1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
  2. [email protected] : adminbackup :
বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ১২:৫৩ পূর্বাহ্ন

শামস আল তাবরিজ প্রণীত ভালোবাসার ৪০ সূত্র

  • সময় শুক্রবার, ৮ মার্চ, ২০২৪
  • ৪৬১ বার দেখা হয়েছে

সূত্র ১

আমি যেমন তেমন করেই নিজের মধ্যে প্রতিফলিত দেখতে পাই আমার ঈশ্বরকে। ঈশ্বর যদি আমার মধ্যে অধিকাংশ সময় ভয় আর দোষারোপ পয়দা করে তবে বুঝতে হবে আমাদের অন্তর ভরে আছে অনেক ভয় আর দোষে। যদি আমরা ঈশ্বরকে ভালোবাসা আর মায়ায় পূর্ণ দেখি, তাহলে বুঝতে হবে আমরাও ভালোবাসা আর মায়ায় পূর্ণ।

সূত্র ২

সত্য পথ হৃদয়ের শ্রমের ফসল, মগজের নয়। হৃদয়কে তোমার প্রধান পথপ্রদর্শক করো। তোমার বুদ্ধিকে নয়। মিলিত হও, মোকাবিলা করো এবং শেষতক জয়ী হও নফসের* বিরুদ্ধে তোমার হৃদয় দিয়েই। নিজের অহংকে জানতে পারলেই তুমি পৌঁছে যাবে ঈশ্বর-জ্ঞানের পথে।

‘নফস’ আরবি শব্দ যার অর্থ হলো আত্মা, মন, অহং কিংবা আমিত্ব। কোরান শরীফের একাধিক সুরায় ‘নফস’ শব্দকে নানাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে ‘নফস’ বলতে আত্মবোধ এবং আত্মসিদ্ধান্তকেই বোঝানো হয়েছে বেশিরভাগ সময়। সকল কর্মের পেছনে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা বা প্রবণতাই ‘নফস’। সোজা কথায় নফসের কারণেই মানুষ সব করে। কিন্তু সুফিবাদে ‘নফস’ ভালো কোন শব্দ নয়। সুফিবাদে ‘নফস’ হলো অহংবোধ। এই বোধ কাম্য নয়। শিয়া ও সুফিদের কাছে ‘নফস’ আদতে নিম্মশ্রেণীর অহং, যা পাশবিক এবং শয়তানের নিকটস্থ সত্তা।

সূত্র ৩

মহাবিশ্বের সবকিছুতে এবং সবার মাঝেই তুমি ঈশ্বর চর্চা করতে পারবে। কেননা, ঈশ্বর স্রেফ কোন মসজিদ, সিনাগগ* কিংবা চার্চের মধ্যে বন্দী থাকেন না। তবু এরপরও যদি একান্তই তোমার জানার দরকার হয় যে তাঁর সঠিক আবাস কোথায়, তাহলে জেনে নাও, একটি মাত্র জায়গায় তাকে খুঁজতে হবে; আর সেটি হলো সত্যিকারের প্রেমিকের হৃদয়ে।
ঈশ্বর বাস করেন সত্যিকারের প্রেমিকের হৃদয়ে। যেখানেই ভালোবাসা, সেখানেই ঈশ্বর। ঈশ্বরকে জানতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই হৃদয় থেকে আসা ভালোবাসার কণ্ঠকে চিনতে হবে।

সূত্র ৪

বুদ্ধি আর প্রেম আলাদা উপকরণে তৈরি। বুদ্ধি মানুষকে এক বাঁধনে বাঁধে আর তাতে কোন ঝুঁকি নেই, কিন্তু প্রেম সব জটকে গুলিয়ে ফেলে আর তাতে পুরোটাই ঝুঁকি আছে। বুদ্ধি সদাই সতর্ক আর পরামর্শ দেয়, ‘অত্যধিক ভাবাবেশ থেকে সাবধান’ আর প্রেম কেবল বলতে থাকে, ‘আহা, একদম ভেবো না! ঝাঁপিয়ে পড়ো!’ বুদ্ধি সহজে ভেঙে পড়ে না, অথচ প্রেম অনায়াসে নিজেকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলে। তবে গুপ্তধন লুকিয়ে থাকে ধ্বংসস্তুপেই। একটি ভগ্ন হৃদয়েই গুপ্তধন লুকানো থাকে।

সূত্র ৫

দুনিয়ার অধিকাংশ সমস্যাই ভাষাগত ভুল কিংবা সাধারণ ভুল বোঝাবুঝি থেকে হয়। কখনোই শব্দকে নেহাত তার আক্ষরিক অর্থে ধরো না। যখন তুমি ভালোবাসার সীমানায় পা রাখো, আমরা যেমত জানি, ভাষা তখন অচল হয়ে যায়। যা ভাষায় ধারণ করা যায় না তা কেবল নিরবতায় করায়ত্ত করা যায়।

সূত্র ৬

একাকীত্ব আর নির্জনতা দুটো আলাদা বস্তু। যখন তুমি একা তখন নিজেকে সহজেই এই বিশ্বাসে ভোলাতে পারবে যে তুমি ঠিক পথেই আছো। নির্জনতা আমাদের জন্য উত্তম, কেননা তা আদতে একা হয়েও একাকীত্বের অনুভূতি দেয় না। তবে তারপরেও সর্বোত্তম হলো এমন একজন সঙ্গীকে খুঁজে বের করা যে হবে তোমার আয়না। মনে রেখো, কেবল অন্য আরেকজনের অন্তরেই তুমি সত্যিকারের তোমাকে দেখতে পাবে এবং তোমার মধ্যে থাকা ঈশ্বরকে দেখতে পাবে।

সূত্র ৭

তোমার জীবনে যা কিছু ঘটুক না কেন, যতো ঝামেলার ব্যাপারই মনে হোক না কেন তা, কখনো হতাশার আশেপাশেও যেও না। এমনকি যখন সকল দরজা বন্ধ হয়ে যায়, ঈশ্বর স্বয়ং তোমার জন্যই নতুন পথ খুলে দেবে। কৃতজ্ঞ থাকো। যখন সব কিছু ভালো আছে তখন কৃতজ্ঞ হওয়া সহজ। একজন সুফি শুধু যা কিছু দেয়া হয়েছে তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকে না বরং যা কিছু দেয়া হয়নি তার জন্যও কৃতজ্ঞ থাকে।

সূত্র ৮

সহনশীলতা মানে নিষ্ক্রিয়ভাবে সহ্য করে যাওয়া নয়। এর অর্থ হলো কার্যধারার শেষটুকু দেখতে পাওয়া। তাহলে সহনশীলতা মানে কী? এর অর্থ হলো কাঁটার দিকে তাকিয়ে থাকা এবং গোলাপকে দেখতে পাওয়া, রাত্রির দিকে তাকিয়ে থেকে ভোরকে দেখতে পাওয়া। অসহষ্ণিুতা মানে হলো দূরদৃষ্টির অভাব যা আসলে আসন্ন ফলাফল দেখতে না-পারার অক্ষমতা। ঈশ্বরপ্রেমীরা কখনো সহনশীলতা হারায় না, কেননা তারা জানে, নতুন চাঁদকে পূর্ণিমায় রূপান্তরিত হতে সময় লাগে।

সূত্র ৯

উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমের পার্থক্য খুবই কম। তোমার গন্তব্য কী তাতে কিছু যায় আসে না, কেবল এটা নিশ্চিত করো যে প্রত্যেকটি যাত্রাই যেন যাত্রার মতো হয়। তুমি যদি ভ্রমণের মতো ভ্রমণ করতে পারো তাহলে তুমি পুরো বিশ্ব ঘুরে আসতে পারবে আর তাকে ছাড়িয়েও যেতে পারবে।

সূত্র ১০

ধাত্রী জানে যখন ব্যথা ওঠে না তখন শিশুর আসার পথ খোলেনি আর মাতাও জন্ম দিতে প্রস্তুত হয়নি। তেমন করেই নিজেকে নতুন করে জন্ম দিতে গেলে কঠোর বেদনা দরকারী। যেমন কাদাকে শক্ত হয়ে উঠতে গেলে তীব্র উত্তাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তেমনি ভালোবাসা একমাত্র বেদনাতেই বিশুদ্ধ হতে পারে।

সূত্র ১১

ভালোবাসার অন্বেষণ ভোগীকে বদলে দেয়। ভালোবাসার খোঁজ করেছে এবং পরিণত হয়নি এমন একজন অনুসন্ধানকারীও নেই। যে মুহূর্তে তুমি ভালোবাসার অনুসন্ধান করতে থাকবে, সেই মুহূর্ত থেকে তুমি ভেতরে বাহিরে বদলাতে থাকবে।

সূত্র ১২

দৃশ্যমান মহাবিশ্বে যতো নক্ষত্ররাজি আছে তারচেয়েও বেশি ভণ্ড গুরু আর ভূয়া শিক্ষক রয়েছে। আত্মকেন্দ্রিক আর ক্ষমতালোভী লোকের সঙ্গে যথার্থ পথ প্রদর্শককে গুলিয়ে ফেলো না। একজন খাঁটি আধ্যাত্মিক গুরু কখনোই তার দিকে আপনার মনোযোগ আকৃষ্ট করবে না এবং আপনার কাছ থেকে চরম আনুগত্য কিংবা নিরেট প্রশংসা প্রত্যাশা করবে না, বরং আপনাকে সাহায্য করবে আপনার নিজের অন্তরের সত্তাকে উপলব্ধি ও উপাসনা করতে। খাঁটি পথ প্রদর্শকগণ কাঁচের মতো স্বচ্ছ। তারা ঈশ্বরের আলোকে নিজের মধ্য দিয়ে পার হতে দেন।
সূত্র ১৩

চলার পথে যে বদল আসে তাকে আটকানোর চেষ্টা করবেন না। তারচেয়ে বরং জীবনকে আপনার মধ্যে যাপন করতে দিন। আর এমন দুঃশ্চিন্তা করবেন না যে, জীবন একদম উল্টে গেছে। আপনি কী করে জানলেন যে দিকটায় আপনি অভ্যস্ত তা অন্য দিকটার চেয়ে ভালো?

সূত্র ১৪

ঈশ্বর ব্যস্ত আছেন তার কাজে পূর্ণতা আনতে, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় কাজেই। তিনি আপনাকে নিয়ে একদম ব্যতিব্যস্ত। প্রত্যেক মানব জীবনই একটি কর্মরত অবস্থা যা ধীরে ধীরে হলেও অনিবার্যভাবেই পরিপূর্ণতার দিকে এগুচ্ছে। আমরা প্রত্যেকেই অসমাপ্ত শিল্পকর্ম যুগপৎ অপেক্ষায় আছি এবং পূর্ণতার প্রত্যাশায় কঠোর সংগ্রাম করে যাচ্ছি। ঈশ্বর আমাদের সকলকে আলাদা আলাদা করে পরিমাপ করছেন কারণ মানবতা একটি সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম যার জন্য দরকার দক্ষ লিখনশৈলি যেখানে পুরো ছবিটির জন্য প্রত্যেকটি বিন্দুও আলাদা করে গুরুত্বপূর্ণ।

সূত্র ১৫

নিঁখুত ঈশ্বরকে ভালোবাসা সহজ, তিনি পবিত্র এবং অমোঘ। কঠিন কাজটি হলো সঙ্গের মানুষটিকে ভালোবাসা যে কিনা ত্রুটিবিচ্যুতি আর খুঁতে ভরপুর। মনে রেখো, একজন শুধু ততটুকুই জানতে পারে যতটুকু সে ভালোবাসতে পারে। ভালোবাসা ছাড়া কোন প্রজ্ঞা নেই। আমরা যতোক্ষণ ঈশ্বরের সৃষ্টিকে ভালোবাসতে শিখবো না, ততোক্ষণ আমরা সত্যিকারের ভালোবাসতেও পারবো না আর সত্যিকারের ঈশ্বরকেও জানতে পারবো না।

সূত্র ১৬

সত্যিকারের বিশ্বাস একজনের অন্তরে থাকে। বাকী সব স্রেফ ধুয়েমুছে যায়। কেবল একমাত্র একটি ময়লাই আছে যা খাঁটি জলেও পরিস্কার করা যায় না, আর সেটি হলো ধর্মান্ধতা আর ঘৃণায় দূষিত আত্মার দাগ। মিতাচার আর উপবাসের মাধ্যমে তুমি তোমার শরীরকে শুদ্ধ করতে পারবে, কিন্তু একমাত্র ভালোবাসা দ্বারাই তোমার আত্মাকে শোধন করতে পারবে।

সূত্র ১৭

পুরো মহাবিশ্ব একজন একক মানুষের মধ্যে ধরে যায়, সেটা তোমার মধ্যেই। যা কিছু তুমি চারপাশে দেখো, সেইসব সহ যেগুলো তোমার পছন্দের নয় এবং এমনকি সেইসব লোক যাদের তুমি অবজ্ঞা করো বা চরম ঘৃণা করো, তারাও তোমার মধ্যেই আছে বিবিধ মাত্রায়। সেই কারণেই শয়তানকে তোমার বাইরে খুঁজতে যেও না মোটেও। শয়তান কোন অসাধারণ শক্তি নয় যা অহেতুক আক্রমণ করে। এটা ভেতরেরই এক সাধারণ স্বর। যদি নিজেকে পুরোটা জানতে পারো, কাঠিন্য আর সততার মাধ্যমে তাহলে চিনবে তাকে।

সূত্র ১৮

তোমার প্রতি মানুষ কেমন আচরণ করবে তা যদি পাল্টাতে চাও তবে আগে তোমার উচিত নিজের প্রতি নিজের আচরণ পাল্টানো, আগাগোড়া এবং একনিষ্ঠভাবে, এছাড়া আর কোন পথ নেই তোমাকে ভালোবাসানোর। একবার তুমি সেই স্তরে পৌঁছে গেলে, যেভাবেই হোক সবাইকে ধন্যবাদ দিবে যারা হয়তোবা তোমার প্রতি কাটা ছুঁড়েছিলো। এটা হলো এমন একটা ইঙ্গিত যা থেকে বোঝা যায় শিঘ্রই তোমার উপর গোলাপ বর্ষিত হবে।

সূত্র ১৯

অস্থির হয়ো না পথ তোমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে। বরং প্রথম পদক্ষেপের প্রতি মনোযোগী হও। সেটিই সবচেয়ে কঠিন কাজ আর ওটুকুর জন্যই তুমি দায়ী থাকবে। একবার তুমি পা ফেলো আর বাকী সব কিছুকে স্বাভাবিকভাবে তাদের কাজ করতে দাও এবং বাকী সব তোমাকেই অনুসরণ করবে। স্রোতের সঙ্গে যেও না। নিজেই স্রোত হও।

সূত্র ২০

আমরা সবাই সৃষ্টি হয়েছিলাম তার আদলে, আর তবুও আমরা সবাই ছিলাম আলাদা ও অনন্য। দুজন মানুষ কখনোই এক নয়। কোন হৃদয়ই একই স্পন্দনে কাঁপে না। যদি ঈশ্বর চাইতেন সবাইকে একরকম করতে, তিনি তাহলে তাইতো করতেন। তাই, ভিন্নতাকে অবমাননা করো না এবং তোমার নিজের ভাবনা অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া আদতে ঈশ্বরের পবিত্র পরিকল্পনাকেই অবমাননা করা।

সূত্র ২১

ঈশ্বরের সত্যিকারের প্রেমিক যখন পানশালায় প্রবেশ করে তখন পানশালাও তার প্রার্থনা কক্ষ হয়ে যায়, কিন্তু যখন একজন মদে আসক্ত সেই একই কক্ষে প্রবেশ করে, তখন সেটা তার জন্য পানশালাই হয়। যা কিছু আমরা করি আমাদের বাহ্যিক আদল নয়, আমাদের মনই তার মধ্যে ফারাক এনে দেয়। সুফিগণ কখনো অন্য লোককে তারা কে বা দেখতে কেমন তা দিয়ে বিচার করে না। যখন একজন সুফি কাউকে দেখে, সে তার উভয় চোখই বন্ধ রাখে বরং তৃতীয় চোখ খুলে দেয়— সেই চোখ যা অন্তরগত জগতকে দেখে।

সূত্র ২২

জীবন এক সাময়িক ঋণ আর এই পৃথিবী কিছুই না কেবলই বাস্তবতার ভুল অনুকরণ। কেবল শিশুরাই একটা খেলনাকে সত্যিকারের বস্তু মনে করে। আর তারপরও মানব জাতি হয় এই খেলনার মোহে পড়ে কিংবা অবহেলা করে এটি ভেঙে ফেলে আর একপাশে ছুঁড়ে মারে। এই জীবনে সকল রকমের চরমপন্থা থেকে দূরে থাকো, কারণ ওগুলো তোমার অন্তরের ভারসাম্যকে ধ্বংস করবে। সুফিগণ চরমে যান না। একজন সুফি সবসময়ই শান্ত আর মিত।

সূত্র ২৩

ঈশ্বরের সৃষ্টির মধ্যে মানব জাতির অনন্য অবস্থান রয়েছে। ‘আমি ওর মধ্যে আমার আত্মা ফুঁকে দিয়েছি’, ঈশ্বর বলেন। প্রত্যেককে এবং ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের সবাইকেই নকশা করা হয়েছে এই মর্তভূমিতে ঈশ্বরের একজন প্রতিনিধি হিসাবে। নিজেকেই জিজ্ঞাসা করো, কতোবার তুমি ঈশ্বরের প্রতিনিধির মতো আচরণ করো, আদৌ কখনো করে থাকো? মনে রেখো, ঐশ্বরিক আত্মাকে নিজের ভেতরে আবিষ্কার করা এবং সে অনুযায়ী জীবন যাপন করা আমাদের প্রত্যেকের উপর বর্তায়।

সূত্র ২৪

নরক এইখানে এবং বর্তমানে। স্বর্গও তাই। নরক নিয়ে দুঃশ্চিন্তা বাদ দাও, ঠিক তেমনি স্বর্গের স্বপ্ন বাদ দাও, কেননা এ দুটোই বিদ্যমান এই মুহূর্তেই আমাদের ভেতরেই। প্রত্যেকবার আমরা প্রেমে পড়লেই স্বর্গে আরোহণ করি। যতোবার আমরা কারো সাথে ঘৃণা করি, হিংসা করি বা লড়াই করি ততোবার আমরা সরাসরি নরকের আগুনে গিয়ে পতিত হই।

সূত্র ২৫

প্রত্যেকে এবং সকল পাঠকারীই পবিত্র কোরানকে অনুধাবণ করে বিভিন্ন স্তরে, আরোহণ আর বোধের গভীরতার অনুযায়ী। চার স্তরের পরিজ্ঞান আছে। প্রথম স্তরটি হলো বহিরাঙ্গের অর্থ আর এটা সেই স্তর যাতে অধিকাংশ লোকই সন্তুষ্ট থাকে। পরের স্তরটি হলো বাতেনি* — গভীরের স্তর। তৃতীয়ত, গভীরেরও গভীর রয়েছে। আর চতুর্থ স্তরটি এতো নিগুঢ় যে এটাকে ভাষায় বলা যায় না আর তা বর্ণনাতীত সীমাতেই থাকতে বাধ্য।

বাতিন আরবি শব্দ যার আক্ষরিক অর্থ হলো গোপন, আড়ালের বা ভেতরের বিষয়। কোরান শরীফের প্রকাশ্য একটি অর্থ আছে যাকে বলে যাহির। আর গভীরতর আড়ালের অর্থটিই হলো বাতিনী জ্ঞান। সুফিরা বিশ্বাস করেন প্রত্যেক মানুষের ভেতরে বাতিন হয়ে বিশ্বের আত্মা লুকায়িত আছে। সুফিরা আরো বিশ্বাস করেন মানুষের কর্মকাণ্ড যাহির আর কর্মের পেছনের উদ্দেশ্য হলো বাতিন। যখন আধ্যাত্মিক সাধনা দিয়ে আত্মাকে পরিস্কার করা হয় তখনই বাতিন জগত বেরিয়ে আসে। আল্লাহ নিজেও বাতিন কিন্তু সর্বত্র বিরাজমান, আত্মাও তাই। মুসলমান পণ্ডিত এবং সুফি সাধকরা বিশ্বাস করেন পর্যাপ্ত গভীর জ্ঞান ছাড়া বাতিনের খোঁজ পাওয়া যায় না। বাতিন লুকিয়ে থাকে যাহিরের আড়ালেই।

সূত্র ২৬

এই মহাবিশ্ব একটাই সত্তা। সবাই এবং সবকিছুই পরস্পর সংযুক্ত এক অদৃশ্য গল্পের বুননে। আমরা অবগত থাকি বা না থাকি, আমরা সবাই এক নির্বাক কথোপকথনে আছি। কোন অনিষ্ট করো না। সহানুভূতির চর্চা করো। আর কারো আড়ালে গুজব করো না—এমনকি আপাত নিরীহ মন্তব্যও না! যে কথা আমাদের মুখ থেকে বের হয় তা বিলীন হয়ে যায় না বরং চিরতরে রয়ে যায় অসীম মহাশূন্যে আর যথাসময়ে তা আমাদের কাছে ফিরে আসে। একজন লোকের বেদনা আমাদের সবাইকে ব্যথিত করবে। একজন লোকের আনন্দ আমাদের সবাইকে হাসি দেবে।

সূত্র ২৭

যা কিছু তুমি বলবে, মন্দ অথবা ভালো, কোনোভাবে একদিন তোমার কাছে ফিরে আসবে। অতএব, যদি এমন কেউ থাকে যে তোমার সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে, তার সম্পর্কে তুমি একইভাবে খারাপ কথা বললে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে উঠবে। তুমি দুষ্ট শক্তির এক পঙ্কিল চক্রে বন্দী হয়ে যাবে। বরং চল্লিশ দিবা-রজনী সেই লোক সম্পর্কে ভালো কথা বলো ও ভালো কিছু ভাবো। সবকিছু বদলে যাবে এই ৪০ দিন ফুরালে, কেননা তুমি ভেতর থেকে ভিন্ন হয়ে যাবে।

সূত্র ২৮

অতীত হলো একটা ব্যাখ্যা। ভবিষ্যত হলো বিভ্রম। দুনিয়াটা সময়ের মধ্যে দিয়ে এমনভাবে ঘোরে না যাতে মনে হবে সময় একটা সোজা রেখা, অতীত থেকে সোজা ভবিষ্যতগামী। বরং সময় একদিক থেকে আরেকদিকে আমাদের ভেতরেই চলাচল করে এক সীমাহীন বাঁকাচোরা পথে। অনন্তকাল অসীম কাল নয়, তবে স্রেফ সময়হীনতা। যদি তুমি অনন্তকালের আলোকে উপলব্ধি করতে চাও, তবে অতীত এবং ভবিষ্যতকে তোমার মন থেকে ঝেরে ফেলো আর বর্তমান মুহূর্তের সঙ্গে থাকো।

সূত্র ২৯

গন্তব্যের মানে এই না যে তোমার জীবন কঠোরভাবে পূর্বনির্ধারিত। অতএব, সব কিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয়া এবং এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের সুরে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না-করা হলো বিরাট মূর্খতার নির্দশন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সুর সবটাই চিরায়ত আর এটা গাথা হয় ৪০টি বিভিন্ন স্তরে। তোমার গন্তব্য হলো সেই স্তর যেখানে তুমি তোমার সুরটি বাজাও। তুমি হয়তো তোমার সুরের যন্ত্রটি পাল্টাতে পারবে না কিন্তু কতো ভালো বাজাতে পারবে তার পুরোটাই তোমার উপর নির্ভর করে।

সূত্র ৩০

সত্যিকারের সুফি এমন যে, এমনকি অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত, আক্রান্ত এবং সবদিক থেকে নিন্দিত হলেও তিনি স্থিরভাবে সহ্য করে যান, তার সমালোচকদের সম্পর্কে একটা বাজে সুরও তোলেন না। একজন সুফি কখনোই দোষারোপ করেন না। কী করে একজন বিরোধী কিংবা প্রতিদ্বন্দী কিংবা ‘অন্যকেউ’ বলে কিছু থাকবে যখন প্রথমতই ‘আত্ম’ বলে কিছু থাকে না? কী করে কাউকে দোষারোপ করা যাবে যখন সবখানে কেবল একজনই আছেন?

সূত্র ৩১

তুমি যদি নিজের বিশ্বাসকে দৃঢ়তর করতে চাও, তোমার ভেতরটাকে নরম করতে হবে। কঠিন পাথরের মতো বিশ্বাসের জন্যে তোমার হৃদয়কে হতে হবে পালকের মতো কোমল। অসুস্থতায়, দূর্ঘটনায়, ক্ষতিতে বা আতঙ্কে, কোনো না কোনোভাবে, আমরা সবাই এমন ঘটনার মুখোমুখি হই যা আমাদেরকে কম স্বার্থপর ও সমালোচক এবং বেশি দরদি ও উদার হতে শেখায়। যদিও আমরা কেউ কেউ শিক্ষা নেই এবং কোমলতর হই, তবুও অন্য কেউবা আগের থেকে আরো বেশি কঠোরতর হয়ে ওঠে…

সূত্র ৩২

তোমার আর সৃষ্টিকর্তার মধ্যে কারো দাঁড়ানো উচিত না। কোন ইমাম, পাদ্রী, দরবেশ কিংবা নীতি বা ধর্মের অন্য কোন নেতা বা জিম্মাদারও না। কোন আধ্যাত্মিক গুরু এবং এমনকি তোমার বিশ্বাসও না। বিশ্বাস রাখো তোমার মূল্যবোধ আর অনুশাসনের উপর, কিন্তু কখনো সেগুলোকে অন্যের উপর আধিপত্য করতে দিও না। তুমি যদি অন্যের হৃদয় ভেঙে দিতে থাকো, যা কিছু ধর্মের দায়ই পালন করো না কেন তা কোন শুভ কাজ হবে না। সকল রকমের অন্ধ-উপাসনা থেকে দূরে থাকো, কারণ তারা তোমার দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দেবে। কেবল ঈশ্বর এবং একমাত্র ঈশ্বরকেই তোমার পথ প্রদর্শক হতে দাও। সত্যকে পাঠ করো, তবে বন্ধু আমার, সাবধান থেকো যাতে তোমার সত্য তোমার ভক্তিবস্তু না হয়ে ওঠে।

সূত্র ৩৩

যখন এই দুনিয়ার সবাই কোথাও যাওয়ার, কিছু হয়ে ওঠার সংগ্রাম করতে থাকে, কেবল মৃত্যুর পর এইসব পেছরে ফেলে চলে যেতে হবে, তুমি বরং সঙ্কল্প করো সর্বোচ্চ শূন্যতার। জীবনকে যাপন করো একদম হালকা আর ফঁকাভাবে ঠিক শূন্য সংখ্যাটির মতো। আমরা একটা পাত্র থেকে আলাদা কিছু নই। এর বাইরে সাজসজ্জা নয় বরং ভেতরের শূন্যতাই আমাদেরকে সোজা করে ধারণ করে। ঠিক তেমনি, আকুল হয়ে যা অর্জন করতে চাই তা নয় বরং শূন্যতার বোধই আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে চলে।

সূত্র ৩৪

নত হওয়া মানে দূর্বলতা বা নিস্ক্রিয়তা নয়। এটা নিয়তিবাদ কিংবা সমপর্নেও ধাবিত করে না। বরং তার উল্টোটাই। সত্যিকারের শক্তি নত হওয়াতে বিদ্যমান যা ভেতর থেকে আসে। যারা জীবনের ঐশ্বরিক নির্যাসে নিজেকে সমর্পন করে তারা অবিচল স্থিরতা আর প্রশান্তিতে বাস করবে এমনকি যদি বিপুল এই পৃথিবী একের পর এক ঝঞ্জার মধ্যে দিয়ে যেতে থাকলেও।

সূত্র ৩৫

এই পৃথিবীতে, সামঞ্জস্য বা নিয়মনিষ্ঠা আমাদের একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় না, বরং নিরেট বিরুদ্ধতাগুলিই তা করে। আর মহাজগতের সকল বিরুদ্ধতাগুলি আমাদের প্রত্যেকের এবং সকলের মাঝেই বিরাজমান। অতএব বিশ্বাসীর প্রয়োজন অবিশ্বাসীর মাঝে বসবাস করা। আর অবিশ্বাসীর উচিত তার মধ্যের নিরব বিশ্বাসীকে জেনে নেয়া। আর যতোদিন কেউ ইনসান-ই-কামিল*, বিশুদ্ধতম মানবে না পৌঁছাবে ততোদিন পর্যন্ত বিশ্বাস একটা ধীর পর্যায়ে তৈরি হবে এবং তার ঠিক বিরুদ্ধবাদ, অবিশ্বাস, সেটাও অপরিহার্যভাবে রয়ে যাবে।

ইসলাম ধর্মে আল-ইনসান-আল-কামিল বা ইনসান-ই-কামিল বলতে হযরত মুহম্মদ (সাঃ) -কে বোঝায়। এটা মুহম্মদ (সাঃ)-এর সম্মানজনক উপাধি। এই উপাধির দ্বারা এমন একজন মানুষকে বোঝায় তিনি চ‚ড়ান্ত উৎকর্ষে পৌঁছেছেন এর আক্ষরিক অর্থ হলো, ‘পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তি’। ইসলামের আদি মানবের ধারণাকে ‘ইনসান-ই-কামিল’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। আদতে সুন্নি সুফিরা এই ধারণার প্রবর্তক। ইবনে আরাবি বর্ণিত একটি হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘যখন আদম জল আর কাদার মাঝে ছিলো, তখন আমি একজন নবী ছিলাম।’ বাতেনি ধারণা মতে, মুহম্মদের জন্ম সকল সৃষ্টির আগে হয়েছে।

সূত্র ৩৬

এই দুনিয়া দাঁড়িয়ে আছে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার নীতির উপর। এক ফোঁটা উদারতা কিংবা এক কণা অনিষ্ট অপরিশোধ রইবে না। অন্যের প্রতি কোন চক্রান্ত, প্রতারণা কিংবা ছলনাও। কেউ যদি একটা ফাঁদ পাতে, মনে রেখো, ঈশ্বরও তাই করবে। তিনি সবচেয়ে বড় পরিকল্পনাকারী। ঈশ্বরের জানার বাইরে এমনকি একটা গাছের পাতাও নড়ে না। সরলভাবে এবং পরিপূর্ণভাবে এটা বিশ্বাস করো। যা কিছু ঈশ্বর করেন, তিনি তা সুন্দরভাবেই করেন।

সূত্র ৩৭

ঈশ্বর এক অতিসতর্ক ফেরি নির্মাতা। তার ধারাক্রম এতো যথাযথ যে এই দুনিয়াতে যা কিছু ঘটে তা নির্ধারিত সময়েই ঘটে। এক মিনিট আগেও না, এক মিনিট পরেও না। আর কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই প্রত্যেকের জন্যে ঘড়ি কাটায়-কাটায় চলে। প্রত্যেকের জন্যেই ভালোবাসার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে এবং মৃত্যুরও নির্দিষ্ট সময় আছে।

সূত্র ৩৮

নিজেকে এটা জিজ্ঞেস করতে কখনোই খুব দেরি হয়ে যায়নি যে, ‘আমি কি তৈরি যে জীবন কাটাচ্ছি তা পাল্টাতে? আমি কি বদলের জন্য তৈরি আছি?’ এমনকি যদিও তোমার জীবনের একটি দিনও আগের দিনের মতো হুবহু হয়, নিশ্চয়ই তবে সেটা করুণাকর। প্রত্যেক মুহূর্তে এবং প্রতিটি নিঃশ্বাসে মানুষের উচিত নবজন্ম নেয়া এবং আবার নবজন্ম নেয়া। নব জন্ম পাওয়ার একমাত্র একটি পথই আছে: মৃত্যুর আগে মরা।

সূত্র ৩৯

খণ্ডাংশ বদলাতে পারে, পুরো অংশটি একই রয়ে যায়। দুনিয়া থেকে একটা চোর চলে গেলে আরেকটা নতুনের জন্ম হয়। আর প্রত্যেক সম্ভ্রান্ত লোক যারা চলে যায় তাদের বদলে নতুনরা আসে। এইভাবেই সব কিছু শুধু একই রয়ে যায় না বরং আদতে কিছুই কখনো বদলায় না। প্রত্যেক সুফির মৃত্যু হলে আরেকজনের জন্ম হয় অন্যকোথাও।

সূত্র ৪০

ভালোবাসাবিহীন একটা জীবন গণণার মধ্যে পড়ে না। নিজেকে জিজ্ঞেস করো না কেবল ভালোবাসো। তোমার খোঁজা উচিত, আধ্যাত্মিক কিংবা দৈহিক, ঐশ্বরিক কিংবা পার্থিব, প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্য। বিভাজন আরো বিভাজনের দিকেই নিয়ে যায়। ভালোবাসার নির্দিষ্ট কোন মোড়ক বা সংজ্ঞা নেই। ভালোবাসা কেবল ভালোবাসাই, নিখাদ আর সরল। ভালোবাসা হলো জীবনের জল। আর একজন প্রেমিক হলো আগুনের আত্মা! মহাবিশ্ব বদলে যায় যখন আগুন ভালোবাসে জলকে।

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All Rights Reserved © rmgbdnews24.com