মানুষ যে মাটিতে আছাড় খায়, সেই মাটি ধরেই আবার সে উঠে দাঁড়ায়। এটাই হচ্ছে স্বাবলম্বনের সবচেয়ে সহজ প্রকাশ। স্বাবলম্বন শব্দটি এসেছে স্ব-অবলম্বন থেকে। স্বাবলম্বী সেই ব্যক্তি যে তার মেধা, যোগ্যতা সর্বোপরি তার মহামূল্যবান মস্তিষ্কের ওপর আস্থা রাখে। বাইরের শক্তি এসে তাকে সাহায্য করবে এমন অলীক কল্পনা সে করে না। নিজের দায়িত্ব সে নিজে নেয়। এমনকি আশেপাশের দায়িত্বও সে নিয়ে নেয়। স্বাবলম্বী মানুষ শূন্য থেকে শুরু করে কিন্তু ধাপে ধাপে তার কাজ পূর্ণতা পায়।
একবার ইন্টারভিউ বোর্ডে এক ছেলে নোংরা পোশাক পরে এসেছে। শিক্ষকরা জিজ্ঞেস করছে, তোমার পোশাক এতো নোংরা কেন? সে বললো, আমার কাজের ছেলেটা ছুটিতে আছে। আর আমার মা আমাকে শেখান নি কীভাবে কাপড় পরিষ্কার করতে হয়। যে ছেলে-মেয়ে নিজের বিছানা নিজে গোছাতে পারে না, নিজে সময়মতো ঘুম থেকে জাগতে পারে না, নিজের জুতো ঠিক জায়গায় রাখতে পারে না, যার পানিটাও অন্যকে ঢেলে দিতে হয়। সে আসলে জীবন যুদ্ধে অন্য অনেকের চেয়ে পিছিয়ে থাকে।
অথচ পৃথিবীর অন্যতম সফল মানুষ রসুলুল্লাহ (স) শৈশব থেকেই ছিলেন একজন স্বাবলম্বী মানুষ। যিনি জীবনে বাবার মুখ দেখেন নি। ৬ বছর বয়সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই যে তার মাকে হারিয়েছে। ৯ বছর বয়সে দাদাও মারা গেলেন। এরপরে চাচার কাছে তিনি লালিতপালিত হন। এতিম শিশুকে চাচা মেষ চরাতে দিতে চান নি। কিন্তু সেই বালক নিজেই বেছে নিলেন মরুভূমিতে মেষ চরানোর মতো পরিশ্রমসাধ্য কাজ। একেবারে শৈশবেই তিনি ছিলেন পরিশ্রমী আর কর্মঠ। তরুণ বয়সে মরুভূমির দীর্ঘপথ, পানির তৃষ্ণা, যাত্রার কষ্ট থাকা স্বত্ত্বেও নবীজী (স) বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন এবং সফল হলেন। নিজের দায়িত্ব নিজে নেয়ার যে আগ্রহ সেটাই তাকে মহিমান্বিত করেছে। নবীজী (স) ইসলামের প্রথম মসজিদ নির্মাণের সময়ও সবার সাথে মাটি কাটায় অংশ নিয়েছেন, মাটি বহন করেছেন। তাই তো পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বত্র তিনি সফল হয়েছেন।
স্বাবলম্বী হবার পথে অন্তরায় ভ্রান্তদৃষ্টি : সব কাজ আমি করলে অন্যেরা করবে কী? কাজের শ্রেণী বিন্যাস করি। কোনটি ছোট কাজ কোনটি বড় কাজ এ নিয়ে মাথা ঘামাই, অহমবোধে ভুগি। এই ধরনের কাজ করলে আমার স্ট্যান্ডার্ড নষ্ট হবে। এই আশঙ্কায় নিজে উদ্যোগ নিয়ে কাজ শিখি না। অথচ সফল ব্যক্তিরা সব কাজকেই সম্মান করতেন।
আমেরিকান সিভিল ওয়ারের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোয়াইট হাউসে গিয়ে প্রেসিডেন্ট লিংকনকে জুতো পালিশ করতে দেখে খুব অবাক হলেন। বললেন, স্যার, আমাদের দেশে কোনো ভদ্রলোক নিজের জুতো পালিশ করেন না। লিংকন তার স্বভাবসুলভ বাকপটুতার সঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন, তাহলে কার জুতো পালিশ করেন তারা?
উত্তরণের পথ :
১. প্রতিটি কাজকে সম্মান করুন। এমনকি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ যখনই সুযোগ পান করুন। কারণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক। যত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবেন তত আপনার ঈমান শক্তিশালী হবে।
২. চোখ কান খোলা রাখুন। উদ্যোগ নিয়ে প্রতিটি কাজের খুঁটিনাটি শিখুন। এবং শেখার জন্যে সবসময় প্রস্ত্তত থাকুন। পৃথিবীতে অসম্ভব বা আমি পারি না বলে কিছু নেই।
৩. যে কাজ নিজে করতে পারেন সে কাজের জন্যে অন্য কারো ওপরে নির্ভর করবেন না। গৃহকর্মীকে সাধ্যমতো কাজে সহযোগিতা করুন। আপনি যেভাবে থাকতে চাইবেন প্রকৃতি আপনাকে সেইভাবে রাখবে। বেশি বেশি দায়িত্ব নেয়ার মানসিকতা তৈরি করুন।
৪. মেডিটেশন করুন : মেডিটেশন আপনাকে অবচেতন মনের অনীহা দূর করতে সহায়তা করবে। কাজের ব্যাপারে আপনি উদ্যমী হবেন। নিয়মিত মেডিটেশন আমাদের অন্তর্গত শক্তিকে জাগ্রত করে, ফলে পরনির্ভরশীলতা দূর হয়, নিজের ওপর নিজের আস্থা বাড়ে। নিজের গুণগুলো আরো শানিত হয়।
৫. সৎসঙ্ঘে সঙ্ঘবদ্ধ থাকুন : শেখ সাদীর বিখ্যাত কবিতা- ঈগল ঈগলের সাথে মেশে আর কবুতর মেশে কবুতরের সাথে। যাদের সাথে আপনি দিনের একটি বড় অংশ কাটান দেখবেন তাদের আচার আচরণ দেখে আপনি প্রভাবিত হবেন। আপনার চারপাশে যারা শুধু হুকুম করতে পছন্দ করে এদের সাথে থাকলে আপনি আরো কুঁড়ে হয়ে যাবেন। সৎসঙ্ঘে একাত্মতা আমাদের সুশৃঙ্খল আর পরিশ্রমী করে তোলে।