছে তারা চেঞ্জ হয়ে গেছে। আগের মানুষ আর পরের মানুষ। তো এই হলো আবু জেহেলের পরিবার এবং তার ছেলে।
এবং আবু জাহেলের পরিবারের আর যারা ছিলেন তার ভাই সালামা ইবনে হিশাম, আয়াশ ইবনে আবি রাবিয়া, হারিস ইবনে হিশাম, খালিদ ইবনে হিশাম, আব্দুল্লাহ ইবনে আবি রাবিয়া ইসলাম গ্রহণ করেন। তার মা আসমা বিনতে মুখাররিবাত, পুত্র ইকরিমা কন্যা জামিলা ও হুনফা ইসলাম গ্রহণ করেন।
অর্থাৎ পুরো পরিবার আবু জেহেলের পুরো পরিবার ইসলাম গ্রহণ করল।
এবং সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া। সাফওয়ানের কথা সিরাত যখন পড়েছেন নিশ্চয়ই মনে আছে যে, বদর যুদ্ধে তার বাবা উমাইয়া মারা যান। এবং প্রতিশোধ নেয়ার মানসে এই সাফওয়ান তার বন্ধুকে পাঠিয়ে ছিলেন নবীজীকে (স) হত্যা করার জন্যে।
এবং সে বন্ধু উমায়ের মহানবীর মহানুভবতায় ইসলাম গ্রহণ করে ফেলেছেন হত্যা করতে গিয়ে। এবং যখন মক্কায় নবীজী (স) প্রবেশ করছেন তখন ঐ বন্ধু উমায়ের সাফওয়ানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে নবীজীর (স) কাছে আবেদন জানালেন। নবীজী (স) আবেদন পূরণ করলেন এবং সাথে যে পাগড়ি পরে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন, সে পাগড়ি দিয়ে দিলেন নিশ্চয়তার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা হিসেবে।
তো উমায়ের সাফওয়ানকে পাকড়াও করল গিয়ে সেই জাহাজে ওঠার আগে এবং তাকে নিয়ে এলো। এবং নবীজী তখন যখন নিয়ে এলো, নবীজী তখন আসরের নামাজের ইমামতি করছেন। নামাজ যখন শেষ হলো, তখন নবীজীর (স) উদ্দেশ্যে খুব জোরে জোরে বললেন যে, উমায়ের আমার কাছে এসেছে এবং পাগড়ি দেখিয়ে বলেছে যে আপনি আমাকে নিশ্চয়তা দিয়েছেন এখানে আসতে বলেছেন, সাফওয়ান কিন্তু তখনো ঘোড়ার পিঠে। মানে সে নিশ্চিত নয় অবস্থা যদি বেগতিক দেখে যাতে ঘোড়া ছুটিয়ে পালাতে পারে।
তো নবীজী (স) তাকে বললেন যে, তুমি নামো। আসো নামো। বলল যে, না, আগে একথা ঠিক কিনা আমি জানতে চাই। বলছেন উমায়ের যা বলেছে ঠিক বলেছে। তো এবং এরপরে যাইহোক আমি সবকিছু বিবেচনা করার জন্যে দুই মাস সময় চাই।
নবীজী (স) বললেন, তোমাকে চার মাস সময় দেয়া হলো। তুমি চিন্তা করো। এবং সাফওয়ান ফ্রি ম্যান মুক্ত মানুষ। তার ইসলাম গ্রহণ করতে হয় নাই।
নবীজী (স) মক্কা বিজয়ের পরেও ইসলাম গ্রহণ করার ব্যাপারে কাউকে কোনো চাপাচাপি করেন নাই। তিনি কি বলেছেন? কাবাঘরকে মূর্তি প্রতিমা প্রতিকৃতি এগুলো থেকে মুক্ত করেছেন। মক্কার যে সমাজ পরিবেশ, যেখানে দৃশ্যমানভাবে মূর্তি ছিল, সেগুলোকে তিনি অপসারণ করেছেন।
এবং তার অনুসারীরা যারা এতদিন পর্যন্ত গোপনে অনুসারী ছিল কিন্তু ঘরে মূর্তি রেখে দিত যে যাতে কেউ বুঝতে না পারে, ঠাহর করতে না পারে যে, সে মুসলমান হইয়া অনুমান করতে না পারে। তাদেরকে বলেছে যে, তোমাদের পারিবারিক, ব্যক্তিগতভাবে যা মূর্তি আছে এগুলো তোমরা সব ফেলে দাও।
কিন্তু কোনো পৌত্তলিককে বলেন নাই। তারা তাদের পারিবারিক ঘরে পরিমণ্ডলে তারা সবসময় ফ্রি ছিল। তারা বিশ্বাস অনুসারে মূর্তিপূজা অর্চনা উপাসনা সবকিছু করার জন্যে।
এবং তারপরে আবু লাহাব। নবীজীর (স) চরম নির্যাতনকারী আবু লাহাবের দুই পুত্র উতবা এবং মুয়াত্তিম (উতাইবা?)। তিন কন্যা দুররা আরজা ও খালেদা ইসলাম গ্রহণ করেন। এবং চাচা আব্বাসকে নবীজী (স) বলেন যে, উতবা এবং মুয়াত্তিমকে নিয়ে আসার জন্যে। কারণ তারাতো তখন মানে ভীতসন্ত্রস্ত যে কী হবে!
নবীজীর (স) প্রতি তাদের আচরণ খুবই খারাপ ছিল এবং আবু লাহাবের দুই পুত্রের সাথে নবীজীর (স) দুই কন্যার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু নবীজী (স) নবুয়ত প্রাপ্তির কথা জানতে পারার পরে আবু লাহাব সে বিয়ে ভেঙে দেয়।
এবং আর নবীজী (স) এই দুই পুত্রকে দুই হাতে ধরে কাবার দরজায় নিয়ে যান এবং তাদের জন্যে দোয়া করেন। এবং উতবা এবং মুয়াত্তিম দুজনই সত্যের সৈনিক হিসেবে ইয়ারমুকে রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা শহিদ হন।
এবং ওয়ালিদ বিন ইবনে মুগিরা। তার তিন পুত্র ওয়ালিদ, খালিদ এবং হিশাম। সবাই ইসলাম গ্রহণ করে। ওয়ালিদের স্ত্রী লুবাবা তিন কন্যা ফাকিতা ফাতিমা ও আতিকা ইসলাম গ্রহণ করে। এবং ওয়ালিদ ইবনে মুগিরার বোন উম্মে হাবিবা নবীজীর (স) জীবন সঙ্গিনী হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেন।
উতবা ইবনে খালফ। যারা বদরের যুদ্ধে যেয়ে ১১ জন কোরাইশ সমাজপতি নিহত হয়ে ছিলেন তার পরিবার। যারা সবসময় বিরোধিতা করেছিল। মক্কা মুক্ত হওয়ার পরে তাদের বংশধররা সবাই ইসলাম গ্রহণ করে।
উতবা ইবনে রাবিয়ার তিন পুত্র আবু হুজাইফা, আবু হাশিম ও ওয়ালিদ এবং চার কন্যা ইসলাম গ্রহণ করেন। উমাইয়া ইবনে খালাফ খালাফ। তার স্ত্রী ফাকিতা, তার চার পুত্র আয়লা, আব্দুর রহমান, রাবেয়া ও সাফওয়ান তারা ইসলাম গ্রহণ করেন।
তো নজর ইবনে হারিস। নবীজী (স) যেখানে যেতেন নজর পেছনে পেছনে সর্বসম্মুখে তাকে গালিগালাজ ও অপমান করতে করতে যেতেন এবং নবীজীর (স) কথা যাতে শুনতে না পায় শ্রোতারা সে ব্যবস্থা করতেন। তার তিন পুত্র আতাক, কিরাস ও নজির এবং দুই কন্যা কুতায়লা ও আন নাদরাত এবং ভাই নুজায়েল ইসলাম গ্রহণ করলেন।
অর্থাৎ প্রতিটি পরিবার কোরাইশদের সম্ভ্রান্ত নেতাদের প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা নবীজীর (স) বিপ্লবের সঙ্গী হয়ে গেলেন।
অর্থাৎ একজন মানুষ কত মানবিক হলে, কত অহিংস হলে, কত করুণার আঁধার হলে, কত দয়ামায়া সমমর্মিতায় ভরপুর হলে তার এই জান-ই দুশমনদের, তাদের সন্তানসন্ততিদের এভাবে ক্ষমা করে নিজের বুকে আশ্রয় দিতে পারেন। এবং এটা শুধু আল্লাহর রসুলের পক্ষেই হয়তো সম্ভব।
আসলে তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে যে নিজির স্থাপন করে গেছেন তিনি শুধু তত্ত্ব কথা বলেন নাই। তিনি যা বলেছেন, নিজের জীবনে সেই জিনিসগুলো করে গেছেন। এবং যে কারণে তার চিন্তা, তার ভাবনা, তার চেতনা ক্রমপ্রবাহমান।
যে কারণে তিনি সেই সময় যে-রকম আধুনিক ছিলেন, এখনো আধুনিক এবং আগামী প্রজন্মের জন্যে, তারপরের প্রজন্মের জন্যেও তিনি আধুনিকই থাকবেন। আমরা তার প্রতি দরুদ এবং সালাম প্রেরণ করি।
নবীজীর (স) সাথে এই বাহিনীতে যারা আসছিল বেদুইনরা, বেদুইনরাতো এই প্রত্যাশায় আসছিল যে–মক্কায় যুদ্ধ হবে। যুদ্ধ হওয়ার পরে কি হবে? লুট হবে। অতএব লুটের মাল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যাবে।
কিন্তু যুদ্ধ হলো না, লুট হলো না। এখন কী হবে? নবীজী (স) মক্কায় যে ব্যাংকার যারা ছিল, লগ্নীকারক ছিল তাদের কাছ থেকে টাকা ধার করলেন যে তোমরা আমাকে টাকা ধার দাও। এই সৈনিকদের কি দিতে হবে? তারা যে এসছে তাদের খরচাপাতি দিতে হবে।
অন্য বিজয়ী হলে কী বলত? এই অমুক এত কোটি অমুক এত কোটি। তমুক এত কোটি। আরে কোটি কি কোটির ওপর কোটি এনে জানে বাঁচা। না তিনি ঋণ করলেন। ঋণ করলেন। ঋণ করে এই সৈনিকদেরকে খরচা দিলেন। কিন্তু প্রতিহিংসার কোনো আগুন বইতে দিলেন না।
এবং আরো কী করলেন? মোহাজের যারা, যারা তাদের ধনসম্পত্তি মক্কায় রেখে চলে গিয়েছিল, এগুলো তো ১০ বছরে সব বেদখল করেছে। অন্যেরা সব ভোগ দখল করছে। এবং তিনি খুব পরিষ্কার বললেন যে, কোনো মোহাজের ফেলে যাওয়া সম্পত্তির দাবি করতে পারবে না। যে দাবি করবে তার হিজরত বাতিল হয়ে হয়ে যাবে।
এবং কোনো মোহাজের তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির কিছু দাবি করে নাই। অর্থাৎ অশান্তি হতে পারে, সমস্যা হতে পারে, ঝগড়া হতে পারে, বিবাদ হতে পারে এই ভেবে। কারণ যদি এই সম্পত্তির দাবি থাকত তাহলে দীর্ঘস্থায়ী বিবাদের সূত্রপাত হতো। কারণ সম্পত্তি তো কেউ ছাড়তে চায় না।
মোহাজেরদের বললেন, যে সম্পত্তি চাইবে তার হিজরত কবুল হবে না। হিজরত বাদ এবং কেউ দাবি করে নাই। সবাই আবার কি করল? সবাই আবার যারা হিজরত করেছিল তারা আবার নবীজীর (স) সাথেই চলে গেল। তারা কেউ মক্কায় আর ফিরে আসেন নি।