আমরা আমাদের সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই মোবাইল স্ক্রিন ও টেলিভিশন থেকে দূরে রেখেছি। কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যরা এ ব্যাপারে তেমন কোনো সচেতন না। দেখা যায় তারা হয়তো তাকে সাথে নিয়ে মোবাইল দেখছে অথবা টিভি দেখছে। তাদেরকে বুঝিয়ে বলেছি কিন্তু তেমন কোনো লাভ হয় নি। খাবারের মেন্যুর ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখা যায় প্রায়। কখনো ভাবি আলাদা বাসা নিয়ে থাকব, আবার মনে হয় যে সেই কাজের বুয়ার কাছে সন্তানকে রেখে যেতে হবে। তাও তো এখন বুয়াও পাওয়া যায় না। তখন আবার মনে হয় ওনারা আমার সন্তানের যত্ন না করলে মমতা না দিলেও চড় থাপ্পড় হয়তো মারবেন না। তাই আর যাওয়া হয় না।
অধিকাংশ সময় এরা এত মমতা দেন যে সন্তানকে সোজা পথে আনাটা কঠিন হয়ে যায়
ভাবনাটাকে খেয়াল করবেন সন্তানের যত্ন না নিলেও চড় থাপ্পড় হয়তো মারবেন না। চড় থাপ্পড় মেরেও ফেলতে পারেন। আবেগ প্রবণ হলে রেগে গেলে। কিন্তু মমতা দেবেন না। যদি মেয়ে হতো তাহলে কথা ছিল। ছেলে। এ হচ্ছে বংশের- এখনকার সামাজিক ভাষায় চেরাগ। (হাসি) তো বংশের চেরাগ তাকে মানে মমতা দেবেন না। আসলে যত্ন না করলেও মমতা না দিলেও বরং অধিকাংশ সময় দেখা যায় যে এরা এত মমতা দেন যে ঐ মমতা থেকে সন্তানকে সোজা পথে আনাটা কঠিন হয়ে যায়। আমি শুধু মানে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্যে কথাগুলো বলছি।
তারা আপনার মুরব্বি, বোঝাতে পারবেন না
যেহেতু যৌথ পরিবার তাই এ বিষয় নিয়ে। এক হচ্ছে যে তাদের বুঝিয়ে লাভ নাই খাবারের মেন্যু, মোবাইল টিভি দেখা, যেরকম আমার নিজের আগে ধারণা ছিল যে বয়স্করা কী টিভি দেখবে আর মোবাইল দেখবে। অ্যা একটু আল্লাহ খোদার নাম নেবে, মারা যেতে পারে তো যে-কোনো সময়। কিন্তু এখন দেখি যে আল্লাহ খোদার নামের চেয়ে মোবাইল টিভির সবকিছু মুখস্থ এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল আর টিভির মধ্যে চালাচ্ছে। আগে তো তবুও নাতি-নাতনির সাথে কথাটথা বলত। এখন নাতি-নাতনির সাথেও কথা বলে না। টিভির সাথে মোবাইলের সাথে। অতএব তাদেরকে বোঝানোর কিছু নাই তারা তো বুঝে বসে আছেন। তারা আপনার মুরব্বি, বোঝাতে পারবেন না।
খাবারের মেন্যু তারা এতদিন ধরে যেভাবে খেয়ে আসছেন, খাবারের মেন্যু চেঞ্জ করা খুব ডিফিকাল্ট। কারণ খাবারের অভ্যাসটাকে চেঞ্জ করা খুব ডিফিকাল্ট। তো এই অভ্যাসটাকে দূর করা খুব কঠিন। আর বয়স্ক মানুষের অভ্যাস দূর করা আরো কঠিন। তো আসলে খাবারের মেন্যু বাচ্চার ক্ষেত্রে আপনি প্রয়োগ করতে পারবেন। আপনি শ্বশুর-শাশুড়ির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারবেন না কারণ শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে তার ছেলে এখনো খোকা। আপনি এখনো খোকার বউ তো খুকি হবে।
যেহেতু যৌথ পরিবার তাই এসব বিষয় নিয়ে স্বামী-স্ত্রী প্রায় তর্কাতর্কি ঝগড়া হয়। প্রতিদিনই কিছু না কিছুতে আমাকে অপদস্থ ও বিরক্ত অবহেলা প্রদর্শন করে সবাই। তারা তারা গল্প করে, কোনো আনন্দে আমাকে ডাকে না। আমাকে নাকি ভয় পায়।
স্বামীকে বললে স্বামী রাগ করে বলে আলাদা থাকব। আবার আমি ভাবি এতদিন শ্বশুর-শাশুড়ি দেবর-ননদের অপমান সহ্য করে একসাথে থাকলাম এখন চলে গেলে আমি নিজের কাছে হেরে যাব। আর আমার স্বামীর ব্যবহারও খুব খারাপ। বিয়ের পর থেকেই আমার দোষ ধরে শুধু। বাপ-মা ছাড়া থাকলে আমার দোষ বাড়বে শান্তি নষ্ট হবে।
আপনি বাইরে ঝগড়া করছেন না কিন্তু মনে মনে ঝগড়া করছেন
আপনি কিন্তু সবকিছু ধরে নিয়ে আছেন। নেগেটিভ সব জিনিসগুলো আপনার মনের মধ্যে কিন্তু বাসা বেঁধে আছে। আপনার ভাবনাটা কিন্তু নেগেটিভ। আপনি পজিটিভ ভাবতে পারছেন না। আমাদের কোয়ান্টাম মেথড বইতে কিন্তু এটা বলা আছে। বাস্তবে কী হয়? আপনি যখনই শ্বশুর-শাশুড়ির কথা মনে পড়ে আপনি মনে মনে তার সাথে তর্ক করেন। ননদ-দেবরের কথা প্রসঙ্গ যখন আসে তখন আর্গুমেন্ট করেন তর্ক করেন বিতর্ক করেন। মনে মনে ঝগড়া করেন। আপনি বাইরে ঝগড়া করছেন না এটা ঠিক আছে, কিন্তু মনে মনে ঝগড়া করছেন। ধরুন ফ্যামেলি রিলেশনশিপ যতটা না লিগ্যাল তার চেয়ে বেশি এটা ইমোশনাল। লিগ্যালতো বটেই, যে আপনি বউ হিসেবে আইনসম্মতভাবে বিয়ে করে আপনার স্বামী আপনাকে ভরণপোষণের ওয়াদা করে নিশ্চয়তা দিয়ে তিনি বিয়ে করেছেন। এটা লিগ্যাল। কিন্তু এই লিগ্যালিটির পরে যে সম্পর্কটা দাঁড়ায় সেটা হচ্ছে ইমোশনাল আবেগের। তো আপনার যে ভেতরের যে আবেগ ভেতরের যে নেগেটিভিটি ভেতরের যে ঝগড়া ভেতরের যে তর্ক এটাতো বাস্তব রূপ, আপনি বাস্তবে সামনে দেখতে পাবেন।
যেরকম আপনি দেখবেন যে যখন আপনার কারো সাথে ঝগড়া হয়। হাজবেন্ডের সাথেও যখন ঝগড়া হয়, যখনই ঐ হাজবেন্ডের কথা মনে হলো আজ সকালবেলা ঝগড়া হয়েছে, সারাদিন কিন্তু আপনি তার সাথে বিতর্ক করছেন। সারাদিন নেগেটিভ। এই বুঝল না। অ্যা এত কষ্ট করছি- এবং ঝগড়ার সাথে সাথে এর আগে কতবার সে কতরকম খারাপ কথা বলেছিল সব চেইন রিএকশন আসতে থাকে। একদম ফ্ল্যাশব্যাক একটার পর একটা একটার পর একটা একটার পর একটা। তো ফলে কী হচ্ছে? আপনার ভেতরটা নেগেটিভ হয়ে যাচ্ছে।
কীভাবে অবহেলা করবে যদি আপনি নিজেকে অবহেলিত মনে না করেন?
এই যে প্রতিদিন কিছু না কিছুতে আমাকে অপদস্থ বিরক্তি অবহেলা প্রদর্শন করে সবাই। কীভাবে আপনাকে অবহেলা করবে যদি আপনি নিজেকে অবহেলিত মনে না করেন। একজন যুবকের কথা বলি। তো সে যুবক আরেক মেয়ে তাকে নিমন্ত্রণ করেছে। খুব ভালো খাবারদাবার খাচ্ছে- অ্যা খাবারদাবার খাচ্ছে। এর মধ্যে মেয়ের বাবা এসে উপস্থিত। মেয়ের বাবা মেয়েকে বকাবকি করছে। এবং মেয়েকে বকা মানে তো মেয়েকে বকা না। বকাটা কাকে দেয়া? সেই যুবককে দেয়া। খুব বকাবকি করছে। এবং যুবক মনে করছে যে এখন তার সামনে কয়টা অল্টারনেটিভ আছে। দুটো অল্টারনেটিভ। এক হচ্ছে খাওয়া কন্টিনিউ করা অথবা ওঠে চলে যাওয়া। তো যুবক ওঠে গেল না, যুবক খাওয়া কন্টিনিউ করল। বকার তো একটা লিমিট আছে। অ্যা বকে চলে গেছে। এবং যুবকের কাছে সেই মানে মেয়েতো ক্ষমা চাচ্ছে। যুবক খুব নির্বিকার যে ক্ষমা চাওয়ার কী আছে? বলে আপনি যে এরপরে খাওয়া কন্টিনিউ করবেন এটা তো বুঝতে পারি নাই। তো যুবক বলে যে খাওয়া কন্টিনিউ করব না কেন? খাবারটাতো ভালো (হাসি) এক নম্বর। দুই নম্বর হচ্ছে যে আপনি দাওয়াত করেছেন এখন যদি আমি ওঠে চলে যাই কষ্টটা আপনার হবে, আপনার বাবার তো কোনো কষ্ট হবে না। যেহেতু আপনি আমাকে দাওয়াত করে এনেছেন আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাই নি এবং আমি কোনো কষ্ট পাই নি। উনি তো না বুঝে বকেছেন। উনি ভাবছেন যে আমি আপনার প্রেমে পড়েছি। এবং উনি স্বাভাবিকভাবে আমাকে মনে করছেন না যে আমি আপনার উপযুক্ত। উনি যা করেছেন জাস্টিফাইড এবং যে-কোনো বাবা এটাই করবে। সো বাবা ঠিক। আর আপনার খাবার রান্না অত্যন্ত চমৎকার, রান্নাটা ভালো হয়েছে। এটা না খাওয়াটা বোকামি রান্না ওয়াজ ফার্স্ট ক্লাস এবং বাবারও চিন্তার কিছু নাই কারণ তিনি যা ভাবছেন ঘটনা তা নয়।
আমরা কোয়ান্টামে বলি যে আপনি যদি অপমানিত ফিল না করেন তো কেউ আপনাকে অপমানিত করতে পারে না। অপমানিত অনুভব করাটা নিজের ওপরে। আপনি কেন অপমানিত অনুভব করবেন? কেন আপনাকে অপদস্থ বিরক্তি অবহেলা প্রদর্শন করে। আপনি কেন ভাববেন যে আপনাকে অবহেলা করছে।
আপনি মনে মনে যা ভাবেন ওটার প্রতিফলনই তাদের চেহারায় দেখতে পান
কেন আপনাকে ভয় পাবে? কারণ পুরোটাই হচ্ছে আপনার ভাবনা। কী করেন? ভাবনাটাকে চেঞ্জ করে দেন। যে না আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আমাকে পছন্দ করে। তারা আমাকে ডাকে না ভয় পায়। যদি ভয় পায় আপনাকে তো ভয় ভাঙার দায়িত্ব তো আপনার। অর্থাৎ পুরো জিনিসটা আপনার কাল্পনিক। আপনি যা কল্পনা করেন মনে মনে যা ঝগড়া করেন মনে মনে যা ভাবেন বাস্তবে যখন যান তখন আপনি ওটার প্রতিফলনই ওটার রিফ্লেকশন তাদের চেহারায় দেখতে পান।
আজকে থেকে কী করবেন? দৃশ্যপটটা চেঞ্জ করে ফেলেন। যখনই আপনার শাশুড়ির কথা মনে হবে যখনই ননদের কথা মনে হবে যখনই শ্বশুরের কথা মনে হবে যখনই অন্যদের কথা মনে হবে সাথে সাথে ভাববেন যে আ তারা আপনাকে কত আদর করে। কারণ আপনি তাদের ছেলের বউ এবং আপনি তাদের ভবিষ্যৎ চেরাগের মা। (হাসি) মানে অর্থাৎ নাতির মা। তো অতএব আমাকে আদর করে আমাকে ভালবাসে আমাকে পছন্দ করে। আপনি এখন থেকে ভাবতে শুরু করেন এবং ৪০ দিন এই ভাবনা ভাববেন এবং কমান্ড সেন্টারে এনে শ্বশুর-শাশুড়ি ননদ-দেবর মানে ঝা যা-কিছু আছে। সবাইকে নিয়ে আসেন কমান্ড সেন্টারে এবং এনে দেখেন যে তারা খুব সুন্দর গল্প করছে খুব সুন্দর কথা বলছে, সবকিছু ভাবছে এবং আপনাকে খুব আদর করছে আপনার খুব যত্ন নিচ্ছে। এবং আপনাকে তারা আপন মনে করছে। আপনাকে তারা ডাকছে। আপনাকে সবকিছুর মধ্যে ইনভলভড করছে।
যেহেতু আপনি বুঝদার, আপনাকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে
আর ইনভলভড হওয়া তো সবসময় নিজের ওপরে নির্ভর করে। অ্যা আপনি এগিয়ে যান না, অ্যা শাশুড়িকে একগ্লাস পানি তুলে দেন না, আম্মা খান। অর্থাৎ মন জয় করতে হবে এবং মন জয়ের ক্ষেত্রে যেহেতু আপনি বুঝদার আপনি ভিকটিম আপনাকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এবং আপনি যখন অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন। অ্যা ফরটি ডেজ আপনি দেখবেন যে সিচুয়েশন চেঞ্জ হয়ে গেছে।
[প্যারেন্টিং ওয়ার্কশপ, ২৭ মে ২০২৩]